জাতি-রাষ্ট্র একটি আধুনিক ধারণা। তার এর গঠন-প্রক্রিয়া দীর্ঘকালের। স্তরে স্তরে পলি পড়ে নদীর বুকে ভূ-ভাগ সৃষ্টি হওয়ার মতো। এটি কোনো একদেশী ব্যাপার নয়। নির্দিষ্ট ভূখণ্ড,রক্তসম্বন্ধ,ভাষা,সাহিত্য,সংস্কৃতি,বিশ্বাস,ইতিহাস-ঐতিহ্য,জীবন-সংগ্রাম,আর্থ-সামাজিক অবস্থা প্রভৃতি অনেক কিছু নিয়ে জাতি-রাষ্ট্র ধারণার উৎপত্তি ও বিকাশ।
হাজার বছরের বেশি সময় ধরে এ ভূখণ্ড (বাংলাদেশ) নানা নামে পরিচিত ছিল। এক সময় বলা হতো গঙ্গাঋদ্ধ,বলা হতো গৌড়, ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস: আদি পর্ব’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন,‘গৌড় নাম লইয়া বাংলার সমস্ত জনপদগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করিবার যে চেষ্টা শশাঙ্ক, পাল ও সেন রাজারা করিয়াছিলেন সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই।
সেই সৌভাগ্যলাভ ঘটিল বঙ্গ নামের, যে বঙ্গ ছিল আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক হইতে ঘৃণিত ও অবজ্ঞাত এবং যে বঙ্গ নাম ছিল পাল ও সেন রাজাদের কাছে কম গৌরব ও কম আদরের। কিন্তু সমগ্র বাংলাদেশের বঙ্গ নাম লইয়া ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নাই, তাহা ঘটিল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পাইল আকবরের আমলে। ইংরেজ আমলে বাংলা নাম পূর্ণতর পরিচয় ও প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে।’
বিশ্বজুড়ে বাংলার যে পরিচিতি ইতিহাসের প্রেক্ষিতে দীর্ঘ সময় ধরে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের অপেক্ষায় সময়ের পরিসর অতিক্রম করেছে। তিনিই উপমহাদেশের একমাত্র নেতা যিনি উপমহাদেশের মানচিত্রে একটি স্বাধীন ধর্মনিরপেক্ষ-রাষ্ট্রের সংযোজন ঘটিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুদিবস মৃত্যুর ঊর্ধ্বে জীবনসত্যের বড় পরিচয়। বিশ্বের অনেক নেতা যেভাবে ইতিহাসের পাতায় আছেন অজেয় প্রেরণায় তেমনি বঙ্গবন্ধু আছেন।
বিশ্বের অনেক নেতার মতো তিনি দেশের পরিচিতি বিস্তৃত করেছেন। বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ট্রোর নামের সঙ্গে যুক্ত হয় কিউবা, নেলসন ম্যান্ডেলার নামের সঙ্গে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা,হো চি মিনের নামের সঙ্গে ভিয়েতনাম, সুকর্ণের নামের সঙ্গে ইন্দোনেশিয়া,মিশরের সঙ্গে কর্নেল নাসের,প্যালেস্টাইনের সঙ্গে ইয়াসির আরাফাত,এমন আরও অনেকে। তেমনি বাংলাদেশের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান। তাঁর নাম উচ্চারণ না করে বাঙালির পরিচয় কখনো পূর্ণ হবে না। বাঙালির সভ্যতা-সংস্কৃতির আবহমান স্রোতে তিনি নতুন অভ্যুদয় ঘটিয়েছেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ একটি স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে পূর্ণরূপ লাভ করেছে।
বঙ্গবন্ধু একদিকে ‘রাজনীতির কবি অপরদিকে ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার’। ১৯৭১-এ বিশ্বখ্যাত ‘নিউজউইক’ ৫ এপ্রিল সংখ্যায় সাপ্তাহিক সাময়িকীতে তাঁকে ‘রাজনীতির কবি’ আখ্যায়িত করেছিল তাঁর বক্তৃতায় সৌন্দর্যভরা ও আকর্ষণীয় শিল্পগুণের জন্য। এর উৎকৃষ্ট একটি উদাহরণ ৭ মার্চের ভাষণ। অপরদিকে বলা হয় ‘ক্যারিশম্যাটিক লিডার ’ অর্থাৎ তাঁর চরিত্রে ক্যারিশমা-গুণ যুক্ত হয়েছে। ‘ক্যারিশমা’ হলো সম্মোহনী শক্তি। যে নেতার শক্তিশালী, আকর্ষণীয় ও অনন্য ব্যক্তিগত গুণাবলি অন্যকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করে, তিনিই ক্যারিশম্যাটিক লিডার।
বঙ্গবন্ধু তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এ গুণাবলি অর্জন করেই হয়ে উঠেছিলেন দুঃখণ্ডদৈন্যপীড়িত ও উপেক্ষিত-শোষিত-বঞ্চিত বাঙালির মহান জাতীয়তাবাদী নেতা এবং বাঙালির শতসহস্র বছরের কাক্সিক্ষত স্বাধীন রাষ্ট্রকামনা বাস্তবায়নের প্রধান রূপকার। তাই তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি ও স্রষ্টা এবং রাজনৈতিক অর্থে রাষ্ট্রপিতা ।
বঙ্গবন্ধুর অতুলনীয় কৃতিত্ব এখানে যে,তিনি বাংলাদেশে চারটি ধর্মে (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিম) বিভক্ত অসম ও অসমন্বিত উপাদানে গঠিত বাঙালি জাতির এবং প্রায় পঞ্চাশটি ক্ষুদ্র জাতিসত্তাকে একই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অটুট ঐক্যে গ্রথিত করে একটি জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হন। এ রকম সাফল্য নজিরবিহীন। তিনি যে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা এবং নবরাজনৈতিক জাতি-রাষ্ট্রের পিতা তাঁর তাত্ত্বিক ভিত্তির জন্য শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ জার্মান দার্শনিক হেগেলের উদ্ধৃতি নিতে পারি। শেখ মুজিব তাঁর যুগের ইচ্ছা ও এষণাকে (রিষষ ড়ভ যরং ধমব) বাস্তবে রূপ দিয়েছিলেন। তাই বলতে হয় তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্রষ্টা ও বাঙালির জাতির পিতা।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আগে কয়েকশত বছরে যে বাঙালি জাতি গড়ে উঠে তা ছিল একটি নৃগোষ্ঠী (জধপব) মাত্র। একই ভাষা ও সাধারণ আর্থ-সামাজিক জীবনধারার বিকাশের ফলে এবং শারীরিক, মনস্তাত্ত্বিক গড়নের পরিবর্তনে এই নৃগোষ্ঠী স্বকীয় বৈশিষ্ট্য ও বহুক্ষেত্রের নানা মনীষীর স্ব স্ব ক্ষেত্রে চিন্তার নব নব বিন্যাসে একটি উন্নত জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়।
প্রায় তিন দশকের স্বাধিকার ও সুপরিকল্পিত স্বাধীনতা আন্দোলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর তা একটি জাতিতে পরিণত হয়েছে, আর এ জাতিটি বাঙালি জাতি। অপরদিকে বাঙালি জাতি গঠনে নানা কাল-পর্বে অবদান রাখেন চর্যাপদের সিদ্ধসাধক, নাথ-যোগীতান্ত্রিক,মধ্যযুদের কবি-সাহিত্যিক, ভাবুক-চিন্তক, বাউল-বৈষ্ণব, কবিয়াল-বয়াতি ও লোকজ-সংস্কৃতির গুণীজন। এবং আধুনিককালের আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, চিত্তরঞ্জন দাস, নেতাজি সুভাষ বসু, একে ফজলুল হক, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ, মাওলানা ভাসানী, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ, আরও অনেকে। তবে ইতিহাসের গতিধারায় রাজনৈতিক উত্তুঙ্গ মুহূর্তের সৃষ্টি করে তাকে বাস্তবায়িত করার কৃতিত্ব বা সাফল্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগী রাজনীতিবিদদের।
পাকিস্তানি শাসক-শোষকদের ২৩ বছরের স্বৈরাচার, সামারিক জান্তার নানান ষড়যন্ত্র, কূটচক্রান্ত এবং বাঙালিদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে এঁদের ওই রাজনৈতিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে বাঙালি জাতিয়তাবাদী, অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের সর্বোচ্চ পর্যায়ে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির বৈধ অধিকারে বঙ্গবন্ধুর (১৯৭১’র ২৫ মার্চে পাকিস্তানী দখলদারের সশস্ত্র আক্রমণের পরপরই) বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর পাকিস্তানী হানাদার সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গ্রেফতার হন।
দীর্ঘ নয় মাস অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয় এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সকল ধর্ম-সম্প্রদায় ও খুদে জাতিসত্তার নবীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। গোটা এশিয়া বিশেষ করে ধর্মপ্রবণ ও শিক্ষাদীক্ষাহীন দারিদ্র পীড়িত দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরণের একটি ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক গণতান্ত্রিক জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নজির ইতিহাসে বিরল।
বঙ্গবন্ধুকে সঠিকভাবে চিনলেই বাংলাদেশকে চেনা হবে। বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র একজন ব্যক্তি নন। বঙ্গবন্ধু হচ্ছেন একটি পতাকা, একটি মানচিত্র, একটি দেশ, বাঙালি জাতীয়তার একটি মহাকাব্য, একটি আন্দোলন, জাতি নির্মাণের কারিগর, একটি বিপ্লব, একটি অভ্যুত্থান, একটি ইতিহাস, জাতির ধ্রুবতারা, রাজনীতির কবি, জনগণের বন্ধু, রাষ্ট্রের স্থপতি, স্বাধীনতার প্রতীক, ইতিহাসের মহানায়ক। তাই শুধু আওয়ামী লীগ নয় বাংলাদেশের সব গণতান্ত্রিক দলের শক্তির উৎস বঙ্গ-বন্ধুর নীতি ও আদর্শ- ‘সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা’ এর প্রয়াসে আওয়ামী লীগসহ দেশের সব গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাক্সিক্ষত সমাজ তথা রাষ্ট্র ও গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
লেখক পরিচিতি : অধ্যাপক মো. হাছান আলী সিকদার, সভাপতি, চাঁদপুর জেলা জাসদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্রনেতা, বাকশিস নেতা, চাঁদপুর জেলা।
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur