ফরিদগঞ্জ

ফরিদগঞ্জে মৃৎশিল্পীদের মানবেতর জীবন : হারাচ্ছে ঐতিহ্য

হিন্দু সম্প্রদায়ে পেশার দিকে থেকে কুমার গোত্রগত দিকে থেকে পাল একটি বংশগত নাম। এ সম্প্রদায়ের কুমাররা হাঁড়ি-পাতিল, বাচ্চাদের খেলনাসহ মাটির তৈরি নানা আসবাবপত্র তৈরি করেন। এ সব জিনিসপত্র দেশিয় সংস্কৃতিতে আমাদের কাছে মৃৎশিল্প হিসেবে পরিচিত।

ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে বংশগত কৌলিন্য এতো বেশি না থাকলেও একসময় এদের কদর ছিলো খুব বেশি। গ্রাম থেকে শহরে প্রায় সব এলাকাতে মাটির তৈরি জিনিসপত্র নিয়ে কাঁধে করে বিক্রির উদ্দেশ্যে ঘুরতে দেখা যেতো মৃৎশিল্প বিক্রেতাদের।

সময়ের পরিবর্তনে স্টিল ও সিলভারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এখন কুমারদের তৈরি পণ্যের চাহিদা কমে গেছে। এদের নামের শেষে বংশের তাগিদে কুমারযুক্ত রাখলেও পেশা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকেই । তাই ক্রমান্বয়ে হারিয়ে যাচ্ছে এ শিল্প।

এ বংশের লোকজনের একটি চৌকস গোষ্ঠি প্রতিমা বানানোর কাজ করেন। প্রতিমার নির্দিষ্ট ছক অনুযায়ী সারা বছর তারা ছোট বড় প্রতিমা তৈরি করে থাকনে। আর নির্দিষ্ট ছক বলতে তাদের হাতের নৈপুণ্যতা এখানে প্রাধান্য পায়।

কুমার বংশের যারা বর্তমানে প্রতিমা তৈরির কাজ করছেন তারা কিছুটা ভালো রয়েছেন। তবে এর চাহিদাও জীবিকার তুলনায় বেশি নয়। কারণ, প্রতিমা বিক্রি তাদের ধর্মের অনুসারী এবং নির্দিষ্ট উৎসবের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সব মিলিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের এ পেশার মানুষগুলো মানবেতর জীবন যাপন করছেন।

কুমার ও পাল বংশের বর্তমান পরিস্থিতি জানতে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর পশ্চিম ইউনিয়নের শোল্লা বাজারের পূর্ব দিকে মধ্য আইটপাড়া গ্রাম ঘুরে দেখা যায়, গ্রামের পাঁচটি বাড়িতে আদিকাল থেকে হিন্দু সম্প্রদায়ের কুমার পেশার লোকজন এ পেশার মাধ্যমেই জীবন যাপন করছেন।

স্থানীয় অন্যান্য মুসলমানদের সাথে রয়েছে তাদের বেশ সখ্যতা। আগে-পরে সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার মতো নেই এখন অপ্রীতিকর কোনো ঘটনার সংবাদ।

ওই এলাকার পাল বাড়িতে (স্থানীয়ভাবে পরিচিত মাইঝের কুমার বাড়ি) গিয়ে ঘুরে ঘুরে কথা হয় তাদের সাথে ও দেখা হয় তাদের প্রতিমা তৈরির দৃশ্য। দেখলাম-প্রতিমাগুলো কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি করে বাড়ির আঙিনায় রোদে শুকাতে সাজিয়ে রাখা হয়েছে।

এ বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের রুাহুল চন্দ্র পাল জানান, ‘আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ পেশা নিয়োজিত ছিলেন ,বর্তমানেও আছেন। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় মাটির তৈরি হাঁড়ি পাতিলের ব্যবহার কমে যাওয়ায় আমাদেরও এ পেশা কাজের আগ্রহ নেই। পড়ালেখা শেষ করেছি ও চাকরি-বাকরি করছি।

এ পেশায় আসার ইচ্ছা থাকলেও জীবন-যাত্রার মান বিবেচনা ও বাস্তবতায় উপলব্দি করে এখন আর তা’ করার ইচ্ছা নেই।’

এখন কি করেন এমন পশ্নের জবাবে রাহুল জানায়, ‘চাঁদপুর সরকারি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে চট্টগ্রামে প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকুরি করছি । বাবা এ মাটির তৈরির হাঁড়ি-পাতিল ও প্রতিমা বিক্রি করেই সংসার চালিয়েছেন ও পাশাপাশি আমাদের পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছেন । ভবিষ্যতে এমনটি আর সম্ভব নয়।’

রাহুলের সাথে কথা বলে আরো জানা যায়, মৃৎশিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট এ পেশাকে বাঁচিয়ে রাখতে ধর্মের তাগিদে কেউ কেউ করে গেলেও তাদের মধ্যে থেকে বড় হয়ে উঠা বর্তমান প্রজন্মরা অর্থনেতিক কারণে এ পেশায় আর কাজ করতে আগ্রহী নন।

এছাড়া এ পেশায় সংশ্লিষ্টরা পৃষ্ঠপোষকতা তো দূরে কথা পুঁজি সংগ্রহে ব্যাংক থেকেও ঋণ পাচ্ছে না। সবমিলিয়ে এ পেশার লোকজন অনেকটা মানবেতর অবস্থায় দিন কাটাচ্ছেন। মাটির তৈরি জিনিসপত্র তৈরিতে প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সংগ্রহ পদ্ধতি নিয়ে কথা বলেন সুভাষ চন্দ্র পাল।

তিনি জানান, কাঁচা এটেল মাটি নদীর তলদেশ কিংবা পাশ্ববর্তী চরের জমি থেকে খুঁড়ে সংগ্রহ করতে হয়। এ মাটি সবজায়গায় পাওয়া যায় না। কুমার বংশের মৃৎশিল্পীদের কাছে এটি একধরণের ‘খনি’।

বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস তথা খৃষ্ঠীয় অক্টোবর-নভেম্বর মাসে এ মাটি সংগ্রহ করা হয়। বছরে একবারেই এ ‘খনি’ থেকে মৃৎশিল্পীরা মাটি সংগ্রহ করতে পারে। একবারের সংগ্রহের মাটি দিয়ে সারা বছরের ব্যবসার কাঁচামাল যোগান দেয়া হয়।

প্রতি ফুট এটেল মাটি সংগ্রহে ১০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। তিন শতাংশের ভূমি থেকে সর্বোচ্চ ৮শ’ ফুট পর্যন্ত মাটি সংগ্রহ করা যায় এবং তা’ বাড়ি পর্যন্ত আনতে ১০ হাজার টাকার মত ব্যয় হয় বলে দাবি সুভাষ চন্দ্র পাল জানান ।

প্রথমে মাটিকে এনে পানির সাথে মিশিয়ে অনেক বেশি করে পিষতে হয়। হাতের দ্বারা তৈরি এসব আসবাবপত্র বানাতে মৃৎশিল্পীরা তাদের পরিবারের সবাইকে সাধারণত: ব্যবহার করে থাকে।

মাটির তৈরি জিনিসপত্র পোড়ানোর বিষয়ে সুভাষ চন্দ্র পাল চাঁদপুর টাইমসকে জানায়, ‘সাধারণত যে জিনিসগুলো পাতলা সেগুলোকেই পোড়াতে হয়। যেগুলো ভারি যেমন বাচ্চাদের খেলনা, প্রতিমা ইত্যাদি পোড়াতে হয় না। রোদে শুকিয়ে রংয়ের কাজ করা হয়।’

About The Author

দেলোয়ার হোসাইন
Share