বঙ্গবন্ধু হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন

বাংলাদেশের যে স্থাপনাশৈলী এখনও বিমোহিত করে চলেছে অগণিত মানুষকে,তার মধ্যে আছে দেশজুড়ে থাকা অগণিত নয়নাভিরাম মসজিদ। বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ মসজিদগুলোর মধ্যে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ একটি।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বড় মসজিদটি কারুকাজখচিত দৃষ্টিনন্দন ঐতিহাসিক এ মসজিদে জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে মুসুল্লিরা আসেন নামাজ পড়তে। বিশেষ করে প্রতিবছর জুমাতুল বিদার নামাজ পড়তে এ মসজিদে সমাগম ঘটে লাখো নারী-পুরুষের।

ওই সময় মসজিদ চত্বর ছাড়িয়ে কাতার চলে যায় চাঁদপুর-কুমিল্লা মহাসড়ক পর্যন্ত। জানা যায়, স্থানীয় আহমাদ আলী পাটওয়ারী বঙ্গাব্দে ১৩২৫ যা ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দের দিকে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করে বিশাল সম্পত্তি ওয়াকফ করেন। ওই সম্পত্তিতেই গড়ে ওঠে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্স।

মসজিদের ৯ সদস্যের উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি হিসেবে আছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা। ইতিহাস ঘেঁটে জানা গেল,এ মসজিদের জুমার নামাজের আজান ও একামতের উদ্বোধনী দিবসে অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীসহ চারজন মন্ত্রী এসেছিলেন।

এ মসজিদে নামাজ পড়েছিলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জননেতা মাও. আব্দুল হামিদ খান ভাসানীসহ আরও অনেকে। বিভিন্ন সময় এসেছেন বরেণ্য আউলিয়ারাও।

জেলা শহর থেকে ২০ কি.মি. পূর্বে হাজীগঞ্জ উপজেলা সদরে অবস্থিত মসজিদটি মুসলিম স্থাপত্য শিল্পেরও অনন্য নিদর্শন। দ্বিতল মসজিদটির ভেতরে-বাইরের কারুকাজ নজর কাড়ে সবার। মসজিদের বিভিন্ন অংশে যে কারুকাজ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে,তা কালের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

জানা গেছে, তৎকালীন মোতাওয়াল্লি হাজী আহমাদ আলী এর নির্মাণকাজে কোনও প্রকৌশলীর পরামর্শ নেননি। এর পুরো নকশাটাই ছিল তার নিজস্ব চিন্তার ফসল। তাকে সহযোগিতা করেছিলেন শিল্পী আব্দুর রহমান ওস্তাগার।

মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানায়, ঐতিহাসিক মসজিদটি নির্মাণের এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। বঙ্গাব্দে ১১৭৫ থেকে ১২০০ সালের মধ্যে হজরত মকিমউদ্দিন (রহ.) নামে একজন ওলি ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব থেকে এ এলাকায় এসেছিলেন। তিনি সপরিবারে বর্তমান বড় মসজিদের মেহরাবসংলগ্ন স্থান, যেখানে একটু উঁচু ভূমি ছিল, সেখানে আস্তানা তৈরি করে বসতি স্থাপন করেন।

স্থানীয়দের কাছে তিনি শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। হাজি মকিমউদ্দিন (রহ.)-এর বংশধর হজরত মনিরুদ্দিন হাজি ওরফে মনাই হাজি (রহ.)-এর দৌহিত্র আহমাদ আলী পাটওয়ারী (রহ.)। বাংলা ১৩২৫ থেকে ১৩৩০ সালের দিকে বড় মসজিদের মেহরাব বা তৎসংলগ্ন স্থানজুড়ে প্রথমে একচালা খড়ের ইবাদতখানা তৈরি করেন তিনি। তারপর খড় ও গোলপাতা দিয়ে তৈরি করেন দোচালা মসজিদ। ওটাই পরে পাকা মসজিদ হয়।

১৩৩৭ বঙ্গাব্দের ১৭ আশ্বিন আহমাদ আলী পাটওয়ারীর ইচ্ছায় হজরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী (রহ.) এর হাতে পাকা মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। মসজিদ কর্তৃপক্ষ জানান, মসজিদটি তিন অংশে নির্মিত। প্রথম অংশ ৪ হাজার ৭ শ ৮৪ বর্গফুট। মাঝের অংশ ১৩ হাজার ৬ বর্গফুট এবং তৃতীয় অংশে ১ হাজার ৬ শ ১৫ বর্গফুট।

মোট ২৮ হাজার ৪ শ ৫ বর্গফুট। মসজিদটির প্রথম অংশে হজরত মাওলানা আবুল ফারাহ জৈনপুরী নিজ হাতে চুন-সুরকি কেটে মেহরাবসংলগ্ন দেয়ালে ‘সুরা ইয়াছিন’ ও ‘সুরা জুমআ’ লিপিবদ্ধ করেন। সংস্কারকালে অবশ্য ওগুলো উঠিয়ে ফেলা হয়। মেহরাবে কাচের ঝাড়ের টুকরো নিখুঁতভাবে কেটে মনোরম ফুলের ঝাড়ের নকশা করা হয়েছে। মাঝের অংশটি ৭৭ টি আকর্ষণীয় পিলার ও ঝিনুকের মোজাইক দিয়ে নির্মিত। তৃতীয় অংশে রয়েছে তিনটি বিশাল গম্বুজসহ সুউচ্চ মিনার।

১৯৫৩ সালে ১২২ ফুট উঁচু এ মিনার তৈরি হয়। পূর্ব প্রাচীরে পবিত্র কালেমা শরিফ খচিত চীনা বাসনের টুকরো দিয়ে তৈরি ফুলের ঝাড়ের মতো করে সাজানো বিশাল ফটক আছে। পাথরে সজ্জিত অসংখ্য তারকাখচিত তিনটি বড় গম্বুজ পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সুউচ্চ মিনারটিরও আলাদা বৈশিষ্ট্য রয়েছে। মিনারের উঁচু প্ল্যাটফর্মে উঠে বহু মুসুল্লি ও পর্যটক হাজীগঞ্জের চারপাশ দেখতে পান।

প্রতি ওয়াক্তে এ মসজিদ থেকে যে আজান দেয়া হয় তা’ উপজেলার বিভিন্ন স্থানে থাকা ৪৬টি মাইকে শোনা যায়। বর্তমানে হাজীগঞ্জ বড় মসজিদ কমপ্লেক্সের অধীনে রয়েছে আবাসিক ও অনাবাসিক মাদ্রাসা ও এতিমখানা। এর মধ্যে রয়েছে আহমাদিয়া কামিল মাদ্রাসা, মুনিরিয়া নুরানি মাদ্রাসা, ফোরকানিয়া মাদ্রাসা, এতিমখানা, লিল্লাহ বোর্ডিং।

এ ছাড়া মসজিদের অর্থ যোগানের জন্য স্থায়ী আয়ের উৎস হিসেবে রয়েছে মার্কেট-দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আছেন ১শ ৭০ জন স্টাফ। ঐতিহাসিক মসজিদটির প্রথম মোতওয়াল্লি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন প্রতিষ্ঠাতা আহমাদ আলী পাটওয়ারী। তাঁর মৃত্যু পর দায়িত্ব পায় তার তৃতীয় পুত্র মো.মনিরুজ্জামান পাটওয়ারী এবং তাঁর মৃত্যুর পর মোতওয়াল্লির দায়িত্ব নেন বড় ছেলে ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী।

ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারী জানান,নিরবচ্ছিন্ন অজুর পানি,পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা, পর্যাপ্ত আলো ও বাতাসের ব্যবস্থা,ওয়াজ-মাহফিলসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা,রমজান মাসে রোজাদারদের জন্য ইফতারের ব্যবস্থা,ইতেকাফকারীদের সেবা প্রদান,বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা-এসব চালিয়ে যাচ্ছি।

মাদ্রাসাগুলোর সংস্কার,উন্নয়ন,রক্ষণাবেক্ষণসহ যে কোনও দুর্যোগে স্থানীয় পর্যায়ে সামাজিক কার্যক্রমেও সাধ্যমত মসজিদের পক্ষ থেকে আর্থিক সহযোগিতা করা হচ্ছে। বর্তমানে ভার-প্রাপ্ত মোতওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করছেন ড.মো.আলমগীর কবির পাটওয়ারীর জ্যেষ্ঠ্যপুত্র প্রিন্স শাকিল আহমেদ।

লেখক: ইব্রাহীম রনি ( সূত্র : প্রবন্ধ ও ছবি ওয়েবসাইড থেকে সংগৃহীত)
সম্পাদনায় : আবদুল গনি,১১ আগস্ট ২০২৩।

Share