নিজ ঘরে প্রায় ১৯ বছর ধরে শিকলে বন্দি অবস্থায় মানবেতর জীবনযাপন করছেন ৩৬ বছরের যুবক হাফেজ আব্দুল খালেক। বাবা-মায়ের মৃত্যুর পর জানাজার নামাজ পড়াবেন, এমন স্বপ্ন নিয়ে মেধাবী ছেলেকে মাদরাসায় দেন বাবা-মা। তবে ছেলে কোরআনের হাফেজ হলেও বাবা-মায়ের সেই স্বপ্ন আর নেই। হাফেজ হওয়ার মাসখানিকের মধ্যে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন আব্দুল খালেক। এরপর থেকে গত প্রায় ১৯ বছর ধরে তাকে শিকলবন্দি করে রাখা হয়েছে। ছেলে অসুস্থ হওয়ার পর সম্পত্তি ও গরু বিক্রি করেও তার চিকিৎসা করা হয়েছে। এতেও হাফেজ আব্দুল খালেক সুস্থ না হওয়ায় তার বাবা আব্দুল কুদ্দুস দুঃখে-কষ্টে কয়েক বছর আগে মারা যান।
বৃহস্পতিবার বিকেলে সরেজমিনে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের ভোটাল গ্রামের মৃত আবদুল কুদ্দুসের ছেলে হাফেজ আব্দুল খালেক। তারা ৫ ভাই ৩ বোন। ৫ ভাইয়ের মধ্যে ৩য় আব্দুল খালেক সবার আদরের ছিলেন। পড়ালেখায় যেমন ভালো ছিলেন, তেমনি এলাকায়ও ভদ্র ছেলে হিসেবে যথেষ্ট সুনাম ছিল তার।
উপজেলার জয়শ্রী রাহমানিয়া আরাবিয়া হাফিজিয়া মাদরাসায় পড়াশোনা করে আব্দুল খালেক কোরআনে হাফেজ হয়েছেন। কিন্তু হাফেজ হওয়ার মাস খানেকের মধ্যে আস্তে আস্তে আব্দুল খালেক মানসিক ভারসাম্য হারাতে থাকেন। পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী তার চিকিৎসা করানো হয়। অসহায় এই পরিবারটি তাদের সাধ্য মতো চেষ্টা করেও খালেককে সুস্থ করতে পারেনি। পায়নি কোনো সাহায্য সহযোগিতা। এগিয়ে আসেনি কোনো সরকারি বা বেসরকারি সংস্থা। সুস্থ না হওয়ায় বসতঘরের একটি কক্ষে এভাবে হাফেজ আব্দুল খালেককে ১৯ বছর শিকলবন্দি মানবেতার জীবন যাপন করতে হচ্ছে।
গত ৪ বছর পূর্বে উপজেলা সমাজ সেবা অধিদপ্তর মাত্র ১০ হাজার টাকা অনুদান দিয়েছেন। এ পর্যন্ত আর কোনো সহযোগিতা পায়নি এ পরিবারটি। অর্থের অভাবে আব্দুল খালেকের উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছে না, এজন্য বিত্তবানদের সহযোগিতা কামনা করেছে তার বৃদ্ধা মা শামসুন্নাহার।
হাউমাউ করে কেঁদে কেঁদে হাফেজ আব্দুল খালেকের মা শামসুন্নাহার বলেন, মেধাবী হওয়াতে আব্দুল খালেককে হাফেজি মাদরাসায় পড়িয়েছেন। ছেলে হাফেজ হয়ে ইসলাম প্রচারের সঙ্গে নিজের বাবা-মায়ের শেষ যাত্রায় জানাজার নামাজে ইমামতি করবেন। ওই সন্তান হাফেজ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে তার নিজের জীবনই এখন বিপর্যস্ত। তাকে শিকলে বন্দি করে রাখা হয়েছে। ছেলের এই করুণ পরিণতি দেখে গত ১৪ বছর পূর্বে তার বাবা মারা গেছেন।
হাফেজ আব্দুল খালেকের ভাই আবু বকর সিদ্দিক ও বেলায়েত হোসেন বলেন, সে বিভিন্ন সময় ঘরের আসবাবপত্র ভেঙে ফেলে। অনেক সময় এদিক- সেদিক চলে যায়। পরিবারের পক্ষে সারাক্ষণ দেখে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। এজন্য তাকে ঘরে এভাবে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। পারিবারিক অর্থিক অনটনের কারণে উন্নত চিকিৎসা করাতে পারছে না।
জয়শ্রী রাহমানিয়া আরাবিয়া হাফিজিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষ হাফেজ মহসিন মিয়া বলেন, আবদুল খালেক খুব মেধাবী ছাত্র ছিল। হঠাৎ সে অসুস্থ হয়ে পড়ে। আমরাসহ তার পরিবারের সামর্থ্য অনুযায়ী চেষ্টা করেছি চিকিৎসার জন্য, কিন্তু সে সুস্থ হয়নি।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. শাহজাহান পাটওয়ারী বলেন, বিষয়টি আমি জানারপর খোঁজখবর নিয়ে তার চিকিৎসার জন্য আমার নিজস্ব তহবিল থেকে সামর্থনুযায়ী আর্থিক সহযোগীতা করেছি। তার উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. মাহমুদুল হাসান বলেন, হাফেজ আব্দুল খালেকের বিষয়ে জানতে পেরে আমরা নগদ ১০ হাজার টাকা দিয়েছি এবং একটি প্রতিবন্ধী ভাতার বই করে দিয়েছি।
প্রতিবেদক: শিমুল হাছান, ১৪ নভেম্বর ২০২৪
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur