জাতির জনক ‘বঙ্গবন্ধুর কফিন যখন খোলছে তখন দেখছি বুকটা একদম ঝাঁঝড়া হইয়া গেছে। পিছন দিয়া ভোগলা বাইরা গেছে। মুখমণ্ডল চেহারা ভালো ছিলো। আমরা সেই ৫৭০ সাবান দিয়া গোসল করাইছি। শাড়ি, রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালতে আইনা। ওই কাপড়ের পাইড় ছিঁড়া ফালাই দিছি। ওই কাপড় দিয়া জানাজা দিছি।’
নিজের আঞ্চলিক ভাষায় এভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মরদেহ ও দাফনের বর্ণনা দিচ্ছিলেন গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার তৎকালীন দুই বাসিন্দা।
টুঙ্গিপাড়ার বাসিন্দা মো. আনোয়ার হোসেন বলছিলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর কফিন যখন খোলছে তখন দেখছি বুকটা একদম ঝাঝড়া হইয়া গেছে। পিছন দিয়া ভোগলা বাইরা গেছে। মুখমণ্ডল চেহারা ভালো ছিলো। জামা গায়ে ছিলো। পাঞ্জাবি ফুটা হইয়া পিছন দা (দিয়ে) বাইর অইয়া (বাহির হয়ে) গেছে। পিছনে বড় বড় ফুটা ছিল।’
১৯৭৫ সালে ৩৫ বছর বয়সী আনোয়ার হোসেন ১৯৭৫ সালে টুঙ্গিপাড়া পোস্ট অফিসে মাস্টারের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যার স্বীকার একজন রাষ্ট্রপতির দাফনের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু একজন দেশের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। কিন্তু আমার এমন ভাইগ্য, যে তার একটা ভালো কাপড় কিনতে যাব। তাও আর্মিরা যাইতে দেয় নাই। আমরা সেই রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালের শাড়ির কাপড়। রিলিফের কাপড় এবং সাবান। ৫৭০ সাবান দিয়া গোসল করাইছি। কিন্তু আমাদেরকে আর্মিরা বাহিরে কোন কাপড়-চোপড় কিনতে যাইতে দেয় নাই। আমরা সেই ৫৭০ সাবান দিয়া গোসল করাইছি। শাড়ি রেড ক্রিসেন্ট হাসপাতালতে আইনা। ওই কাপড়ের পাইড় ছিঁড়া ফালাই দিছি। ওই কাপড় দিয়া জানাজা দিছি। কিন্তু পাটগাছী বাজার ছেলো ওখানে। কাপড় আনতে যাইত চাইছি। যাইতে দেয় নাই আমাদেরকে।’
বঙ্গবন্ধুর দাফনে অংশ নেওয়া টুঙ্গিপাড়ার আরেক বাসিন্দা কাজী ইদ্রিস আলী। ১৯৭৫ সালে ৩০ বছর বয়সী এই যুবক রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির এমএলএসএস হিসেবে কাজ করতেন। স্থানীয় বাসিন্দা হিসেবে এবং কর্মস্থলের সুবাদে বঙ্গবন্ধুর প্রতিবেশী ছিলেন তিনি। সেই দুঃসময়ের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লাশ গোপালগঞ্জে পৌঁছানোর পরবর্তী ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ক্ষোভে ফেটে পড়েন তিনি।
কাজী ইদ্রিস আলী বলছিলেন, ‘হেলিকপ্টার আস্তে আস্তে আইসা নামলো। আর্মিরা নাইমা সব পজিশনে গেলো। হেরপরে এক ধরনের হুইসেল দিল। দেওয়া পর আস্তে সব কাছালাম। আইসা আমগোরে ডাক দিলো, আসেন আপনাদের লাশ নিয়া যান। আমরা যাইয়া লাশ ধরলাম সবাই। লাশ ঘাড়ে করলাম। এই খানে একটা কাডের (কাঠের) পুল ছিল। ঘাড়ে কইরা কাডের পুল দিয়া যাইয়া উনার উঠানে নিয়া নামালাম। নামানোর পর এখন কফিন তো আমরা খুলতে পারি না। তখন ঐখানে ছিল আবদুল হালিম মিস্ত্রি। তাকে ডাইক্কা আনা হলো। এটা ভাঙার পরে দেখলাম, বড় একটা সাদা কাপড়ে ঢাকা। ঐটা ফেলে দিলাম। ফেলে দেয়ার পরে দেখি বরফের বড় বড় চাকা দেয়া। আর রক্ত একাবারে জমে গেছে। চেকের পাঞ্জাবি পড়া আছে। সেন্ডো গেঞ্জি গায়ে আছে। চশমা ভাইঙা ডাইনদা পড়ে আছে। পাইপ একটা ছিলে পকেটের মাঝে তা বাইর করলাম। বাইর করার পরে কয়, তাড়াতাড়ি গোসল দেন। ঐখানে পানি আছেলে (পানি ছিলো), ঐ পানি দিয়া সুন্দর করে ধুইয়া ধুইয়া পরিষ্কার করলাম। এখন সাবানের প্রশ্ন। ৫৭০ সাবান নিয়া আসলাম।’
আক্ষেপ করে বললেন, ‘জাতির জনককে গোসল দিলাম সেই ৫৭০ সাবান দিয়া। সেই ৫৭০ সাবান দিয়া গোসল দিয়া পরে দাফন-কাফন করে দিলাম। শাড়ি ছিলো রোগীদের ঐয়া ছিঁড়া দাফনের কাপড় বানাইয়া ঐ দিয়া উনারে দাফনে দিলাম।’ (সূত্র-জাগোনিউজ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ০৭:০০ এএম, ১৫ আগস্ট ২০১৬, সোমবার
ডিএইচ