চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে প্রশাসনের অনুমোদন ছাড়াই ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার’ নামে প্রস্তুতি চলছে। অনুমোদন না নেয়ার বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
আর এ মেলাকে কেন্দ্র করে জমজমাট বাণিজ্য,জুয়া ও অশ্লীলতা দেখানোর আশংকায় গতবছরই এটি বন্ধ করে দিয়েছিলো প্রশাসন।
এ বছরও একই কায়দায় প্রস্তুতি নেয়ার অভিযোগে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সুধীমহল ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।
ওই মেলাটি ২২ দিনের জন্য মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে ময়মনসিংহের জনৈক রফিক গোপনে লীজ নিয়ে বিভিন স্টল বিক্রি করছে বলে একাধিক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এই মেলার পক্ষে বিপক্ষে ফরিদগঞ্জের সর্বত্র আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় বইছে।
উপজেলা সদরের প্রাণকেন্দ্র পৌরসভা অফিসের সামনে ‘পানি উন্নয়ন বোর্ডের মালিকানাধীন মাঠে এই মেলা আয়োজনের জন্য এরইমধ্যে মঞ্চ ও প্যান্ডেল নির্মাণ করা হয়েছে।
মেলা উদযাপন কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েক সদস্য জানিয়েছে, ‘শুনেছি আমাদের নাম রাখা হয়েছে এর বাহিরে ওই মেলা সম্পর্কে তাদের আর কিছু জানা নেই।’
জনস্বার্থে সার্বিক বিষয়ে বিবেচনা করে গত বছরের ন্যায় এবারও মেলাটি বন্ধের দাবিতে ফরিদগঞ্জের সাংসদ ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূইয়ার হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন ফরিদগঞ্জের সচেতন জননাধারণ।
অপরদিকে মেলার বিরূপ প্রভাবের কারণে তা বন্ধের দাবিতে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মো. মাহফুজুল হক চাঁদপুর জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপার বরাবর আবেদন করেছেন।
ওই মেলা সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের বক্তব্য, উক্ত মেলার অনুমোদন সংক্রান্ত কোন চিঠিপত্র আসেনি।
বিশ^স্ত সূত্রে জানা গেছে, মেলা আয়োজন করা যায় কি না, দাখিণ করা অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করার জন্য, চাঁদপুরের পুলিশ সুপার ফরিদগঞ্জ থানার ওসিকে চিঠি দিয়েছেন। এসর্ম্পকে ফরিদগঞ্জ থানার ওসি মো. শাহ আলম জানান, চিঠির প্রেক্ষিতে তিনি তদন্ত পূর্বক প্রতিবেদন দাখিল করেছেন।
সাধারণ মানুষের আশংঙ্কা মেলায় অতিতের ন্যায় লটারির নামে জুয়া, যাদু ও পুতুল নাচের আসরে মেয়েদের অশ্লীল নাচের আয়োজন করা হতে পরে। যার ফলে মাদকের ব্যবহার ও অপরাধের প্রবণতা বাড়বে।
এছাড়া মেলাতে মধ্যরাত পর্যন্ত হওয়া উচ্চ স্বরের গান বাজনার ফলে বছরের শেষে অনুষ্ঠেয় শিক্ষার্থীদের বহুল কাঙ্খিত বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফলে বিপর্যয় ডেকে আনবে। এনিয়ে মেলার আশে পাশের হাজারো অভিভাবক তাদের সন্তানদের পড়ালেখা নিয়ে শংঙ্কায় রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চলতি মাসের ২৬ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলাটি উদ্বোধন হবে বলে কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে। মেলাতে এবার ৭০টি স্টল নির্মাণ করা হয়েছে। কথিত ‘উদযাপন কমিটি’র ব্যানারে ‘মুক্তিযোদ্ধের বিজয় মেলা’ নামে মেলা আয়োজনের প্রচার ও প্রস্তুতি চলছে।
তবে, সূত্রে জানাগেছে মেলার জন্য মঙ্গলবার (বিকালে) এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সরকারি কোন অনুমোদন পায়নি মেলা কর্তৃপক্ষ।
এদিকে জনস্বার্থে মেলাটি বন্ধের দাবি জানিয়ে চাঁদপুর-৪ (ফরিদগঞ্জ) আসনের সংসদ ড. শামছুল হক ভুঁইয়ার কাছে এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে দাবি তোলা হয়েছে।
এ ছাড়াও জনস্বার্থে ৬টি বিষয় উল্লেখ করে মেলা বন্ধের দাবি জানিয়ে ফরিদগঞ্জ পৌর আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মেয়র মাহফুজুল হক গত বৃহস্পতিবার চাঁদপুরের জেলা প্রশাসন ও পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে আবেদন করেন। ওই আবেদনে মেলা বন্ধের জন্য বিভিন্ন গুরুতর অভিযোগ আনা হয়েছে।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে যে, রাজনীতির ছদ্মবেশে কিছু কুচক্রিমহল মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার নামে মেলা করার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রকৃতপক্ষে মেলার অন্তরালে চলে বিভিন্ন অপকর্ম।
এখানে মেলা হলে লটারির নামে জুয়া খেলার কারণে এলাকায় চুরি ডাকাতি বৃদ্ধি পাবে। পৌর এলাকায় মাদক নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়বে। মেলাকে কেন্দ্র করে মাদক ব্যবসায়ীরা আরো ব্যাপক হারে মাদক আমদানি করবে। এতে করে যুবসমাজ ধ্বংসের মুখে পড়বে।
ক্ষতিগ্রস্ত হবে হাজার হাজার শিক্ষাথীর লেখাপড়ার পাশাপাশি পৌরসভার প্রতিদিনের কার্যক্রমে ও জনসাধারণের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটবে।
মেলার অনুমোদন না থাকলেও ময়মনসিংহ জেলার বাসিন্দা ও মেলার কথিত লিজ গ্রহিতা জনৈক রফিকুল ইসলাম গতকাল মঙ্গলবার সাংবাদিকদের মুঠোফোনে জানান, এরইমধ্যে মেলার সবগুলো স্টল বরাদ্দ হয়ে গেছে।
জনস্বার্থের বিষয়টি চিন্তা করে গত বছর মেলা অয়োজনে সম্মতি দেননি সংসদ সদস্য ড. মোহাম্মদ শামছুল হক ভূইয়া। যে কারনে গত বছর মেলার সব আয়োজন সম্পন্ন হলেও সেই মেলাটি বন্ধ করতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
তাই এবারও এলাকাবাসী এমপি মহোদয়ের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
স্থানীয় প্রবীণ শিক্ষক আমির হোসেন মাস্টার চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, নভেম্বর ডিসেম্ভর মাসটা হলো শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার বিশেষ পড়ালেখার সময়। আর এই সময়টায় মেলা হওয়া মানে শিক্ষাকে ব্যাহত করা মাত্র।
বড়ালী গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন “মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার নামে এ মেলা ফরিদগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের কোন কাজে আসে না। মুক্তিযোদ্ধের বিজয় মেলার নামে মূলত একে পূজি করে কিছু লোকের বাণিজ্য মেলা হওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বলে আমি মনে করি।
এ ব্যপারে, মুক্তিযোদ্ধা সংসদের চলমান কমান্ডার সহিদ উল্লাহ তপদার বলেছেন, মেলা আয়োজনের অনুমোদন হয়েছে কি না আমি জানি না। অন্য প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এ বছর লটারী ও পুতুল নাচ এর আয়োজন হচ্ছে না।
চাঁদপুর জেলা পরিষদের সদস্য সাইফুল ইসলাম রিপন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ফরিদগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধের বিজয় মেলার নামে মূলত চলছে কিছু অসাধু লোকের রমরমা বাণিজ্য। এতে করে দলের ক্ষতির পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে এখানে কোন স্মৃতিচারণ হয় না।
পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন রতন চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, “মেলার সঙ্গে পৌর আওয়ামী লীগের কেউ জড়িত নয়। যখন দেখি মুক্তিযদ্ধের বিজয় মেলায় স্বাধীনতা বিরোধী চক্র জড়িত তখন এর তীব্র ও প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করার নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম মাহাফুজুর রহমান বলেছেন, ‘আমার কাছে এখন পর্যন্ত মেলার অনুমোদন সংক্রান্ত কোন চিঠি আসে নাই।’
উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আবু সাহেদ সরকার চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘আমি মেলা কমিটির উপদেষ্টা মাত্র। জনস্বার্থে উপদেশ দিতে পারি। কিন্তু জনস্বার্থে দেওয়া উপদেশ কেউ না মানলে সেখানে আমার করার কি আছে। তবে এবারের আয়োজিত বিজয় মেলায় উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে জনস্বার্থে য কোন অশ্লীলতা কঠোর হস্তে দমন করার দৃঢ় ইচ্ছা রয়েছে আমার।
এদিকে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে, এবার ৩০ লাখ টাকায় মেলা লিজ দেওয়া হয়েছে। অবশ্য এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছেন মেলা কমিটির সদস্য মহাসচিব মুক্তিযোদ্ধা সহিদ উল্লাহ তপদার।
প্রতিবেদক- আতাউর রহমান সোহাগ
: আপডেট, বাংলাদেশ ২ : ০৩ পিএম, ২২ নভেম্বর, ২০১৭ বুধবার
ডিএইচ