Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / ফরিদগঞ্জে বিজয় মেলা নিয়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা
বিজয় মেলা

ফরিদগঞ্জে বিজয় মেলা নিয়ে ক্ষুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধারা

চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা বুলন্ঠিত হচ্ছে। মেলাটি এখন মূলত বাণিজ্য মেলায় রুপ নিচ্ছে। প্রথম পুরুষ্কার ৫ লাখ টাকাসহ আরো বিভিন্ন মানের মোট ৫১ টি পুরুষ্কার দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে র‌্যাফেল ড্রর নামে লটারির টিকেট টিকেট বিক্রি হচ্ছে। এ নিয়ে মেলার পক্ষে বিপক্ষে বিভিন্ন আলোচনা সমালোচনা ছাড়াও স্থানীয়রা বলছে কার স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা? হয়রানি হওয়ার ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খোলার সাহস পাচ্ছেন না।

মেলা প্রাঙ্গন ঘুরে দেখা যায়, ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ হিসেবে তৈরী করা মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত আগের মতো নেই কোন আলোচনা, নাটক কিংবা সাস্কৃতিক অনুষ্ঠান। তবে মাসব্যাপী এই মেলার নামে প্রায় ৩০ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে বলে বিভিন্ন মহল থেকে নানামুখী অভিযোগ উঠেছে। জনৈক এক ব্যক্তি উক্ত মেলাটি ক্রয় করেছেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। ইতিমধ্যে মেলার আয়োজককে অগ্রিম ৫ লাখ টাকা প্রদান করে মেলার কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।

এদিকে ডিসেম্বর মাসে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চলছে বার্ষিক পরীক্ষা। করোনাকালীন সময়ে দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় এমনিতে শিক্ষাব্যবস্থা নাজৃুক অবস্থায় রয়েছে। এমন বেগতিক অবস্থায় শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষার সময় মুক্তিযুদ্ধের মেলার নামে হাতে গোনা কয়জনের নিজস্ব বাণিজ্য স্বার্থ আদায় নিয়ে উঠেপড়ে লেগেছে। এ নিয়ে শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও এলাকাবাসীর মাঝে অসন্তোষ বিরাজ করতে দেখা যায়।

খোজ নিয়ে জানা গেছে, উক্ত মেলা পরিচালনার নামে তড়িঘড়ি করে পরিচালনা কমিটি, সাষ্কৃতিক কমিটি ও মিডিয়া কমিটি করা হলেও তা এক রহস্যজনক কারনে প্রকাশ করা হয়নি। মেলায় প্রায় ১০০ টি স্টল থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নেই কোন স্টল, আলোচনা, নাটক কিংবা সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান।

সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গনে ঘুরার সময় শুনা যায় উচ্চ স্বরে চলছে ভারতীয় হিন্দি ও পাকিস্তানের উর্দু গান। বিভিন্ন স্টলে শিক্ষার্থী ও নারী পুরুষের সমাগম। মেলায় আগের মতো নেই আমেজ।

এ সময় বেশ কয়জন দোকানী বলছে এবার আগের মতো বেচা বিক্রি নেই। মেলা যে ভাবে জমজমাট হবার কথা সেই আয়োজন না থাকায় অনেকটা ঢিলে ঢালা ভাবে চলছে মেলার কার্যক্রম।

মেলাতে আসা কয়েকজন জানায়, মেলা জমজমাট হউক আর না হউক সেটা বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলে মেলার নামে যা ব্যবসা করার তাতো হয়েই গেছে। এখন এই মেলার পক্ষে বিপক্ষে কে আছে কে নেই তা সংশ্লিষ্টদের কোন ভাবনার বিষয় নয়।

গত ২৫ নভেম্ভর ফরিদগঞ্জ মুক্ত দিবস উপলক্ষে আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রধান অতিথি হিসেবে উক্ত মেলা উদ্বোধন করেন ফরিদগঞ্জের সাংসদ মুহম্মদ শফিকুর রহমান এমপি। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সাংসদ শফিকুর রহমান তার বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ করে স্পষ্ট ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, ‘মেলার নামে কোন অম্লীলতা, জুয়া খেলা চলবে না। এর বিরুদ্ধে জনস্বার্থে সবাইকে সোচ্চার থাকতে হবে। এই মেলা পরিচালনা কমিটির আহবায়ক হলেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা মেয়র আবুল খায়ের পাটওয়ারী।’

প্রতিদিন মেলা প্রাঙ্গনে যাচ্ছেন কয়েক হাজার শিশু, কিশোর, যুবক, যুবতি, নারী ও পুরুষ। মেলা থেকে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কি শিখছেন ও জানছেন এ প্রশ্নে আবদুর রহিম (৪৫), মোঃ লালু (৪০), আবুল কালাম (২৫) ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন নারী বলেছেন, ‘মেলায় এসেছি কিছুক্ষণ সময় কাটাইতে, কাটাইলাম। কেউ বলেছেন কিছু কেনাকাটা করলাম ও খাইলাম, আর কিছুর দরকার নাই। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে প্রশ্ন করেল কয়েকজন শিশু বলেছে, জানি না। তরুণ ও যুবকরা কোন মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা বলেছেন, ‘এইটাকে মুক্তিযুদ্ধের বিজয়মেলা বলা ঠিক হবে না। এইটা শুধু বাণিজ্য মেলা। একজন বলেছেন, কার স্বার্থে মূলত এই মেলা? বিজয়মেলার নামে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের অপমান করা হইতেছে। অপর একজন বলেছেন, শুনছি বিজয়মেলা বিক্রি করে দেওয়া হইছে।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মুক্তিযোদ্ধারা উক্ত মেলার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে আয়োজন করা মেলায় হাতে গোনা কয়জন লাভবান হওয়ার আশায় শুনেছি এই মেলা ৩৫ লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়েছে।

এ ব্যপারে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. সহিদউল্লা তফাদার বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার নামে মূলত কি হচ্ছে তা আমরা জানিনা। জানারও চেষ্টা করি না।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে ওই কমান্ডার আরো বলেন, ২৫ নভেম্বর উক্ত মেলা উদ্বোধন উপলক্ষে স্থানীয় সাংসদ ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার উপস্থিত থাকায় ওনাদের সম্মানে সেইদিন আমি আলোচনা সভা পরিচালনা করেছি মাত্র। ওই দিন বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. জাহিদুল ইসলাম রোমান ও সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সাহেদ সরকার, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র মাহফুজুল হক উদ্বোধনী দিনে আসেন নি। মূলত মুক্তিযোদ্ধার নাম ব্যবহার করে এবারের আয়োজিত মেলাটি এক ব্যক্তির স্বার্থ হাসিলের মেলা বলা ছাড়া আমার আর কোন বক্তব্য নেই।

এই মেলা নিয়ে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক মেয়র মাহফুজুল হক বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের নামে আয়োজিত বিজয় মেলাতে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ মূলক কোনো আয়োজন নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে আয়োজিত মেলাকে মূলত বাণিজ্য মেলায় রুপান্তর করে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদেরকে অসম্মান করা হচ্ছে বলে আমি মনে করি।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু সায়েদ সরকার বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাম ব্যবহার করে ফরিদগঞ্জে আয়োজিত মেলার পক্ষে আমার কোন বক্তব্য দিতে ইচ্ছে নেই।’

ফরিদগঞ্জ বাজার ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি ফারুক হোসেন বলেন, ‘এই মেলার পক্ষে বিপক্ষে আমার কোন বক্তব্য নেই। তবে প্রতিদিন র‌্যাফেল ড্রর নামে লটারী চালালে আমরা ব্যবসায়ী ও এলাকাবাসী নিয়ে উক্ত জুয়া খেলার বিরুদ্ধে জনস্বার্থেই প্রতিবাদ নিয়ে বিক্ষোভ করবো।’

ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবের সভাপতি মো: কামরুজ্জামান জানান, ‘ওই মেলার বিষয়ে আমি কিছুই জানি না এবং জানার আগ্রহ নেই।’

মেলা পরিচালনা কমিটির আহবায়বক মেয়র যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা আবুল খায়ের পাটওয়ারী পৌরকার্যালয়ে সাংবাদিককে বলেন, ‘উক্ত মেলা নিয়ে কোন বাণিজ্যের সুযোগ নেই। আজ অথবা কালকে থেকে বিজয় মেলা মঞ্চে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ নিয়ে আলোচনা ছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠান করার সিদ্ধান্ত রয়েছে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, মেলা বিক্রির যে অপপ্রচার হচ্ছে তা সঠিক নয়। যে ব্যক্তিটি মেলা চালায় ইতিপূর্বে এখানে এই মেলা চালাতে গিয়ে সেই লোকটার তার ব্যবসায়িক ভাবে লস (ক্ষতি) হয়েছে।’

ফরিদগঞ্জ থানার ওসি মো: শহীদ হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলায় প্রতিদিনই মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক আলোচনা হওয়া ছাড়াও বিভিন্ন সাষ্কৃতিক অনুষ্ঠান ও নাটক মঞ্চস্ত হলে মেলাটি প্রানবন্ত হতো বলে আমি মনে করি।’

প্রতিবেদক: শিমুল হাছান, ১২ ডিসেম্বর ২০২২