চাঁদপুর

প্রেম প্রতারণায় চাঁদপুরের স্কুল শিক্ষিকার ‘অশ্লীল ছবি বাণিজ্যে’ সর্বস্বান্ত প্রবাসী

চাঁদপুরে কথিত সুন্দরী এক স্কুল শিক্ষিকার প্রেম প্রতারণা ও বিয়ের প্রলোভনে ‘অশ্লীল-নগ্ন ছবির বাণিজ্যে’ লন্ডন প্রবাসী যুবকের ১৫ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে একাধিক প্রমাণ, অডিও রেকর্ড ও ওইসব আপত্তিকর ছবি চাঁদপুর টাইমস প্রতিবেদকের কাছে প্রদান করা হয়েছে। এ বিষয়ে দীর্ঘ সময় ধরে অনুসন্ধানে ওই স্কুল শিক্ষিকার বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসে আরো প্রতারণার চিত্র।

অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু ওই যুবকই নয় এর বাইরের কথিত সুন্দরী ওই স্কুল শিক্ষিকা বিভিন্ন ছেলেদের সাথে প্রেমের ছলনায় সেলফি স্টাইলে ‘ন্যুড ছবি’ পাঠিয়ে ও দৈহিক মেলামেশার সুযোগ পাশাপশি বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নগদ অর্থ, মোবাইল রিচার্জ. বিকাশের মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে একাধিক প্রমাণ প্রতিবেদকের কাছে উপস্থিত হয়েছে।

কথিত এ সুন্দরী চাঁদপুর শহরের ১২৮ নং আক্কাছ আলী রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা শাহজাদী আরাফাত শিউল।

সেলফি তুলে শিউলের পাঠানো একটি ছবি

লন্ডন প্রবাসী নীরব হোসেন (ছদ্মনাম) জানায়, শিউলে সাথে প্রায় বছরখানেক পূর্বে ফেসবুক প্রোফাইলে সুন্দর ছবি রাখার সুবাধে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠে। তারপর থেকে দু’জনের ফেসবুক ম্যাসেঞ্জার কথা হতো। এক সময় শাহজাদী আরাফাত শিউল তাকে ন্যুড ছবি, অশ্লীল অঙ্গভঙ্গির ভিডিও পাঠাতে শুরু করে। এর মধ্যে দু’জনে ‘কথিত প্রেমের’ সম্পর্ক তৈরি হয়।

সম্পর্ক কিছুটা দীর্ঘ হলে প্রবাসী নীরব তাকে ‘বিশ্বাস’ করে তার পরিবারের সকলের সাথে মুঠোফোনে কথা বলতে শুরু করে, পারিবারিকভাবে তাদের দুজনের বিয়ে হবে এমন ‘আশ্বাসও’ দেয়া হয়। এ ছলে শাহজাদী আরাফাত শিউল ওই প্রবাসীর কাছে নিজেকে ‘হতদরিদ্র’ পরিচয় দিয়ে অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেমে ক্রমান্বয়ে টাকা নিতে শুরু করে।

অনলাইন ব্যাংকিংয়ে পাঠানো টাকার রশিদ

ওই প্রবাসীও তাকে জীবনসঙ্গিনী হিসেবে পাওয়া আকাংখায় ২০ হাজার থেকে শুরু ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিভিন্ন অংকের টাকা অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেমে পাঠিয়েছেন। এ বিষয়ে একাধিক রশিদ প্রতিবেদকের কাছে দিয়েছেন ওই প্রবাসী।

বড় পরিমাণ ছাড়াও তার (শিউল) অনুরোধে বিকাশের মাধ্যমেও বিভিন্ন অংকের টাকা পাঠাতো।

প্রবাসীর অভিযোগে আরো জানা যায়, চাঁদপুর পুরাণবাজার আক্কাছ আলী রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি হবে (যদিও সে আগ থেকেই ওই স্কুলে চাকরি করে আসছেন) এ জন্য ‘জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আক্তার হোসেনকে’ ‘ঘুষ’ দেয়ার নাম করে নীরবের কাছ ৫ লাখ টাকা থেকে ধার হিসেবে নেন।

এসব এককালীন টাকার বাইরেও হাত খরচের নাম করে মাসিক ২০ হাজার টাকা করে শিউলকে পাঠিয়েছেন বলে প্রবাসী নিরব জানিয়েছেন। প্রবাসীর দেয়া তথ্যমতে প্রায় ১৫ লাখ টাকা শাহজাদী আরাফাত শিউল বাংলাদেশে এনেছেন।

অনলাইন ব্যাংকিংয়ে পাঠানো টাকার রশিদ

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিউলের এক সহকর্মী সূত্রে জানা যায়, ‘চাকরির নাম করে আনা ওই ৫ লাখ টাকা থেকে জেলা শিক্ষা অফিসারকে ১ টি করে ফ্রিজ, সোফাসেট ও মাইক্রো ওভেন কিনে দেন। এর সাথে ওই সময়ই শিউল তার নিজের জন্য একটি ফ্রিজ ক্রয় করেন।’

এ সুবাধে শিউল নিজেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের শ্যালিকা বলে তার কর্মস্থলে অত্যন্ত দাপটের সাথে চলে বেড়ান বলে জানান তার একাধিক সহকর্মী।

একাধিক সূত্রে পাওয়া অভিযোগে সম্পর্কে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. আক্তার হোসেনের সাথে মুঠোফোনে জানতে চাইলে, তিনি অভিযোগটি না শুনেই স্পষ্ট বলে দিলেন, ‘সাংবাদিককে ফোনে কোনো বক্তব্য দিতে পারবো না।’

এ বলে অপ্রাসঙ্গিক একটি বিষয় তুলে ধরে চাঁদপুর থেকে জাতীয় দৈনিকে কাজ করেন এমন দু’জন সিনিয়র সাংবাদিককে গালমন্দ করেন।

তার স্বচ্ছতা প্রমাণে মুঠোফোনে প্রতিবেদককে বিভিন্ন বিষয়ে বুঝানোর চেষ্টা করেন ও সরাসরি তার সাথে সাক্ষাতের অনুরোধ জানান।

শিক্ষা কর্মকর্তার অনুরোধকে সম্মান জানিয়ে তার বেঁধে দেয়া সময় মতো প্রতিবেদক শিক্ষা অফিসে গেলে এক দেড় ঘণ্টা অপেক্ষা করেও তাঁকে পাননি।

অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে তার (প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা) মোবাইল নম্বরে একাধিকবার কল দিলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

এরপর আরো ৩/৪ দিন অপেক্ষা করে পুনরায় শিক্ষা অফিসারের কাছে গেলে তিনি নিজেকে অনেক ব্যাস্ততায় আছেন এবং বক্তব্য দিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।

যতবারই এ ব্যাপারে তার কাছে বক্তব্যর জন্য যাওয়া হয়েছে এবং তার শ্যালিকা পরিচয় দিয়ে শিউলের অনৈতিক কর্মকান্ডের চালিয়ে যাচ্ছেন এমন অভিযোগে কথা বলতে চাওয়ায় তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে  ভোক্তভুগী প্রবাসী নিরবের কাছে শিউলের রহস্যময়ী চরিত্র আরো উন্মোচন হতে থাকে। তার কাছে প্রমাণ মিলে যে, শিউল একাধিক প্রবাসী যুবকের কাছ থেকে একই পদ্ধতিতে ন্যুড ছবি পাঠিয়ে প্রলোভনের মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

প্রবাসী নিরব জানায়, যখন শিউলের আরো কিছু খোলামেলা ছবিও ওইসব অন্য প্রবাসীরা তার কাছে পাঠায়, তখন সে শিউল ও তার পরিবারের বিষয়ে অন্ধ ধারণার অবসান ঘটিয়ে প্রতারণা জালে আটকে যাওয়ার বিষয়টি আঁচ করতে পারেন।

ওই যুবকরা কেন বিষয়টি নিয়ে আইনের আশ্রয় নেননি? এর প্রশ্নের জবাবে প্রবসী নিরব তাদের বরাত দিয়ে জানায়, ‘ওই সব প্রবাসীদের পরিবারের সকলে দেশে থাকে এবং তারা অবিবাহিত। তাই বিষয়টি নিয়ে পুরুষ হয়েও লোকলজ্জার ভয়ে কেউ প্রশাসন কিংবা গণমাধ্যমকে জানাতে আগ্রহ করেননি।’

শিউল স্কুল ছুটির দিনে লঞ্চযোগে ঢাকা গিয়ে আরো একাধিক যুবকের সাথে সময় কাটিয়েছেন বলে প্রবাসী ওইসব যুবকদের বরাত দিয়ে নিরব জানিয়েছেন। তাদের দাবি শিউলের পাঠানো সেলফি স্টাইলে নগ্ন ছবির পেছনের ব্যাকরাউন্ড দেকে বিষয়টি নিশ্চিত হন বলে জানান।

প্রথমম এ ধরণের পূর্ণ ছবি দিয়েও প্রবাসীদের আকৃষ্ট করতেন শিউল, (ছবিটি তার স্কুল আঙ্নিা থেকে তোলা হয়েছে বলে প্রাথমিক সূত্রে জানা গেছে।)

এসব কিছু থেকে যখন প্রবাসী নিরব যখন বুঝতে পারে সে প্রতারণার জালে আটকে গেছে, তখন সে এ থেকে পরিত্রাণ হিসেবে তার টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করে। তখনি সাথে তার ছলনাময়ী সর্ম্পকের অবসান ঘটতে শুরু করে।

টাকার জন্যে তাকে মাঝে মধ্যে ফোন করলেও তিনি প্রবাসী নিরবের ফোন রিসিভ করা বন্ধ করে দেন। মাঝে মাঝে কল রিসিভ করলেও এ প্রান্ত থেকে নিরবকে কোনো উত্তর দেয়া হতো না।

প্রবাসীর দাবি তার কাছে পাওনা এ টাকাগুলো যদি উত্তোলন করা যায় তাহলে সেগুলো তিনি গরীব অসহায়দের মাঝে বিলিয়ে দিবেন।

এ বিস্তর অভিযোগ নিয়ে সরাসরি স্কুল শিক্ষিকা শাহজাদী আরাফাত শিউলের সাথে কথা হলে তিনি সর্ম্পকের কথা স্বীকার করে বলেন ‘সে (প্রবাসী) টাকা দিয়েছে ঠিক তবে তা ১৫ লাখ নয় ৩ লাখ টাকার মতো হবে। যার রিসিট আমার কাছে রয়েছে। এর বাইরে তার হাত খরচের জন্য প্রতিমাসে যে ১৫/২০ হাজার টাকা করে বিকাশে দিয়েছেন তা মিথ্যে এবং তার এক ভাইয়ের কাছে ৪০ হাজার টাকা দিয়েছি বাকিটা পরে দিবো।’

টাকাগুলোর রশিদ সাংবাদিকদের কাছে রয়েছে, ওই প্রবাসীকে টাকাগুলো ফেরত কবে নাগাদ দেয়া হতে পারে, জানতে চাইলে শিউল বিষয়টি এড়িয়ে যান।

শিউলের নিজের তোলা সেলফি স্টাইলে অশ্লীল, অর্ধ নগ্ন ছবিগুলোর বিষয়ে জানতে চাইলে অনেকটা দাম্ভিকতার সাথে তিনি জানান, ‘আমি জানি আপনার কাছে কি থাকতে পারে। শুধু আপনার কাছে কেনো? আমার এসব ছবি আরো অনেকের কাছেই রয়েছে। কারণ আমার বিরুদ্ধে নিউজ করার জন্য এগুলো সে বিভিন্ন জনকে দিয়েছে।’

আপনি একজন স্কুল শিক্ষিকা আপনার মতো সম্মানী মানুষের এমন অশ্লীল ছবি মানুষের কাছে থাকবে কেনো? প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি কথা এড়িয়ে গিয়ে বলেন ‘নিউজ করার দরকার নাই আপনি যদি নিউজ করেন তাহলে আমিও ব্যবস্থা নিবো।’

এ বলে তিনি এ প্রতিবেদকের বিরুদ্ধে মামলা দেয়ার হুমকি প্রদান করেন।

একপর্যায়ে প্রতিবেদককে কৌশলে অনৈতিক অর্থের প্রস্তাব দিয়ে শিউল বলে ফেলেন ‘আপনি একটু শুক্রবারে এসে দেখা করবেন। আমার এক ভাই আপনার সাথে কথা বলবে।’

পরে শিউল তার পরিবারের কয়েকজন মিলে নিউজ না করার জন্য প্রতিবেদককে অনুরোধ জানান।

ওই প্রবাসীর সাথে লেনদেন সমাধান করে নেয়ার অনুরোধে হিসেবে কয়েকদিন পর তার মুঠোফোনে কথা বলতে চাইলে শিউল প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমি এখন কথা বলতে পারবো না, আপনি কি পুলিশ? যে অভিযোগ নিয়ে ঘুরে বেড়ান।’ এ বলে লাইন কেটে দেন।’

এদিকে প্রাবাসী নিরব তার টাকা ফেরত পাওয়ার দাবি জানিয়ে অ্যাড. মনির হোসেনকে দিয়ে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারের কার্যালয়ে একটি লিখিত অভিযোগ প্রেরণ করেন। যার একটি কপি এ প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।

খবর নিয়ে জানা যায় তার এমন প্রতারণার কথা তার কর্মস্থল চাঁদপুর আক্কাছ আলী রেলওয়ে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকর্মীরা জানেন। তবে শিউল নিজেকে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তার শ্যালিকা পরিচয় দিয়ে দাম্ভিকতা নিয়ে চলা ফেরা করায় কেউই কিছু বলতে সাহস পাননি।

তার কর্মস্থলে গিয়ে ওই স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা রুবিনা বেগমের সাথে এ বিষয়ে জানতে চাইলে, তিনি পুরো ঘটনা অনেকটা নিশ্চয়তা দিয়েই অস্বীকার করেন। আরো দাবি করেন, ‘বিষয়টি শিউলের ব্যাক্তিগত ব্যাপার এ বিষয়ে আমরা কিছুই জানিনা।’

শিক্ষা অফিস থেকে শিউলের বিরুদ্ধে কোনো তদন্ত আসছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন ‘এখনো এমন কোনো তদন্ত আসেনি তবে শুনেছি কি যেনো একটা নোটিশ আসবে।’

অথচ ওই বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট ক’জন ব্যাক্তি প্রতিবেদকের কাছে প্রকাশে অনিচ্ছুক হয়ে জানান, ‘শিউলের এ ঘটনা প্রধান শিক্ষিকা ধামাচাপা দেয়ার জন্য নগদ ১ লাখ টাকা নিয়েছেন।’

এদের একটি সূত্র জানায়, প্রধান শিক্ষকের বক্তব্য নিয়ে আসার পরপরই অন্যান্য শিক্ষকদের সামনে ওই প্রধান শিক্ষিকা সাংবাদিকের পেশা তুলে ধরে গালাগাল করেছেন।’

(কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের সম্মানহানির জন্য চাঁদপুর টাইমস এ সংবাদটি প্রকাশ করেনি, ভুক্তভোগী প্রবাসীদের অর্থ ফেরত পেতে ও অন্যান্য প্রবাসীরা প্রতারণা থেকে সতর্ক থাকাটাই এ প্রতিবেদনের উদ্দেশ্যে- সম্পাদক)

: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১:৩০ পিএম, ২৬ আগস্ট ২০১৬, শুক্রবার
কেএমআইজে/ডিএইচ

About The Author

প্রতিবেদক- কবির হোসেন মিজি
Share