Home / উপজেলা সংবাদ / ফরিদগঞ্জ / ফরিদগঞ্জে দুটি ভিডিও নিয়ে তোলপাড়, ধর্ষকের মামলায় জেল খাটতে হল তরুণীকে
ভিডিও

ফরিদগঞ্জে দুটি ভিডিও নিয়ে তোলপাড়, ধর্ষকের মামলায় জেল খাটতে হল তরুণীকে

নিকোষ কালো অন্ধকারে বা ঘরের নিভৃত কোনে যা নিতান্তই লোকচক্ষুর আড়ালে ঘটা কোন অনৈতিক কর্ম ভিডিও প্রযুক্তির অপব্যবহারের কারণে জনসম্মুখে এসে পড়ে। তখন সমাজে থাকা কিছু লোক দুই ধরনের কর্ম করে।

প্রথমত ওই ভিডিও চিত্র নিয়ে কিছু লোক ঘটনার শিকার নারীকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত কিংবা কৌশলে তার দুর্বল স্থানে আঘাত করে নিজেও এর ভাগিদার হতে চায়। আবার কিছু লোক সেই ভিডিও ফাঁস করে দেয়ার হুমকি দিয়ে প্রতারণা বা অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ফাঁদ পাতে। অপকর্মকারী অর্থ বৈভবের মালিকরা অর্থ দিয়ে ওই ঘটনা থেকে মুক্তি বা কৌশলে আইনের আশ্রয় নিয়ে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু নিগৃহিত হয় ওই তরুণী। তাকে কৌশলে ফাঁদে ফেলে তার সর্বস্ব লুটে নেয়া ছাড়াও তাকে সমাজে নষ্টা বলে প্রমাণ করতে উঠে পড়ে লাগে সুবিধাভোগী চক্র। হয়তবা শেষ পর্যন্ত এসব নারীকে নিজের অপমান থেকে বাঁচার জন্য পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়।

এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে। হতভাগা এক তরুণীকে ২২দিন জেল খাটতে হয়েছে। যদিও ওই তরুণীর সাথে দুই দফায় অনৈতিক কর্ম করা দুই জন এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছেন। নিজেরা বাঁচার জন্য আদালত ও থানার দ্বারস্থ হয়েছেন। যদিও শেষ পর্যন্ত ওই তরুনীর পরিবার তার পাশে দাঁড়িয়ে আদালতে ধর্ষণ ও প্রতারণা করার অভিযোগে মামলা দায়ের করেছে। এখন তারা প্রকৃত ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত দাবী করছেন। প্রভাবশালীদের ভয়ে বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন ধর্ষিতা, তরুণীকে রক্ষা করতে রেখেছেন পর্দার অন্তরালে।

তরুণীর পক্ষের দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত দুই বৃদ্ধের মধ্যে একজন ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার পল্লী চিকিৎসক আ: কুদ্দুছ ও অপরজন চাঁদপুর সদর উপজেলার সাপ্দী গ্রামের গ্রাম্য মাতব্বর জুনাব আলী তালুকদার।

ভিডিও

এছাড়া তৃতীয়জন অশ্লীল ভিডিও ধারণ ও তা দিয়ে প্রতারণার ঘটনায় অভিযুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার সুমন পাটওয়ারী। অপরদিকে, ওই তরুণীসহ আরো কয়েকজনকে জড়িয়ে ওই দুই বৃদ্ধ ভিডিও পাইরেসী ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে চাঁদপুর মডেল ও ফরিদগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। উভয় মামলায় তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে তার নানা ও নানী এবং এর বাইরে আরো কয়েকজনকে আসামি করা হয়।

এদিকে দুটি ঘটনার একে অপরের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা, প্রতারণা, সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।আশ্চর্য্যের বিষয় হলো দুই বৃদ্ধের দায়ের করা মামলা ধরণ ও লেখা প্রায় হুবহু। একজন অপর জনের বন্ধু। একজন তাদের বন্ধুত্বের কথা স্বীকার করলেও অপরজন অস্বীকার করেছেন। সর্বশেষ দায়েরকৃত মামলায় একটি গণস্বাক্ষর যুক্ত করা হয়েছে। যাতে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার একজন কাউন্সিলর ও ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে। ফলে পুরো ঘটনাটিকে জটিল করে তুলেছে। তাই এসব ঘটনার জন্য প্রকৃত ভাবে কে দায়ী তা সঠিক তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই।

তরুণীর দায়েরকৃত মামলা সূত্র ও এলাকায় গিয়ে জানা যায়, গত ৫ বছর পূর্বে পিতা মারা যাওয়ার পর মায়ের সাথে সঙ্গে নানার বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চররাঘবরায় গ্রামে বসবাস করতো তরুণী (২০)। পড়ে লেখাপাড়ার জন্য সে খালার বাড়ি পাশ্ববর্তী হাইমচর উপজেলা চলে যায়। বর্তমানে কলেজে অধ্যয়নরত ওই তরুণীক করোনার কারণে গত এক বছর ধরে নানা বাড়ি মায়ের কাছেই থাকে। একই বাড়ির হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আ: কুদ্দুছ সম্পর্কে তার নানা হয়। পিতার পরিচয় সূত্র ধরে তাদের সর্ম্পক থাকলেও তার পিতার সাথে রাজনৈতিক দ্বন্ধের জের ধরে সর্ম্পকের অবনতি হয়। পরে আবার তরুণীর পিতার মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে পুনরায় যোগাযোগ শুরু হয়।

এরই মধ্যে ২০২০ সালের ৭ আগস্ট ওই তরুনীর মা বাড়িতে না থাকার সুযোগে কৌশলে আ: কুদ্দুছ রাতে ওই তরুণীর ঘরে ঢুকে নানা নাতনির খুনসুটির এক পর্যায়ে তাকে বিয়ের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। এসময় অনৈতিক ঘটনাটি ভিডিও ধারণ করা হয়।

পরবর্তীতে ওই ভিডিও দেখিয়ে সেটি ফেরত দানের আশ্বাসে তরুনীকে চাঁদপুর শহরের নাজির পাড়ায় একটি বাসায় নিয়ে আ: কুদ্দুছের বন্ধু জুনাব আলীও গত ১৫ নভেম্বর তার সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। ওই ঘটনাটি সেখানে থাকা সুমন পাটওয়ারী তার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে। সেই ভিডিও দেখিয়ে আবার সুমন পাটওয়ারীসহ একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় নামে।

সর্বশেষ ঘটনার আলোকে জুনাব আলী বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এবং এরসাথে চররাঘররায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা নানীকে অভিযুক্ত করে চাঁদপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলাটি পরে চাঁদপুর ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

আরও পড়ুন… ফরিদগঞ্জে প্রবাসীর স্ত্রীকে লঞ্চের কেবিনে ধর্ষণ, অভিযুক্ত আটক

মামলার সূত্র ধরে গত ৪ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ তরুণী ও আতিকুর রহমান রাজুকে আটক করে। এ সময় ৬টি মুঠো ফোন জব্ধ করে। সে মামলায় ২২দিন জেল খাটার পর গত ২৫ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পায় তরুণী।

অপরদিকে, অপর অভিযুক্ত হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক আ: কুদ্দুছও বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এর সাথে চররাঘবরায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা নানীকে অভিযুক্ত করে গত ২৪ জানুয়ারী ফরিদগঞ্জ থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলাটির বর্ণিত বিবরণ প্রায় অনুরূপ জুনাব আলী মামলার বিবরণ সাথে।

এরপর সর্বশেষ তরুণী মা বাদী হয়ে ঘটনার সাথে আ: কুদ্দুছ ও জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারীকে অভিযুক্ত করে ১ মার্চ চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা দায়ের করলে বিজ্ঞ আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নিদের্শ দেয়।

মামলার বিষয়ে তরুণীর মা জানান, আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী আ: কুদ্দুছ তার বন্ধু জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারী আমাদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। ফলে লোকলজ্জা ভুলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা সঠিক তদন্ত ও ন্যায় বিচার কামনা করছি।

তিনি জানান, প্রভাবাশালীদের আতংকে আমার মেয়েকে বর্তমানে আত্মগোপনে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তার পরিবার বর্তমানে আতংকগ্রস্থ।

তরুণীর মামলায় অভিযুক্ত জুনাব আলী মুঠো ফোনে জানান, ওই তরুণী আমার স্ত্রীকে বোন বলে সম্বোধন করে সে সূত্রে আমাকে দুলাভাই বলে ডাকতো। একদিন আমি চাঁদপুরে যাওয়ার পর সে আমাকে চাঁদপুর সদরে পাটওয়ারী বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে নিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করে। তাই আমি ওই তরুণীসহ প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এ সময় তিনি চররাঘবরায় গ্রামের হোমিও চিকিৎসক আ: কুদ্দুছকে চিনেন না বলে জানান।

অপর অভিযুক্ত হোমিও চিকিৎসক আ: কুদ্দুছ জানান, ওই কিশোরী আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে সে আমাকে দিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেছে। আমার সাথে অনৈতিক ঘটনার ভিডিও দিয়ে আমার কাছ থেকে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। তিনি জানান, জুনাব আলী তার দোকানে আসা যাওয়ার সূত্র ধরে তাকে চিনেন ও পরিচয় রয়েছে।

চিকিৎসক আ: কুদ্দুছ এর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের এস আই আ. কুদ্দুস জানান, মামলার প্রধান অভিযুক্ত তরুণী ও ২ নং আসামী আতিকুর রহমান রাজু জেলে থাকায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত চলছে। তিনি আরো জানান, বিচার সবার জন্য সমান, আইনকে কেউ যদি ফাঁকি দেয় তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে।

জুনাব আলীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর ডিবি পুলিশের এস আই তৌফিকুল আফসার মুঠো ফোনে জানান, ঘটনার ব্যাপারে তিনি অনেকদুর এগিয়েছেন। শিঘ্রই মামলার চার্জশীট প্রদান করা হবে।

এদিকে তরুণীর আইনজীবি অ্যাড.সাইয়্যেদুল ইসলাম বাবু জানান, জুনাব আলীর দায়েরকৃত মামলার ভিডিওচিত্র পাইরেসী করা হয়েছে বলে যেই অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়।, ভিডিওটি পাইরেসী নয়, আদালত বিষয়টি পর্যবেক্ষনে এনেছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানায়, ধর্ষিতার পরিবারটি অসহায়, নিরীহ হওয়ার কারনে উল্টো জেল খেটেছে। এসব ঘটনায় প্রকৃতভাবে কারা জড়িত এবং কিভাবে সংঘটিত হচ্ছে, তার একটি সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ধরে রাখতে তা জরুরী ।

এ ব্যাপারে স্থানীয়রা জানান, ভুক্তভোগী পরিবারটি অসহায়-নিরীহ হওয়ার কারণে তারা উল্টো জেল খেটেছে। এসব ঘটনায় প্রকৃতভাবে কারা জড়িত এবং কীভাবে সংঘটিত হচ্ছে, তার একটি সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।

প্রতিবেদক:শিমুল হাছান,৯ মার্চ ২০২১