ফেসবুক স্ট্যাটাসেই জীবন গেলো বিএনপি নেতা বাবুলের

১৫ বছর ধরে বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন বাবুল সরদার। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, নিজ দলের লোকজনের হাতেই জীবন গেল বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দলের ধানমন্ডি থানা শাখার এই সভাপতির।
বিএনপির একজন কেন্দ্রীয় নেতাকে জড়িয়ে নিজের ফেসবুক পেজে দেয়া একটি স্ট্যাটাস বাবুলের জন্য কাল হলো বলে জানিয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ নেতাকর্মীরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দলের মিটিং-মিছিল, আন্দোলন-সংগ্রামে সবার আগে থাকতেন বাবুল। বেশ কয়েকবার জেল খেটেছেন। আন্দোলন-সংগ্রাম করতে গিয়ে জড়িয়ে পড়েছেন ১৫টির মতো মামলায়। এসব মামলা চালানোর মতো সংগতি না থাকায় ফেরার জীবন বেছে নেন। মৃত্যুর আগ পর‌্যন্ত ফেরারি ছিলেন বাবুল।

জীবনের সব উপার্জন সংগঠনের পেছনে ঢেলে দেয়া বাবুল ধানমন্ডি থানা শ্রমিক দলের নেতাকর্মীদের প্রিয়মুখ ছিলেন। কিন্তু তার এই পথচলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায় ফেসবুকে তার একটি স্ট্যাটাস। জীবন দিয়ে মূল্য দিতে হলো এর। নিজ দলের সুবিধাবাদী নেতাকর্মীদের হাতেই প্রাণ দিতে হয়েছে মর্মান্তিকভাবে।

গত রবিবার (১৫ মে) বিএনপির নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার‌্যালয়ে জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল মহানগর শাখার উদ্যোগে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকার রোগমুক্তি কামনায় মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়। গ্রেপ্তারের ভয় থাকলেও দলের নেতার মিলাদে তা বাধা হয়নি বাবুলের কাছে। নেতাকর্মীদের নিয়ে যথাসময়ে হাজির হন নয়াপল্টনে। কিন্তু বিধি বাম! মিলাদ শেষে পুলিশের হাত থেকে বাঁচতে আর ফেরারি হতে হয়নি,চিরদিনের জন্য পৃথিবী থেকে ফেরার হয়ে গেলেন এই শ্রমিকনেতা।

সেদিন বাদ আছর মিলাদ শেষে ফিরে যাওয়ার সময় নয়াপল্টনের সড়কে অতর্কিত হামলা হয় বাবুলের ওপর। মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পাওয়ায় তাকে নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। পরে মোহাম্মদপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করা হয়েছে।

অন্য দলের হাতে কেউ নিহত হলে দল ও সংগঠনের পক্ষ থেকে নিহতের পরিবারের খোঁজ নেয়া হয়, কিন্তু বাবুলের ক্ষেত্রে তেমনটি হয়নি বলে জানা যায়নি।

এদিকে অকালে স্বামীকে হারিয়ে দুটি অবুঝ সন্তান নিয়ে বাকরুদ্ধ বাবুলের স্ত্রী সাজেদা বেগম। কী অপরাধে বাবুলকে জীবন দিতে হয়েছে সেই প্রশ্ন সাজেদার। কিন্তু কারও কাছে এর উত্তর নেই।

বিএনপির নেতাকর্মীরা জানান, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ শ্রমিক দল গত মাসের ২৮ এপ্রিল ধানমন্ডি থানার ৫১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি ঘোষণা করে। এরপর থেকেই ওই এলাকার বিএনপির কেন্দ্রীয় মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম কমিটির বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকেন। তার আক্ষেপ ছিল- নিজের অনুগতদের দিয়ে এই কমিটি গঠন করা হয়নি। মূল দলের বিভিন্ন পর্যায়ে তিনি এই কমিটি বাতিল করার জন্য দেনদরবারও করেন বলে জানা গেছে।

শেষ পর‌্যন্ত শ্রমিক দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নূরুল ইসলাম নাসিম কমিটি ভেঙে দিতে গঠনতন্ত্রের বিধি লঙ্ঘন করে অযাচিত হস্তক্ষেপ করারও চেষ্টা করেন বলে জানা গেছে। ততক্ষণে বিষয়টি বাবুল সরদার অবগত হন।

ক্ষুব্ধ বাবুল তার ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস লিখেন- “বিএনপির মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীম দলের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব হতে না পেরে এখন আমার পদটা নিয়েই কাড়াকাড়ি করছেন। তিনি যদি আমার পদটা নিতেই চান তাহলে আমাকে বললে আমি স্ব-ইচ্ছায় পদটি তাকে ছেড়ে দিব।”

কমিটি নিয়ে নাসির উদ্দিন অসীমের ক্ষোভের বিষয়টি স্বীকার করেছেন নূরুল ইসলাম নাসিম। তবে তিনি নিজের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেন।

নাসির উদ্দিন ঢাকাটাইমসকে বলেন, “বাবুল সরদার আমাদের সক্রিয় একজন নেতা ছিলেন। এখন আমরা শিগগিরই কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠক ডেকে তার পরিবারের জন্য কী করা যায় সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।”

জানা গেছে, এই স্ট্যাটাস দেয়ার পর থেকে বাবুলকে বিভিন্নভাবে হুমকি-ধমকি দেয়া হয়। একপর‌্যায়ে বাবুল বিষয়টি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের অবহিত করেন। কিন্তু তা কোনো কাজে আসেনি।

বাবুল সরদার মারা যাওয়ার দুই দিন আগে অর্থাৎ ১৩ মে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খানের অনুরোধে তিনি তার স্ট্যাটাসটি মুছে ফেলেন। কিন্তু তাতে হুমকি থামেনি। একপর‌্যায়ে তাকে প্রাণনাশেরও হুমকি দেয়া হয় বলে জানা যায়।

এই হুমকির কারণে বাবুলকে মিলাদে অংশ না নেয়ার জন্য বলছিলেন তার শুভাকাঙ্ক্ষীরা। কিন্তু ‍তা আমলে নেননি রাজনীতি-অন্তঃপ্রাণ এই শ্রমিকনেতা।

অন্যদিকে মিলাদের মতো কর্মসূচিতে হামলার আশঙ্কা না থাকলেও নেতাকর্মীরা তাকে ঘিরে রেখেছিলেন। সবকিছু ঠিকঠাক শেষ হলেও নয়াপল্টন এলাকা ছাড়ার সময় ওত পেতে থাকা বিরোধী নেতাকর্মীরা বাবুলের ওপর হামলা করে। চাপাতির আঘাতসহ তাকে এলোপাতাড়ি পিটিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা হয়।

এ সময় বাবুলের সঙ্গে থাকা ধানমন্ডি শ্রমিক দলের সাধারণ সম্পাদক আবু কায়সার ভূঁইয়াসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। মাথায় প্রচণ্ড আঘাতপ্রাপ্ত বাবুল ওই দিন রাতে মারা যান।

পরে বাবুল সরদারের স্ত্রী সাজেদা বেগম ব্যারিস্টার নাসিরউদ্দিন অসীমকে হুকুমের আসামি করে ধানমন্ডি শ্রমিক দলের সিনিয়র সহসভাপতি শহিদুল্লাহ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের শ্রমিক দলের যুগ্ম সম্পাদক বদরুল আলম সবুজসহ ১০ জনের নাম উল্লেখ করে এবং ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আসামি করে পল্টন থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।

নাসির উদ্দিন অসীম লন্ডনে অবস্থান করায় এ বিষয়ে তার সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

ধানমন্ডি থানা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাবুল সরদারের মতো কর্মীদের মাধ্যমে ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম এই এলাকায় পরিচিতি লাভ করেছিলেন। বাবুল তার ব্যানার, ফেস্টুন, পোস্টার দেয়ালে-দেয়ালে লাগাতেন। কিন্তু তিনি (অসীম) কর্মীবান্ধব নেতা না হওয়ায় বাবুল তার সঙ্গ এড়িয়ে চলতে শুরু করেন। এরপর নিজের মতো করেই রাজনীতির পথচলা শুরু করেন। তখন থেকেই বাবুল বিরাগভাজন হন নাসিরের।(ঢাকা টাইমস)

 

Share