ছোটভাইকে দিয়ে স্বামীর জন্য লাল গোলাপ কিনে বাসায় নেন রুমি। ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে সেই ফুল দিয়ে স্বামীকে ‘উইশ’ করেন। এর দু’দিন পরই স্বামীর হাতে প্রাণ দিতে হল রুমিকে। পরিবারের অভিযোগ, নির্যাতনের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয় রুমিকে।
প্রেমের কারণে পরিবারের অমতেই যে তরুণের হাত ধরে চলে এসেছিলেন শ্বশুরবাড়িতে, বিয়ে করা সেই সুদর্শন তরুণই যে এক বছর না যেতেই আসক্ত হবেন ইয়াবায়, মজে যাবেন পরকীয়ায়, তা বিশ্বাসই করতে পারেননি রুমি। এর প্রতিবাদ ও স্বামীকে সুপথে ফেরানোর চেষ্টা করতে গিয়েই শেষ পর্যন্ত প্রাণ দিতে হল তাকে। চট্টগ্রামের হালিশহর থানার শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার বাসায় ১৭ ফেব্রুয়ারি রাতে এ ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় রুমির ঘাতক স্বামী ইফতিকে গ্রেফতার করে হালিশহর থানা পুলিশ।
হালিশহর থানার ওসি মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘যদিও শ্বশুরবাড়ির লোকজন এটা আত্মহত্যা বলে দাবি করছে; কিন্তু রুমির শরীরে বিভিন্ন স্থানে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। তার স্বামীর সঙ্গে অন্য তরুণীর পরকীয়ার সম্পর্ক ছিল, তা-ও আমরা জেনেছি। পেয়েছি ওই তরুণীর সঙ্গে ইফতির বেশকিছু অন্তরঙ্গ ও নগ্ন ছবি। আমরা ওই ঘটনায় হত্যা মামলা গ্রহণ করেছি। আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। নিহতের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে।’
চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পাইরোল গ্রামের মৃত এমএ মান্নানের মেয়ে কামরুন্নাহার রুমি। আর আনোয়ারা উপজেলার শোলকাটা গ্রামের কামাল উদ্দিনের ছেলে ইফতেখার হাসান ইফতি। রুমিরা থাকত নগরীর ডবলমুরিং থানার মনসুরাবাদ নিরিবিলি আবাসিক এলাকায়। ইফতির বাসা হালিশহর শান্তিবাগ আবাসিক এলাকার ছকিনা মহলে।
এক বছর ধরে ইফতি ও রুমি প্রেম করছিল। এ সম্পর্কে রুমির পরিবারের মত না থাকায় ১০ লাখ টাকা কাবিনে ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট গোপনে বিয়ে করেন দু’জন। গত বছরের ২৫ মে আনুষ্ঠানিকভাবে ইফতি ঘরে তুলে নেন রুমিকে। ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে ভালোই কাটছিল রুমির নতুন সংসার জীবন। কিন্তু বিয়ের কয়েক মাস না যেতেই ইফতিকে ধীরে ধীরে বদলে যেতে দেখে রুমি। ইয়াবা আসক্ত হয়ে পড়েন ইফতি। একপর্যায়ে জড়িয়ে পড়েন পরকীয়ায়। দু’মাস আগে থেকে ইয়াবা ও পরকীয়ায় বেপরোয়া হয়ে উঠেন ইফতি। ফেসবুকে দিনরাত চ্যাট করতে থাকেন অন্য মেয়ের সঙ্গে। রাত করে বাসায় ফেরেন। এমনকি অন্য মেয়ের সঙ্গে আপত্তিকর অবস্থায় তোলা ছবি ও অবাধ মেলামেশার বিষয়টিও স্ত্রীর কাছে আর গোপন রাখননি। প্রতিবাদ ও স্বামীকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করতে গিয়েই শুরু হয় সংসারে অশান্তি। এরপরও স্বামীকে সুপথে ফেরানোর জন্য ধৈর্যধারণ করেন। কিন্তু এ ধৈর্যধারণই যেন তার জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রুমির বড়ভাই ইফতেখার হাসান মাসুম জানান, রুমি ১৬ ফেব্রুয়ারি রুবেল নামে তার এক নিকটাত্মীয়কে (মামাতো বোনের স্বামী) ফোন করে। জানায়, ইফতি তাকে বেশ যন্ত্রণা দিচ্ছে। তার সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ আচরণ করছে। হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে রুমি। একই দিন তার এক মামিকেও ফোন করে রুমি। স্বামীর নির্যাতনের কথা জানায়। তখনও রুমি কান্নাকাটি করে। রুমির মামি বিষয়গুলো তার (রুমির) ভাসুরসহ শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে জানাতে বলে। প্রত্যুত্তরে রুমি বলে, ‘ওরা আমার কথায় পাত্তা দেবে না।’
১৬ ফেব্রুয়ারি দুপুরে যখন রুবেলকে ফোন করে স্বামীর নির্যাতনের কথা জানায় রুমি, তখন রুবেল জানান, পরদিন (১৭ ফেব্রুয়ারি) দুপুরে এসে রুমিকে বাপের বাড়ি নিয়ে যাবেন। কিন্তু রুমি ওই দিন (১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে ফোন করে আবার রুবেলকে জানান, আরও কয়েকটা দিন সে ধৈর্য ধরে দেখবে। স্বামীকে সুপথে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করবে। ইফতি যে তরুণীর সঙ্গে পরকীয়ায় মত্ত; সেই তরুণীর সঙ্গে ইফতির বেশ কিছু আপত্তিকর ও নগ্ন ছবিও হাতে আসে রুমির। এসব বিষয় সে (রুমি) তার স্বজনদের জানায়।
রুমির ছোট ভাই কলেজপড়ুয়া মনিরুল হাসান মাহির জানায়, ‘আপু (রুমি) আমাকে ১৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ফোন করে বলে একটি লাল গোলাপ কিনে নেয়ার জন্য। ওই রাতেই একটি লাল গোলাপ কিনে বাসায় দিয়ে আসি। তখন আপু বলে, কাল ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস। তোর দুলাভাইকে উইশ করব। কিন্তু এর দু’দিন পরই যে আমার আপুকে এভাবে মেরে ফেলবে, ভাবতে পারিনি।’
মাহির জানায়, ১৭ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে ১০টার দিকে তাকে (মাহিরকে) ফোন করে তার দুলাভাই ইফতি। জানায়, তার বোন রুমি আত্মহত্যা করেছে। সে কয়েকজন বন্ধুবান্ধব নিয়ে দ্রুত ছুটে যায় বোনের হালিশহরের বাসায়। দেখে বোনের লাশ পড়ে আছে একটি খাটে। অন্য রুমে গিয়ে দেখতে পায় রক্তের দাগ। গলায় ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যার কথা বলা হলেও আগেই লাশ কেন নামানো হল, অন্যরুমে রক্তের দাগ কেন, হাতে- চোখে মারাত্মক জখমের চিহ্ন কেন- এসব প্রশ্নের উত্তর জানতে চায় ইফতির কাছে। কোনো উত্তর দিতে পারে না। ‘ঘাতক’ দুলাভাই এরই মধ্যে পালানোর পাঁয়তারা করছিল। যাতে সে বাসা থেকে বের হতে না পারে, সেজন্য বন্ধুবান্ধব মিলে পাহারা দিয়ে রাখে বাসার গেটে। এরপর পুলিশ এসে হত্যার আলামত দেখে ইফতিকে গ্রেফতার করে। বোনের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠায় মর্গে।
রুমির বড়ভাই মাসুম জানান, তারা বাবা প্রবাসে ব্রেন স্ট্রোকে মারা যান। মা মারা যান ক্যান্সারে। মা মারা যাওয়ার আগে বোন রুমির নামে ১০ লাখ টাকা এফডিআর করে যান। ম-বাবাহীন বোনকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল। গোপনে বিয়ে করায় তার রাগও ছিল রুমির ওপর। এ কারণে শ্বশুরবাড়ির যন্ত্রণা ও কষ্টের বিষয়টি তাদের জানায়নি রুমি। কিন্তু এক বছর না যেতেই যে এভাবে তার বোনকে মেরে ফেলবে, সেটা বিশ্বাস করতে পারছেন না। বোনের মৃত্যুর খবর শুনে মাসুম বিদেশ থেকে ছুটে আসেন। লাল বেনারসিতে দেখতে পারেননি বোনকে। সাদা কাফনে বাবার কবরের পাশে শুইয়ে দিয়েছেন। বোনের বিয়ের জন্য রাখা ১০ লাখ টাকাও পাষণ্ড স্বামী ইফতি আত্মসাৎ করেছেন বলে তিনি অভিযোগ করেন।
(জুম বাংলা)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩: ৪০ পি.এম ২৩ ফেব্রুয়ারি২০১৮শুক্রবার।
এএস.