প্রতিদিন রাত ১২ টার মধ্যে বাবা বাড়ি আসেন। ঘটনার দিন রাত দেড়টা বেজে গেলেও বাবা বাড়ি ফিরেনি। অন্যসব দিনে বাবাকে একবার ফোন করলেই ফোন রিসিভ করতেন বাবা কিন্তু সেদিন বার বার ফোন করলেও বাবা ফোন ধরেনি। বার বার কেটে দেওয়ার এক পর্যায় বন্ধ করে দেয় ফোন।
চাঁদপুর শহরের বিপণীবাগ বাজারে ব্যবসায়ী নারায়ন ঘোষ হত্যা ঘটনা পরবর্তিতে শনিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাতে চাঁদপুর শহরের ঘোষপাড়া এলাকায় নারায়ণ ঘোষের নিজ বাড়িতে এসব কথার বর্ননা দিচ্ছিলেন তার ছেলে রাজিব ঘোষ রাজু।
কান্নাজড়িত কন্ঠে রাজিব ঘোষ রাজু চাঁদপুর টাইমসকে বলেন, ‘আমার বাবা খুব সহজ সরল মানুষ ছিলেন। আমাদের জানা মতে কারো সাথে আর্থিক কোন সসস্যা ছিল না। ১৫ সেপ্টেম্বর রাতে বাবা বাড়ি না আসায়, আমি বাবার খোঁজে বিপনিবাগ বাজরে যাই। তখন রাত আনুমানিক দেড়টা বাজে। তখন টিপটপ সেলুনের কর্মচারী রাজু শিলকে দেখি পানি দিয়ে দোকান ধোঁয়া মোছা করছে। তখনও কিছু বুজতে পারিনি।’
‘তাকে জিজ্ঞেস করলাম বাবা এসেছিলেন কিনা। তখন রাজু শিল বললো এসেছিল, আমি চুল দাঁড়ি কেটার পর চলে গেছে। তখন কোন কিছু না বুঝে খুঁজতে থাকি। সেখান থেকে চলে আসার আগেও জিজ্ঞেস করলো বাবকে পেয়েছি কিনা। বাবাকে খুঁজতে চাঁদপুর লঞ্চঘাটে যাই সেখানেও পাইনি। লঞ্চঘাট থেকে বাড়ি ফিরার পথে ভোর সাড়ে ৫ টার দিকে মামলার একমাত্র আসামি সেলুন কর্মচারী রাজু শিলের সাথে আবারও কালীবাড়ি এলাকায় দেখা। সে আমাকে ঠান্ডা মেজাজে জিজ্ঞেস করে বাবাবে খুঁজে পেয়েছি কিনা। সে অটোরিকশার অপেক্ষা করছিল তখন। তখনই সে কোথাও পালিয়ে যাচ্ছিল।’
রাজিব ঘোষ রাজু আরও বলেন, ‘আমার বাবার শরীরের গলাসহ দুই পায়ে ও পেটে ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। দুই পা ও পেটের আঘাত দেখে মনে হয় কেচি দিয়ে আঘাত করেছে। আর গলায় খুর দিয়ে কাটতে পারে। এত বড় ঘটনা একার পক্ষে সম্ভব নয়। রাজুর সাথে একাধিক লোক থাকতে পারে। আমরা বাবার খুনিকে দ্রুত গ্রেফতারের দাবি জানাচ্ছি।’
এদিকে হত্যাকাণ্ড ঘটনায় ওইদিন (১৬ সেপ্টেম্বর) রাতে চাঁদপুর সদর মডেল থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলার একমাত্র আসামী সন্দেহভাজন সেলুন কর্মচারী রাজুকে প্রধান আসামী করে মামলা করেন নারায়ন ঘোষের ছেলে রাজিব ঘোষ রাজু। খুন হওয়া মাঠা ব্যবসায়ী চাঁদপুর শহরের ঘোষপাড়া মৃত যোগল কৃষ্ণ ঘোষের ছেলে। সে দীর্ঘদিন ধরে দধি, মাঠার ব্যবসা করে আসছিলেন। নারায়ণ ঘোষের এক মেয়ে ও দুই ছেলে রয়েছে।
গত বুধবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাতের কোনো এক সময়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটে। বৃহস্পতিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) সকালে বাজারের পাবলিক টয়লেটের পাশে তার বস্তাবন্দি গলাকাটা লাশ উদ্ধার করা হয়। বাজারের নাইটগার্ড ইসমাইল বকাউলের তথ্যের ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, টিপটপ সেলুনের কর্মচারী রাজু এই হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। ঘটনার পর থেকেই অভিযুক্ত সেলুন কর্মচারী পলাতক রয়েছে। তাকে আটকে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী বিপনিবাগ বাজারের মার্কেটের নাইট গার্ড মো. ইসমাইল বকাউল বলেন, বিপনিবাগ বাজারের টিপটপ সেলুনের কর্মচারী রাজু শিল (২৭) রাত দুইতার সময় সাটার খোলে পানি দিয়ে পরিস্কার করতে দেখি। পরে রাতে এক এক সময় একটি সাদাবস্তা নিয়ে টানে হেঁচড়ে বাইরে নিয়ে যেতে দেখি। এত রাতে কি করা হচ্ছে এমন প্রশ্ন করলে সে বলে, দোকার পরিস্কার করেছি। ময়লাগুলো বস্তায় করে ফেলে দিয়ে আসছি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিপনিবাগ বাজারের কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, ‘নারায়ণ ঘোষ দধি-মাঠার ব্যবসা করতেন। আর রাজু ঘোষ এখানকার মানুষের সাথে তেমন মিশতো না। চুপচাপ দোকানে বসে সময় কাটাতো। নারায়ণ ঘোষ রাতে ব্যবসার টাকা কালেকশন করতেন। তার কাছ থেকে অনেকে টাকা ধার নেন। হয়তো রাজু শিল তার কাছ থেকে কোন টাকা ধার নিয়েছে। ধারের টাকাকে কেন্দ্র করেই হয়তো হত্যাকাণ্ডের মত ঘটনা ঘটেছে।’
রাজু শিলের স্ত্রী শিউলি বলেন, ‘আমার স্বামী ওইদিন সকালে ফোন করে কেমন আছি জানতে চেয়েছিল। আমাকে অনুরোধ করে বলতে বললো, আমি যেন সেলুনের মালিক কৃষ্ণাকে বলি রাতে সেলুন পরিস্কার করে চলে এসেছি। তারপর আমাকে ভালো থেকো বলে ফোন বন্ধ করে দেয়।’
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশ পরিদর্শক এনামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘মামলার প্রধান আসামি রাজু শিলকে আটকের অভিযান অব্যাহত রয়েছে। হত্যাকণ্ডে রাজু ছাড়া অন্যকেউ সম্পৃক্ত আছে কিনা এখনো পর্যন্ত জানা যায়নি। টাকার বিষয় নিয়ে হত্যা, এমন কথার ভিত্তি নেই। তদন্তের সার্থে অনেক কিছুই বলা যাচ্ছে না।’
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) আসিফ মহীউদ্দীন বলেন, ‘ঘটনার পর থেকে মামলার একমাত্র আসামী সেলুন কর্মচারী রাজু পলাতক রয়েছে। তাকে আটক করতে পুলিশের পক্ষ থেকে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
প্রতিবেদক: শরীফুল ইসলাম, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur