চাঁদপুর শহরের পুরান বাজার পশ্চিম শ্রীরামদী ২নং বালিকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও শরীরচর্চা ছাড়াই ব্যাপক অনিয়মের মধ্যদিয়ে চলছে ওই বিদ্যালয়ের প্রতিদিনের শিক্ষা কার্যক্রম। বিদ্যালয়টিতে কোন প্রকার তদারকি না থাকায় প্রধান শিক্ষিকা ক্ষমা বনিকের খামখেয়ালী মতোই নিয়মিত স্কুল পরিচালনা হয়ে আসছে। তাই যা হবার তাই হচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোতে নিয়মিত বিদ্যালয়ের মাঠে দাঁড়িয়ে শিক্ষার্থীরা জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে ক্লাস শুরু করার নিয়ম থাকলেও এ বিদ্যালয়টিতে তা নেই। সর্বশেষ কবে যে শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়েছিলো এবং শরীর চর্চা করানো হয়েছে তা হয়তো ভুলে গেছেন প্রধান শিক্ষিকা নিজেই। শুধু তাই নয় এছাড়াও রয়েছে আরো ব্যাপক অনিয়ম শিক্ষার্থীদের চাঁদার টাকায় চলছে বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্ষমা বনিকের বাসার কাজের বুয়ার বেতন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় এলকার একাধিক ব্যক্তি এবং অভিবাবকরা জানান, এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্ষমা বনিক তার পছন্দ মতো দু,জন সহকারী শিক্ষক নিয়ে নিজের ইচ্ছেমত স্কুল পরিচালনা করে থাকেন। তিনি একদিকে যেমন বিদ্যালয়ে নিয়মিত আসেননি। অন্যদিকে আসলেও ১০ টা থেকে ১১ টার পরে আসেন। এছাড়া বাড়ির কাজের বুয়াকে বিদ্যালয়ে এনে কোন রকম ঝাঁড়ু দিয়ে থাকেন। কিন্তু ক্লাসরুম এবং টয়লেট গুলোতে কোন প্রকার পরিস্কার পরিছন্নতা নেই। আর এই ঝাঁড়ু দেয়া বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছে ১০ থেকে ২০ টাকা চাঁদা তোলে সেই টাকা দিয়ে বাসার কাজের বুয়ার মাসিক বেতন পরিশোধ করে থাকেন। একই সাথে ভর্তি বাবদ ১০০ থেকে শুরু করে বিভিন্ন অংকের টাকা, টিসিতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা এবং বিভিন্ন প্রত্যায়ন পত্রের জন্যও প্রধান শিক্ষিকা বিভিন্ন অংকের টাকা নিয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।
শুধু এখানেই শেষ নয় অনুসন্ধান করে জানা গেছে, বিদ্যালয়ের টুকিটাকি রিপারিং কাজের জন্য প্রতি বছর সরকারি ভাবে যে স্লিপ বরাদ্ধ পেয়ে থাকেন। বরাদ্ধকৃত সেই টাকা দিয়ে ঠিক মতো তেমন কোন কাজই করানো হয়নি। নামেমাত্র টুকিটাকি কাজ করিয়ে বিভিন্ন রিসিট/ভাউচার বানিয়ে স্লিপ বরাদ্ধের টাকার কাজের হিসেবের বিল করে থাকেন। এছাড়া বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে বিদ্যালয়ের সামনে থাকা হকারের কাছ থেকে বিভিন্ন পোষাক কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন প্রধান শিক্ষিকাসহ সহকারী বেশ কয়েকজন শিক্ষিকা।
সরজমিনে গিয়েও এমন অনিয়মের চিত্র দেখা গেছে। গত কয়েকদিন পূর্বে ওই বিদ্যালয়ে সরজমিনে দেখা যায়, দুপুর দেড়টার দিকে বিদ্যালয়ের সামনে গেটের কাছে ভ্যান গাড়ি ডেকে নিয়ে হকার কাছ থেকে পোষাক ক্রয় করছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকাসহ অন্যান্য সহকারী শিক্ষিকারা। তাদের এমন দৃশ্যের ছবি তুলতেই তারা দৌড়ে বিদ্যালয়ের শিক্ষক মিলানায়তনে চলে যান।
বিদ্যালয় ঘুরে দেখা গেছে স্লিপ বরাদ্ধের টাকায় যেসকল রিপায়ারিং কাজ করার কথা তার তেমন কিছুই করানো হয়নি। টলেটের দরজার সিটকানি, জানালার গ্লাস, দেয়ালের আস্তর, ইলেক্ট্রিক্যাল সুইচ, বোর্ড, সবই ভাঙ্গাচুর অবস্থায় রয়েছে। বিদ্যালয়ের সিঁড়ি রমের গ্লাস, দেয়ালের বিভিন্নস্থানে ফাটল, আস্তর খসে পড়া, এমনকি রং বিহিন দেয়ালে শ্যাওলা জমে রয়েছে। একই সাথে ২য় তলার টয়লেটে তালা ঝুলে আছে। নিচতলার টয়লেট খোলা থাকলেও অপরিছন্ন নোংরা পরিবেশেই টয়লেট ব্যবহার করছে শিক্ষার্থীরা। সে টয়লেটের উপরে থাকা স্যানাটারি পাইপ ভেঙ্গে চুড়ে মরিচা ধরে আছে। যদিও বিদ্যালয়ের এসব কাজ গুলো স্লিপ বরাদ্ধের টাকায় রিপায়ারিং মেরামত করার কথা। তার কিছুই মেরামত করেননি এই প্রধান শিক্ষক। নামেমাত্র টুকটাক কাজ করিয়ে প্রতিবছর বানানো ভাউচারে বিলের হিসেব দেখাচ্ছেন তিনি।
স্থানীয় এলাকার লোকজন এবং মুসল্লিরা অভিযোগ করে বলেন, জাতীয় সংগীত পরিবেশন এবং শরীরচর্চা করানো ছাড়াই প্রতিদিনের ক্লাস শুরু হয়ে থাকে এ বিদ্যালয়টিতে। স্থানীয়দের অভিযোগ স্কুল চলাকালীন সময়ে শিক্ষিকারা হকারদের কাছ থেকে কেনাকাটায় ব্যস্ত থাকেন। এসব বিষয়ে বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিও বেশ কয়েকদিন তাদেরকে ডাক দোহাই দিয়েছেন। তাতেও শৃঙ্খলায় ফিরেননি তারা। অন্যদিকে স্কুল লাগোয়া মসজিদে নামাজের সময়ও শিক্ষিকারা বেপর্দায় চলেফেরা করেন। এমনকি মসজিদে জামায়াতের সময় শিক্ষার্থীরা হইহুল্লুর করলেও তাদেরকে শৃঙ্খলায় ফিরিয়ে আনেননি শিক্ষিকারা। অর্থাৎ নামাজের সময় শিক্ষার্থীদেরকে কোন প্রকার ডাক দোহাই দেননি তারা।
জানা যায়, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরেই আখন বাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিতে ব্যাপক অনিয়ম হয়ে আসছে। কিন্তু কোন প্রকার জবাবদিহিতা এবং তদারকি না থাকায় এ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্ষমা বনিকই যেনো বিদ্যালয়ের হত্তাকর্তা। প্রধান শিক্ষিকার এমন নানা অনিয়মের বিরুদ্ধে অভিবাবক ও স্থানীয়দের মাঝে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা ক্ষমা বনিকের কাছে এমন অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি, প্রথমে বলেন, ২টা থেকে আড়াইটা পর্যন্ত বিরতি। সেজন্য বিরতির সময় আমরা এ সুযোগে হকারের কাছে কেনাকাটা করতে গিয়েছি।
এরপর স্কুলে জাতীয় সংগীত পরিবেশন ও শরীরচর্চা বিষয়ে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, আমরা করি, তবে আজকে করানো হয়নি। বাকি অন্যান্য প্রসঙ্গে কথা বলতে গেলে তিনি প্রশ্ন পত্র আনতে যাবেন বলে ব্যস্ততা দেখিয়ে কেটে পড়েন।
বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মোঃ রাসেল আখন্দের সাথে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি বলেন, হকারের কাছে কেনাকাটার বিষয়ে আমিও কয়েকদিন দেখিছি এবং মসজিদের ইমাম সাহেবের অভিযোগ শুনে তাদেরকে ডাক দোহাই দিয়েছি। কিন্তু তাতেও পরিবর্তন হয়নি। তিনি বলেন, স্লিপ বরাদ্ধ দিয়ে জানালা রিপায়ারিংসহ আনুসাঙ্গিক কাজ হয়েছে। আমি রং করার কথা বলেছি। বাকিটা আমরা কমিটির সবাই মিলে মিটিং ডেকে অন্যান্য কাজ এবং হিসেব নিবো।
এ বিষয়ে উপজেলা সহকারী প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মোঃ আব্দুল হাই জানান, আমরা দু’একদিনের মধ্যেই ওই বিদ্যালয়ে যাবো। তারপর বিষয় এসব অনিয়মের বিষয়ে সত্যতা যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবো।
প্রতিবেদক: কবির হোসেন মিজি, ২৯ আগস্ট ২০২৩