প্রথমবারের মতো ব্যবহারকারী হারিয়েছে ফেসবুক। সংখ্যাটিও বেশ বড়। মেটাভার্স নিয়ে অনেক হইচই হলেও কোম্পানির দাম পড়েছে রেকর্ড পরিমাণ। অনেকে বলছেন, এটাই কি তাহলে ফেসবুকের শেষের শুরু?
গত বৃহস্পতিবার শেয়ারবাজারে ফেসবুকের মালিক প্রতিষ্ঠান মেটা প্ল্যাটফর্মস ২৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি বাজারমূল্য হারিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো কোম্পানি ওয়াল স্ট্রিটের ইতিহাসে একদিনে এতো দরপতন কখনো দেখেনি। গত বছরের শেষ প্রান্তিকের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশের পরপরই বিনিয়োগকারীরা এতোটাই হতাশ হয়ে পড়েন যে শেয়ারের দাম এক ধাক্কায় ২৬ দশমিক ৪ শতাংশ পড়ে যায়।
মেটার আর্থিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ১৮ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ফেসবুকের দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারী কমেছে। ২০২১ সালের তৃতীয় প্রান্তিকে সাইটটির দৈনিক সক্রিয় ব্যবহারকারী ছিল ১৯৩ কোটি। আর চতুর্থ প্রান্তিকে সেই সংখ্যাটি ১৯২ কোটি ৯০ লাখে নেমেছে।
করোনা মহামারীর মধ্যে যেখানে ইন্টারনেটে মানুষের বিচরণ বেড়েছে, অন্য অনেক প্ল্যাটফর্মের ট্রাফিক বেড়েছে, সেখানে ফেসবুকের মতো জনপ্রিয় সামাজিক মাধ্যমের ব্যবহারকারী উল্টো কমে গেল! মানুষ কেন এই সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহার করা ছেড়ে দিচ্ছে সেটি সত্যিই অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
ফেসবুক এতোটাই জনপ্রিয় যে কেউ জীবনে কখনো ব্যবহার না করলেও ফেসবুক সম্পর্কে ঠিকই জানেন। বিশ্বের বৃহৎ সামাজিক যোগাযোগ নেটওয়ার্কগুলোর মধ্যে প্রধান এটি। প্রায় প্রতিটি দেশেই এর ব্যবহারকারী রয়েছে। দীর্ঘ দিন ধরে যেভাবে দাপটের সঙ্গে এর বাড়বাড়ন্ত চলছে, তাতে মানুষের মধ্যে একটি ধারণা প্রায় বদ্ধমূল হয়ে গেছে যে, এ সাইটের পতন অসম্ভব। বরং দিন দিন শক্তিবৃদ্ধিই ঘটবে।
ফেসবুকের এই অধোগতিতে প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিঃসন্দেহে খুশি। বলতে গেলে কিছু প্রতিদ্বন্দ্বীই ফেসবুকের ব্যবহারকারী ভাগিয়ে নিয়ে গেছে। তারা ওই প্ল্যাটফর্মেই পরিপূর্ণভাবে লেগে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ফেসবুকের ব্যবহারকারী কমে যাওয়ার পেছনে এমন চারটি কারণ চিহ্নিত করা যেতে পারে।
টিকটকের রাজত্ব
শর্ট ভিডিও শেয়ারিংয়ের প্ল্যাটফর্ম টিকটক এখন অন্যতম প্রভাবশালী সোশ্যাল মিডিয়া। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে টিকটক দাবি করেছিল, এই প্ল্যাটফর্মে ১০০ কোটির বেশি ব্যবহারকারী রয়েছে।
২০২২ সালের গোড়ার দিকে ফেসবুকের সিইও মার্ক জাকারবার্গ স্বীকার করেছিলেন, তাঁর কোম্পানির অন্যতম প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে টিকটক। শুধু তাই নয়, তাঁর উদ্বেগ ও বিগত বেশ কিছু পদক্ষেপে স্পষ্ট টিকটককে ফেসবুক কতো বড় হুমকি বলে মনে করছে। ফেসবুক স্বল্প দৈর্ঘ্যের ভিডিওর বাজার ধরতে নানা চেষ্টা করছে। বড় লেখা ভিত্তিক ও ব্যবহারকারীর স্ট্যাটাস নির্ভর কনটেন্ট আকর্ষণের কৌশলে বৈচিত্র্য আনতে ‘রিলস’ নামে ফিচার এনেছে।
জাকারবার্গ বলেছিলেন, ‘টিকটক এরই মধ্যে বড় প্রতিযোগী হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে। তারা বেশ বড় ইউজার বেস নিয়ে দ্রুত হারে প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে। যদিও আমরা খুব দ্রুত এবং চক্রবৃদ্ধি হারেই বড় হচ্ছি। কিন্তু আমাদের একটি প্রতিযোগীও আমাদের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলছে।’
কিশোর-তরুণরা আগ্রহ হারাচ্ছে
কিশোর-কিশোরী আর তরুণ-তরুণীরা এখন টিকটকে ভিড় করছে। টিকটকে ঘণ্টাখানেক ঢুঁ মারলেই সেটি বোঝা যায়। অবশ্য তাদের পছন্দের তালিকায় ফেসবুকের ওপরে রাখা একমাত্র প্ল্যাটফর্ম এটি নয়। শিশু-কিশোররা এখন ফেসবুকের চেয়ে ফোর্টনাইট এবং রবলক্সের মতো গেম বা ডিসকর্ডের মতো প্ল্যাটফর্মেই বেশি সময় দিচ্ছে।
ফেসবুককে এখন পুরোনো প্রজন্মের জন্য পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে দেখা যেতে পারে। শিশুরা বরং ভিডিও গেমে মজে থাকছে। সেখানে দেখে দেখে কল্পিত থ্রিডি বিশ্বে বুঁদ হয়ে থাকতেই পছন্দ করছে। ওই সব প্ল্যাটফর্মেই তারা এখন বন্ধুদের সঙ্গে চ্যাট করতে পারে। তাদের মজার মজার অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে পারে, এক সঙ্গে মজার কোনো উপলক্ষ্য উপভোগ করতে পারে।
বিষয়টি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ ভেতরে ভেতরে স্বীকার করে এবং এ নিয়ে তাদের উদ্বেগও বাড়ছে। প্রযুক্তি পত্রিকা দ্য ভার্জের একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফেসবুকের গবেষকরা বিশ্বাস করেন যে ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২২ সালে কিশোর ফেসবুক ব্যবহারকারী ৪৫ শতাংশ কমবে।
সম্প্রতি একটি নামি কোম্পানির অভ্যন্তরীণ প্রেজেন্টেশনেও বলা হয়, আঠারো ঊর্ধ্ব তরুণেরা ফেসবুকে প্রকাশিত বিষয়বস্তুকে বিরক্তিকর, বিভ্রান্তিকর এবং নেতিবাচক হিসেবে দেখছে। এ ছাড়া ফেসবুকের সঙ্গে বহু নেতিবাচক বিষয়ের সংশ্লিষ্টতার পাশাপাশি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ দেখাচ্ছেন তাঁরা। পাশাপাশি প্রাসঙ্গিত পরিষেবাগুলোর বিষয়ে ফেসবুকের সচেতনতার অভাবও তাঁদের মধ্যে বিরক্তি তৈরি করছে।
ইন্টারনেটের দাম বাড়ছে
ভারত ফেসবুকের বৃহত্তম বাজার। এখানে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। যদিও এর পেছনে প্রচুর কারণ রয়েছে। এর মধ্যে একটা বলা যায়, ভারতে টিকটক নিষিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি সম্ভবত একেবারে কাকতালীয় নয়!
মুম্বাইয়ে ফেসবুকের ফ্রি বেসিকস উদ্যোগের বিজ্ঞাপন সংবলিত বিলবোর্ড। ছবি: দানিশ সিদ্দিকী/রয়টার্স
মুম্বাইয়ে ফেসবুকের ফ্রি বেসিকস উদ্যোগের বিজ্ঞাপন সংবলিত বিলবোর্ড। ছবি: দানিশ সিদ্দিকী/রয়টার্স
মেটার সিএফও ডেভিড ওয়েহনারের মতে, ডেটার দাম বৃদ্ধির কারণে ভারতে ফেসবুক ব্যবহারকারী বৃদ্ধির হার কমে গেছে।
২০২১ সালের নভেম্বরে ভারতের সব প্রধান টেলিকম কোম্পানি তাদের প্রিপেইড ট্যারিফ ২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। এই পরিবর্তনগুলো নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে থাকতে পারে। এর অর্থ হলো, ভারতে ফেসবুক ব্যবহারের খরচ এর আগে কখনও বেশি ছিল না।
বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ সঙ্কুচিত
ফেসবুকের যাত্রা শুরু হয় ২০০৪ সালে। একটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই শুধু এ প্ল্যাটফর্মে সাইন আপ করতে পারতেন। সেই ফেসবুক এখন প্রায় প্রতিটি দেশে সক্রিয়। অবশ্য চীন, উত্তর কোরিয়া এবং ইরানের মতো কয়েকটি দেশে নিষিদ্ধ।
যেহেতু এই নিষেধাজ্ঞাগুলো কখনো প্রত্যাহার করার সম্ভাবনা কম, তাই ভৌগলিকভাবে বাজার সম্প্রসারণের জন্য ফেসবুকের আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই।
এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের হাতে অনেক অপশন। যে কেউ যে কোনো সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে সাইন আপ করতে পারেন। এই বিষয়টি নতুন সোশিওডেমোগ্রাফিক গ্রুপকে টার্গেট করা বা পুরোনো ব্যবহারকারীদের ফিরিয়ে আনার কৌশলে ফেসবুককে বেশ চাপেই ফেলছে।
বাজারে বহু প্রতিদ্বন্দ্বী। আইডিয়াও নতুন। মানুষ তো চায় নতুন অভিজ্ঞতা। ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ার চরম মুক্তবাজারে নতুন নতুন আইডিয়ার কাছে বারবার হোঁচট খাচ্ছে ফেসবুক। তাল মেলাতে হাঁসফাঁস অবস্থা! মাঝে মধ্যে অন্যের নতুন আইডিয়া নকল করার চেষ্টাও করে।
এই প্রচেষ্টার অংশ হিসেবেই হোয়াটসঅ্যাপ এবং ইনস্টাগ্রামের মতো পরিষেবাগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে ইন্টারনেটজুড়ে মেটার আঁচড় রাখার কৌশল নিয়েছেন জাকারবার্গ। এ উদ্যোগ তীব্র প্রতিযোগিতার বাজারে ঝুঁকিতে বৈচিত্র্য আনতে সহায়তা করবে বলে আশা। ফলে মাত্র একটি প্রান্তিকের নেতিবাচক চিত্র দিয়েই বলা ঠিক হবে না যে, ফেসবুক ধসে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে কোম্পানির বিশেষজ্ঞরা নিবিড়ভাবে সবকিছু মূল্যায়ন করছেন। ফেসবুক যাতে কোনোভাবেই অথৈ সাগরে ডুবন্ত জাহাজে পরিণত না হয়, সে চেষ্টায় তাঁরা নিশ্চয়ই খামতি রাখবে না।