নারী

ফেসবুকের ফাঁদে ফেলে তরুণীদের ব্ল্যাকমেইল

বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করার পর রাজধানীর মগবাজারের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে হয় সামিয়ার (ছদ্মনাম)। আগে থেকেই ফেসবুকে তার একটি অ্যাকাউন্ট ছিল। বিয়ের এক সপ্তাহ পর কে বা কারা মেয়েটির নামে আরেকটি অ্যাকাউন্ট খুলে নানা ধরনের অশ্লীল ছবি পোস্ট করা শুরু হয়।

পরিচিতদের মাধ্যমে বিষয়টি জানতে পেরে মেয়েটি মুষড়ে পড়ে। ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয় সংসার। পরে পুলিশকে জানালে পুলিশ সেই ফেক আইডির মালিককে গ্রেফতার করে। সেই ফেক আইডি চালাত মেয়েটির বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের এক বন্ধু।

রাজধানীর একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্সের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বখতিয়ারের সঙ্গে ফেসবুকে পরিচয় হয় ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ুয়া এক ছাত্রীর। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ওই ছাত্রীর সঙ্গে পরিচয়ের একপর্যায়ে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে সে। ওই ছাত্রীকে দিয়েই তার নগ্ন ছবি তোলায় বখতিয়ার।

পরে ওই ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে ছাত্রীর কাছ থেকে নানা সময়ে টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়। স্বর্ণালঙ্কারও নিয়েছে বখতিয়ার। পরে সেই ছাত্রী অতিষ্ঠ হয়ে অভিভাবককে জানায়।

পুলিশের কাছে অভিযোগ করা হয়। মোহাম্মদপুরের বাসা থেকে বখতিয়ারকে আটক করে পুলিশ। পরে তার ল্যাপটপ থেকে এরকম একাধিক মেয়ের নগ্ন ছবি উদ্ধার করা হয়।

যশোরের বকচর এলাকার এক গৃহবধূ (২৮) আত্মহত্যা করেন। আত্মহত্যার কারণ খুঁজতে যেয়ে পুলিশ ব্ল্যাকমেইলিং এর ঘটনা খুঁজে পায়। এ ঘটনায় পুলিশ গ্রেফতার করে গৃহবধূর ভাগ্নি জামাই টিটু শেখকে। টিটু পুলিশকে জানিয়েছে, মাথা ব্যথার ওষুধের কথা বলে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দেন তার মামিকে।

মামি ঘুমিয়ে পড়লে গোপনে তিনি তার কাপড় খুলে নানা ভাবে ছবি তুলে। পরে সেই ছবি দেখিয়ে তাকে ব্ল্যাকমেইল শুরু করে।

টিটু প্রায় ওই পর্নো ভিডিও দেখিয়ে দৈহিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকে। অব্যাহত ব্ল্যাকমেইলিংয়ে একপর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন মামি শাশুড়ি।

কিন্তু টিটু দৈহিক সম্পর্ক ছিন্ন করলে ওই পর্নো ছবি ইন্টারনেটে ছেড়ে দেবে বলে হুমকি দেয়। এরপরই তার মামি গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন।

নানাভাবে ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হচ্ছেন মানুষ। প্রযুক্তির উৎকর্ষের এই সময়ে নারীরা শিকার হচ্ছেন এমন অসংখ্য সাইবার ক্রাইমের। যার একটি বড় অংশই প্রকাশ্যে আসে না। সাধারণত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমগুলোয় এই অপরাধের প্রবণতা বেশি। ব্ল্যাকমেইলিংয়ের শিকার হয়ে কেউ আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন।

প্রতিশোধ নিতে কেউ আবার নিজেই অপরাধী হয়ে যাচ্ছে। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্ল্যাকমেইলিং শিকার হচ্ছে মূলত কাছের লোকজনের সঙ্গেই। কেউ এক সময় অচেনা ছিল, ফেসবুকের কারণে চেনা হয়ে যায়।

সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী নারীরা। সাইবার অপরাধের শিকার হওয়াদের ৪৪ শতাংশই মনে করেন—সাইবার অপরাধীদের তাত্ক্ষণিকভাবে শাস্তি দেওয়া গেলে দেশে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব। বাকিদের মধ্যে ২৯ শতাংশের পরামর্শ হলো আইনের প্রয়োগ বড়ানো।

২৭ শতাংশ সচেতনতা গড়ে তোলার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন। সাইবার অপরাধের শিকার প্রায় অর্ধেকের বেশি মানুষ আইনি সহায়তা নেন না। এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে— বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৬০ দশমিক ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে থাকেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। যা দেশের মোট জনসংখ্যার ২ দশমিক ১৫ ভাগ।

এই ব্যবহারকারীদের বিশাল অংশ তরুণ, যাদের বয়স ১৮-২৪ বছর। ৭৮ শতাংশ পুরুষ ও ২৪ শতাংশ নারী। তবে অসচেতনতার কারণে সাম্প্রতি এই মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের সাবচেয়ে বেশি অনিরাপদ হয়ে উঠছে। ফলে এদের একটি বড় অংশ সহজেই দেশের ভিতর ও বাইরে থেকে সাইবার হামলার শিকার হচ্ছেন। এতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। একই ধরনের অপরাধের শিকার হন ১২ দশমিক ৭৮ শতাংশ পুরুষ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক তৌহিদুর হক বলেন, মেয়েরা ফেসবুকে কে আসল কে নকল সেটা যাচাই-বাছাই না করে খুব বেশি খোলামেলা ভাবে ভার্চুয়ালি মিশে থাকে। এভাবেই একটু একটু করে তারা ফাঁদে পা দেয়। একজন টিনএজার গার্মেন্ট কর্মীও আজকাল স্মার্ট ফোন ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে।

অথচ ফেসবুকের সিকিউরিটি বা প্রাইভেসির বিষয়ে সে কিন্তু মোটেও সচেতন নয়। একই সঙ্গে বর্তমান যুগের বাবা মা এত বেশি ব্যস্ত থাকে যে তাদের সন্তান কী করছে সে বিষয়ে খেয়াল রাখে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অজ্ঞতা ও অতি আহ্লাদের জায়গা থেকে সন্তানদের হাতে এই বয়সেই একটি আইফোন ধরিয়ে দিয়ে দায় মুক্ত হয়। অথচ ১৮ বছর বয়সের নিচে সন্তানের হাতে যে ফোন দেওয়া ঠিক না সেটা তারা একবারও ভেবে দেখে না।

বার্তা কক্ষ

Share