ফরিদগঞ্জ

ফরিদগঞ্জে সক্রিয় মোবাইল চোর চক্র : নিয়ন্ত্রণকারী ধরা ছোঁয়ার বাইরে

ফরিদগঞ্জের প্রত্যন্ত পল্লী অঞ্চলে বসেই আন্তঃজেলা মোবাইল চোর চক্রকে পরিচালনা করে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ হয়েছে মামুন আলম। আইন-শৃঙ্খলা বাহীনিকে ফাঁকি দিয়ে দিন দুপুরেই মোবাইল চোর চক্রের বড় একটি গ্রæপকে নেতৃত্বে দিচ্ছে সে।

মাসব্যাপি অনুসন্ধানে জানা যায় প্রায় শতাধিক মোবাইল চোরের নিয়ন্ত্রণকারী এই মামুন গড়ে তুলেছেন চাঁদপুর, রায়পুর, ল²ীপুর, নারায়ণঞ্জ ও কুমিল্লায় স্মার্ট ভ্রাম্যমাণ মোবাইল চোর চক্রের সদস্য। তাদের কাজ ছদœবেশে বিভিন্ন অফিস কিংবা বাসা-বাড়ি ও প্রবাসীদের ফ্ল্যাট থেকে মোবাইলসহ অনান্য ডিভাইস চুরি করা। মামুন এই বিশাল নেটওর্য়াক আইন-শৃঙ্খলাবাহীনিকে ফাঁকি দিয়েই পরিচালনা করছে স্থানীয় গোয়াল ভাওর বাজার থেকেই। প্রায় ৫ বছরেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাকে স্পর্শ কিংবা চিহিৃতও করতে পারেনি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়নের গোয়াল ভাওর বাজারের জহির আলমের (জহির মাস্টার) দ্বিতীয় ছেলে এই মামুন আলম। গোয়াল ভাওর বাজারের জহির হার্ডওয়্যারে বসেই মোবাইল চোর চক্রকে নিয়ন্ত্রণ করছে সে। প্রতি মাসেই তার চোর চক্ররা শতাধিক বিভিন্ন ব্যান্ডের মোবাইল, ট্যাব, আইপেড ও ল্যাপটপ তার কাছে পৌঁছে দেয়। আর তার সোর্সের ম্যাধ্যমে এই সব চোরাই পণ্য সে উচ্চ মুল্যে বাজারজাত করে থাকে বিভিন্ন স্থানে কিংবা খুচরা কাস্টমারের কাছে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, চোরাই মোবাইলগুলো বাজারজাত করার জন্য মামুনের রয়েছে কমিশন ভিত্তিক সোর্স। যারা এ মোবাইলগুলো সাধারণ মানুষের কাছে বিক্রি করে দিয়ে কমিশন নেয়। এসব সোর্সদের মধ্যে অন্যতম গোয়াল ভাওর বাজারের আব্দুল্লাহ কালু (লন্ডী, লেপ-তোষক ও জ্বালানী তেল ব্যবসায়ী)।

সে প্রতিবেদকের কাছে সত্যতা স্বীকার করে জানায়, ‘আমি মাঝে মাঝে মামুনের কাছ থেকে মোবাইল নেই। কিছুদিন আগে তার কাছ থেকে বাটামওয়ালা (বাটনযুক্ত মোবাইল) একটা নিয়েছি। তবে আমি জানি না সে কোথায় থেকে এসব মোবাইল আনে।’

এর বাইরেও রয়েছে ওই বাজারের ব্যবসায়ী জসিম (জসিম টেলিকম)। সে প্রতিবেদকের পরিচয় আঁচ করতে পেরে মামুনের কাছ থেকে কমিশনের ভিত্তিতে মোবাইল বিক্রির অভিযোগ অস্বীকার করে। তবে মামুন চক্রের সাথে জড়িত থাকার বিষয়টি তার প্রতিবেশী বেশ কিছু ব্যবসায় নিশ্চিত করেছে। এছাড়ার বাজারের আরেক ব্যবসায়ী মা ডিজিটাল স্টুডিওর মালিক জাফরও রয়েছে। তবে সে জানিয়েছে এখন সে পুরোনো মোবাইল বিক্রি করে না। তার দোকানে নতুন মোবাইল রয়েছে সেগুলোই বিক্রি করে।

অনুসন্ধানে আরো জানা যায়, মামুনের নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি এখন পাশ্ববর্তী নয়ারহাট, রামপুর, ফিরোজপুর, হরিপুর (গাজীপুর) বাজারেও ছড়িয়েছে। সেখানেও তার বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী ছদ্মবেশী সোর্স বা সরবরাহকারী রয়েছে।

ওইসব বাজারের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেশ ক’জন ব্যবসায়ী জানায়, মামুন আলম মফস্বল বাজারে বসেই আইন-শৃঙ্খলা বহীনিকে ফাঁকি দিয়ে আন্তঃজেলার মোবইল চোর চক্রদের নিয়ন্ত্রণ করছে। তার সোর্সরা নিরাপদ হিসেবেই বেঁচে নিয়েছেন মামুনকে। এছাড়া মামুন মোবাইল চোরদের দাদন (মোবাইল ব্যাংকিং বিকাশে’র মাধ্যমে অগ্রিম) নির্ধারিত হারে টাকা দিয়ে থাকেন বিভিন্ন ব্যান্ডের মোবাইলের জন্য।

ফলে উভয়ই নিরাপদে থাকতে পরে আইন-শৃঙ্খলা বাহীনর হাত থেকে। তার সোর্সদের দাবি কেবল কমিশনের মাধ্যমে মামুনের হয়ে গ্রাহক কিংবা নির্ধারিত স্থানে চাহিদানুযায়ী মোবাইলসহ অনান্য ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী পৌঁছে দেয় তারা।

তারা আরো জানান, গত ৪ বছরের বেশি সময় ধরেই তারা মামুনের হয়ে কাজ করছেন কমিশনের ভিত্তিতে।

এদিকে মামুনের কাছ থেকে সরাসরি মোবাইল কিনেছেন এমন বেশ ক’জন সাধারণ ক্রেতার সাথে কথা হয় প্রতিবেদকের সাথে। এদের একজন মামুনের বাড়ির চাচাতো ভাই চাঁদপুরের একটি বেসরকারি স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক মো. হোসেন জানান, সে সহ তার আরো দু’ভাই (মোহছেন ও আনিছ) মামুনের কাছ থেকে বিভিন্ন সময় পুরোনো মোবাইল কিনেছে। তবে মামুন মোবাইল চোর চক্রের সদস্য কিনা তা তিনি জানেন না বলে প্রতিবেদককে জানিয়েছেন।

এ ছাড়াও কয়েকজন ক্রেতার সাথে কথা হয়েছে, তবে তারা নাম পরিচয় দিতে অস্বীকার করেছেন এবং বলেছেন তারা জানতো মামুন চোর চক্রের সাথে জড়িত।

তবে গোয়াল ভাওর বাজারের বেশ কয়েকজন ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, মামুন আলম শুধু মোবাইল চোর চক্রের সাথেই সম্পৃক্ত নয়, সে আরো অপকর্মের সাথে জড়িত। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সে আগুন সন্ত্রাসসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। নির্বাচনের আগে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যখন চিহিৃত অপরাধীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে ঠিক তখনি সে পার্শ্ববর্তী নয়ারহাটে নিকট আত্মীয়র বাসায় আতœগোপন করে।

স্থানীয় ব্যবসায়ীরা আরো জানান, গত ২০১৮ সালের ২২ মে সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল যখন ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ র‌্যাব-পুলিশের সমন্বয়ে অভিযানের ঘোষণা দেন; ঠিক তখনি মামুন তাবলীগ জমায়াতের চিল্লায় যোগ দিয়ে নিজকে সাধু সেজে প্রায় ৬ মাস পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে বাড়ি ফিরেন। সেখান থেকে ফিরে পুনরায় আন্তঃজেলা মোবাই চোর চক্রদের নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবসা অব্যহত রাখেন বলে গোয়াল ভাওর বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী জানিয়েছে।

এসব বিষয়ে মামুনের সন্ধানে একাধিকবার বাজারে গেলেও তাকে পাওয়া যায়নি। তার সোর্সদেরে সাথে কথা বলায় সে সাংবাদিক তার অপরাধ অনুসন্ধান করছে এমন খবরে সে গা ডাকা দেয়। পরবর্তীতে প্রতিবেদকের সাথে কথা বলার জন্যে সে বেশ কয়েকজন স্থানীয় ব্যাবসায়ীর স্মরণাপন্ন হলে তারা প্রতিবেদককে ফোন করে। পরবর্তীতে তাদের অনুরোধে একপর্যায়ে মামুনের সন্ধান মেলে সে সম্মত হয় মুঠোফোনে কথা বলতে।

সে মুঠোফোনে চাঁদপুর টাইমসকে জানায়, ‘আমি আমার মোবাইল ফ্ল্যাক্সিলোডের দোকান। সে হিসেবে আমি নতুন ও পুরাতন মোবাইল ক্রয় করি এবং বিক্রি করি। তবে আমি চুরি করি না। তার দাবি এসব মোবাইল সে দু’থেকে আড়াইশ’ টাকায় ক্রয় করে সেগুলো ঠিক করে পরে বিক্রি করে দেয়। এসময় প্রতিবেদকের কাছ থেকে তার অপরাধের বিষয়ে তথ্যদাতার নাম জানার চেষ্টা করে বারংবার।

এ বিষয়ে গোয়াল ভাওড় বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সজিব চাঁদপুর টাইমসকে জানান, ‘মামুন এ বাজারের একজন ব্যবসায়ী হিসেবই জানি। যদি সে মোবাইল চোর চক্রের সদস্য বা এ ধরনের কোনো অপরাধে জড়িত থাকে। তাহলে অবশ্যই আমরা তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবো।

এই বিষয়ে ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রকিব বলেন, ‘লকডাউনের পূর্বে কিছু মোবাইল হারানোর অভিযোগ ছিল আমাদের অফিসাররা কিছু মোবাইল উদ্ধারও করেছে, বর্তনামে লকডাউনের ভেতরে তেমন মোবাইল হারানোর অভিযোগ আসেনি থানায়।’

ফরিদগঞ্জে কোনো মোবাইল ডিভাইস চোরের হোতা আছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে মি. রকিব বলেন, ‘আমাদের জানা মতে নেই যদি থেকে থাকে বা আপনাদের জানা থাকে তাহলে আমাদের ইনফরমেশন দিবেন আমরা তাকে আইনের আওতায় এনে কঠিন শাস্তি দিবো।’

প্রতিবেদক : শিমুল হাছান, ২৪ জুন ২০২০

Share