ফিচার

বঙ্গবন্ধুর ঈদ উদযাপন

হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন বাংলাদেশের আর দশজন সাধারণ মানুষের মত ছিল না। তাই অন্য সবার মতো তিনি ঈদ উদযাপন করতে পারেননি। কারণ জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি জেলহাজতে কাটিয়েছিলেন। তাঁর জীবনের ৪ হাজার ৬৮২ দিন জেলে কেটেছে। ফলে বঙ্গবন্ধুর অনেক ঈদ কেটেছে জেলের ভেতর কয়েদি হিসেবে।

পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করার সুযোগ তিনি কমই পেয়েছেন। বঙ্গবন্ধুর জীবন নিয়ে অসংখ্য গবেষণা হলেও তাঁর ঈদ উদযাপন নিয়ে আমি তথ্যসমৃদ্ধ কোনো লেখা পাইনি। অনেকের লেখার মধ্যে বিচ্ছিন্নভাবে শেখ মুজিবুর রহমানের ঈদ উদ্যাপনের প্রসঙ্গ আছে। বঙ্গবন্ধু নিজেও স্মৃতিকথায় লিখেছেন তাঁর দু-একটি ঈদ পালনের কথা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৭ সালে জেলে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা পালন করেন। ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘১১ তারিখে রেণু এসেছে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেখা করতে। আগামী ১৩ই জানুয়ারি ঈদের নামাজ। ছেলেমেয়েরা জামা-কাপড় নেবে না। ঈদ করবে না, কারণ আমি জেলে।

ওদের বললাম, তোমরা ঈদ উদযাপন কর।’ তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘চিন্তা করিও না। জীবনে বহু ঈদ এই কারাগারে আমাকে কাটাতে হয়েছে, আরও কত কাটাতে হয় ঠিক কি! তবে কোনো আঘাতই আমাকে বাঁকাতে পারবে না। খোদা সহায় আছে।’ ‘বাচ্চাদের সবকিছু কিনে দিও। ভাল করে ঈদ করিও, না হলে ওদের মন ছোট হয়ে যাবে।’ জেলে বন্দি থাকার কারণে শেখ মুজিবুর রহমানকে সেবছর পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে ১দিন আগে অর্থাৎ ১২ জানুয়ারি ঈদ পালন করতে হয়েছিল। অথচ সেবার পরের দিন অর্থাৎ ১৩ জানুয়ারি পূর্ববাংলার মানুষ ঈদ উদযাপন করেছিল।

বঙ্গবন্ধু হয়ত ভাবতেন ‘পূর্ব বাংলার লোক সেইদিনই ঈদের আনন্দ ভোগ করতে পারবে, যেদিন তারা দাসত্ব থেকে মুক্তি পাবে, এবং দেশের সত্যিকার নাগরিক হতে পারবে।’ কারণ তিনি ঠিকই জানতেন, পরাধীন জাতি কখনও ঈদের আনন্দ করতে পারে না। উক্ত গ্রন্থে ঈদুল আযহার কথাও আছে। সেদিন ছিল ২২ মার্চ, বুধবার। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘আজ কোরবানির ঈদ। গত ঈদেও জেলে ছিলাম। এবারও জেলে। বন্দি জীবনে ঈদ উদযাপন করা একটি মর্মান্তিক ঘটনা বলা চলে।

বারবার আপনজন বন্ধু-বান্ধব, ছেলেমেয়ে, পিতামাতার কথা মনে পড়ে।…আমি তো একলা থাকি। আমার সাথে কোনো রাজনৈতিক বন্দিকে থাকতে দেয় না। একাকী কি ঈদ উদযাপন করা যায়?’ যদিও এমন বেদনার মধ্য দিয়েও বঙ্গবন্ধুকে ঈদের দিন পালন করতে হয়েছে।

১৯৬৭ সালের দু বছর পর ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধুর ঈদ পালন করতে তাঁর গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় গিয়েছিলেন। সেসময় তাঁর মা সায়েরা খাতুন অসুস্থ ছিলেন। বাংলাদেশের প্রথম সারির একজন কবি ও লেখক নির্মলেন্দু গুণ লিখেছেন, ‘২৭ ফেব্রæয়ারি রাতে তিনি গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত তাঁর অসুস্থ মায়ের সঙ্গে ঈদ পালন করার জন্য স্ত্রী-পুত্র-কন্যাদের নিয়ে টুঙ্গিপাড়ায় যান। তেত্রিশ মাস একনাগাড়ে কারাবন্দী থাকার কারণে বিগত ছয়-ছয়টি ঈদ উৎসবের আনন্দ থেকে তিনি ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বঞ্চিত থেকেছে। অনেকদিন পর বঙ্গবন্ধু পরিবারে ফিরে এসেছে ঈদের আনন্দ। ঐ পরিবারের ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে পড়েছে দেশের মানুষের মনে।’

১৯৭১ সালেও প্রতিবছরের ন্যায় ঈদ এসেছিল বাংলাদেশে। এ বছরের ২০ নভেম্বর ঈদুল ফিতর পালিত হয়। কিন্তু স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা বাঙালিদের জন্যে ঈদের দিনটি ছিল নিঃসন্দেহে বেদনায় ভরা। হানাদার পাকিস্তানিদের নৃশংসতায় বাংলার আকাশ-বাতাস তখন ক্ষত-বিক্ষত, রক্তাক্ত।

ঈদের আগের দিন ১৯ নভেম্বর সাপ্তাহিক জয়বাংলার ২৮তম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যাটি ঐতিহাসিকভাবে বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ, এ সংখ্যায় ঈদ উপলক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাণী দিয়েছিলেন। পত্রিকাটির সম্পাদকীয় কলামে তাঁর বাণীটি প্রকাশিত হয়। বাণীর শিরোনাম ছিল ‘উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ’। তিনি তাঁর বাণীর একাংশে লিখেছেন, ‘আমি নিজেকে বাঙালী ভাবতে গর্ববোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারাও বেগবতী ও প্রাণাবেগপূর্ণ।

আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালী আবার বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে।’ বঙ্গবন্ধু তখন পাকিস্তানের জেলখানায় বন্দী ছিলেন। তাঁকে সেসময় লায়ালপুরের কারাগারে রাখা হয়। স্বাভাবিকভাবেই ২০ নভেম্বরের সেই ঈদ ছিল তাঁর জন্য অসহনীয় কষ্টের। কারণ, যে কোনো মুহূর্তে তাঁর মৃত্যু হতে পারে।

সেদিন সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মৃত্যুদণ্ডের অপেক্ষায় থাকা বন্দির অন্তিম ইচ্ছাপূরণের মতো জেলার আমাকে কিছু ফল পাঠিয়েছিলেন। ঈদের নামে এটা এক ধরণের রসিকতাও হতে পারে। কিন্তু আমার আবারও মনে পড়ে গেল দেশে আমার জনগণের কথা এবং বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো আমার হৃদয়। মনে পড়লো ২৫ মার্চ রাতের নিষ্ঠুর দৃশ্য, যখন বলপূর্বক আমাকে বিচ্ছিন্ন করে নেয়া হলো বাংলাদেশ থেকে এবং অন্তরে রক্তক্ষরণ শুরু হলো।

আমার প্রিয় জনগণ কীভাবে তাদের ঈদ উৎসব পালন করছে? এই প্রশ্ন আমি করলাম, জানি না কাকে! সেই দিন, আবার কখনো তাদের দেখা পাবো কি না সেটা না জেনেই, আমি মোনাজাত করে আমার জনগণের মঙ্গল ও নিরাপত্তা দয়াময় আল্লাহতালার হাতে সমর্পণ করলাম।

এটাই ছিল আমার ঈদ।’ ইনিই হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়েও তাঁর জনগণের কথা ভাবেন, ভাবেন তাঁর জনগণ কীভাবে ঈদ করছে! সেজন্যই তিনি বাঙালির মহকালের মহানায়ক, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
রাজনীতি ও মানুষের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর বেশিরভাগ সময় কেটেছে জনতার সাথে। সেজন্য পরিবারকে তিনি ভালোভাবে সময় দিতে পারেননি। তাই যেবার তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে ঈদ করতেন সেবার তার পরিবারে আনন্দের জোয়ার বয়ে যেত।

বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ রেহানা তাঁর শৈশবের ঈদের স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন, ‘ছোটবেলায় দেখতাম, আব্বা প্রায়ই থাকতেন জেলখানায়। আমাদের কাছে ঈদ ছিল তখন, যখন আব্বা জেলখানার বাইরে থাকতেন, মুক্ত থাকতেন। আর আব্বাও জেলখানার বাইরে, ঈদও এল, এমন হলে তো কথাই নেই। আমাদের হতো ডাবল ঈদ।’

অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জেলে থাকলে পরিবারের ঈদ কেমন হতো তা নিয়েও লিখেছেন শেখ রেহানা। তিনি লিখেছেন, ‘আব্বা জেলে থাকলে তো আমাদের ঈদ বিশেষ কিছু ছিল না। কাপড়চোপড়ও তো নতুন তেমন কিছু আসত না।’ ঈদের দিন শেখ মুজিবুর রহমান কী কী করতেন তাঁর বর্ণনাও পাওয়া যায় শেখ রেহানার লেখায়।

তিনি জানাচ্ছেন, ‘ঈদের দিন আব্বা, ভাইয়েরা, বাসায় আর যাঁরা যাঁরা আছেন ছেলেরা, সবাই সকালবেলা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে ঈদের নামাজ পড়তে গেল।… আব্বা নামাজ পড়তেন সোবহানবাগ মসজিদ বা ধানমন্ডি মসজিদে।

তারপর সোবহানবাগে আমাদের ছোট ফুপু লিলি, সৈয়দ হোসেন ফুপার বাড়িতে গিয়ে সবাই নাস্তা করতেন। নাশতা সেরে সেখান থেকে চলে আসতেন বাসায়। ফুপুরাও চলে আসতেন, সবাই মিলে আমাদের বাসাতেই কাটাতেন ঈদের দিনের বাকি সময়টা।’

স্বাধীন বাংলাদেশে ঈদ-উল আজহা উদযাপন নিঃসন্দেহে ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশে তখন স্বাধীনতার পতাকা উড়ছে। বাঙালিরা ভেঙে ফেলেছে শত বছরের বন্দীর শেকল। যেহেতু সদ্য মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়েছে, দেশ গড়ার কাজ চলছে তাই পুরোদমে।

তাই ১৯৭২ সালের ঈদ ভিন্ন মাত্রা নিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে হাজির হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যে বাণী দিয়েছিলেন তাতে লিখেছেন, ঈদুল আজহা আমাদের আত্মত্যাগের আদর্শ শিক্ষা দেয়। বাংলাদেশের সাহসী মানুষ দেশকে স্বাধীন করার জন্য সম্পদ ও রক্ত দিয়ে চরম আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন। তিনি চরম আত্মত্যাগের মনোভাব নিয়ে ঈদুল আজহা উদযাপন করার আহŸান জানান।

১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম ঈদ। বেশিরভাগ সময় তিঁনি ধানমন্ডি মাঠে নামাজ পড়তেন। তখন তিনি কোনো প্রটোকল রাখতেন না। জনতার মাঝে বঙ্গবন্ধুর ঈদের নামাজ পড়তেন। নামাজ শেষ হওয়ার সাথে সাথে উপস্থিত মানুষজন তাঁর সাথে কোলাকুলির মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করত।

সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিবেশীদের সাথে ঈদ-আনন্দ ভাগ করে নিতেই বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর পিতার মত সাধারণভাবে ঈদ উদযাপন করতে পছন্দ করেন। জননেত্রীর ঈদের সময় কাটে তাঁর পরিবার-পরিজন ও বাংলার জনগণের সাথে।

তাঁর ঈদের দিন সকাল শুরু হয় সর্বোস্তরের জনগণের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময়ের মধ্য দিয়ে। তারপর গণভবনে আসা অতিথিদের সাথে তিনি সকালের নাস্তা করেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী হয়েও ঈদ আনন্দ ছড়িয়ে দেন বাংলাদেশের জনগণ ও দলীয় কর্মীদের মাঝে। পিতার আদর্শই গ্রহণ করে দেশ পরিচালনা করছেন তিনি।

কদিন পরই আমরা ঈদুল ফিতর পালন করবো। সেই দিনকে সামনে রেখে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান শেখ মুজিবের প্রতি আমরা গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। কারণ বঙ্গবন্ধু কেবল জনগণকে আত্মত্যাগ করতে বলেননি, তিনি নিজেও সারাজীবন আত্মত্যাগ করে গেছেন। সেই শৈশব থেকে আমৃত্যু সাধারণ মানুষের কল্যাণে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। তাই তো তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি।

তিনি স্বপ্ন দেখতেন ক্ষুধা, দারিদ্রমুক্ত অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের। আসুন আমরা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে উদ্ভাসিত হই। পবিত্র ঈদে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সফল করার শপথ নেই এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে সোনার বাংলাদেশ গঠনে সহযোগিতা করি। ঈদ বাংলাদেশের জন্য কল্যাণ বয়ে আনুক, আপামর মানুষের মুখে হাসি ফোটাক এই কামনা করছি।
জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক- অধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ হাসান খান।
সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ,
চাঁদপুর জেলা।

Share