‘ভিআইপি প্রতারক’ মোহাম্মদ. আলী (৪০)। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ সহকারী ও আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক ড. আব্দুস সোবহান গোলাপের কণ্ঠস্বরের সঙ্গে তার কণ্ঠের রয়েছে দারুণ মিল। এই মিলকেই পুঁজি করে দেশজুড়ে চাঁদাবাজীর ভয়ঙ্কর ফাঁদ পেতেছিলেন আলী। দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ব্যবসায়ীসহ ভিআইপিরাই তার টার্গেট ছিল।
ড. গোলাপের কণ্ঠ নকল করে কখনও রাজনৈতিক পদ ও আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাইয়ে দেওয়ার আশ্বাসে, কখনও অসুস্থতাসহ নানা বিপদ-আপদের কথা বলে সুকৌশলে এমপি, মন্ত্রী, বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা, ব্যবসায়ী, সরকারি আমলা এমনকি সংবাদমাধ্যমের কর্ণধারদের কাছ থেকেও টাকা দাবি করতেন আলী। শুধু তাই নয় নিজস্ব ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, ভাইবার আইডিতেও তিনি ব্যবহার করেন ড. গোলাপের নাম ও ছবি।
অভিনব এই প্রতারণার মাধ্যমে সমাজের উঁচু তলার মানুষের কাছ থেকে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। সর্বশেষ গতকাল বৃহস্পতিবার জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ইসমত আরার ব্যক্তিগত সচিবের কাছ থেকে আলী আদায় করেন ২০ হাজার টাকা।
আলী একাই প্রতারণা করতেন না। এই চক্রে শামিল করেছেন তারই আপন বোন মোসা. নাদিয়া সুলতানাসহ (২৭) আরও কয়েকজনকে। বিভিন্ন বিকাশ নম্বর থেকে দাবি করা চাঁদার টাকা তোলার দায়িত্ব ছিল নাদিয়ার। অবশেষে যাকে পুঁজি করে এই প্রতারণা সেই আ. লীগ নেতার অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশের জালে ধরা পড়েছে প্রতারক ভাই-বোন।
বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে রাজধানীর গোপীবাগ এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করে ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (পূর্ব-ডিবি)। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় প্রতারণায় ব্যবহৃত দুটি মোবাইল ফোন, বেশ কয়েকটি সিম কার্ড ও দুটি বিকাশ নম্বর।
গতকাল এক সাংবাদ সম্মেলনে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপির) অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা ও অপরাধ তথ্য বিভাগ) আবদুল বাতেন জানান, ড. আব্দুস সোবহান গোলাপের নাম ব্যবহার করে চাঁদাবাজির অভিযোগে বৃহষ্পতিবার রাত ১২টার দিকে গোপীবাগ এলাকা থেকে মোহাম্মদ আলী ও তার বোন নাদিয়া সুলতানাকে গ্রেপ্তার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তারা প্রতারণার কথা স্বীকার করেছেন।
আবদুল বাতেন আরও জানান, চক্রটি সুকৌশলে প্রথমে দেশের স্বনামধন্য রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও ব্যবসায়ীদের মোবাইল নম্বর সংগ্রহ করে। এর পর ড. গোলাপের নাম ব্যবহার করে খুব স্মার্টভাবে তাদের সঙ্গে কথা বলে চাঁদা দাবি করতেন মোহাম্মদ আলী। তিনি কখনো বলতেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের সুযোগ করে দেওয়া হবে, কখনো বলতেন কাছের কেউ অসুস্থ হয়েছে, তাদের হেল্প করার জন্য টাকার দরকার। আবার কখনো বলতেন, ‘আমার একজন কর্মী গুরুতর অসুস্থ। কিছু টাকার দরকার।’ আর সেই টাকা তার বোন নাহিদ সুলতানা বিকাশের মাধ্যমে তুলতেন। আবার অনেক সময় সরাসরি গিয়েও টাকা নিয়ে আসতেন তারা। এভাবে সমাজের বিভিন্ন পেশার লোক, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, মন্ত্রী, সচিব ও ব্যবসায়ীদের টার্গেট করে মোবাইল ফোনে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে মো. আলী চক্র।
আওয়ামী লীগ কার্যালয় সূত্র জানায়, প্রায় দুইমাস ধরে ড. গোলাপের কণ্ঠ নকল করে একটি গ্রুপ ঢাকার বিভিন্ন ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের কাছে চাঁদা চেয়ে আসছিলেন। একমাস আগে পুরান ঢাকার এক কমিশনারের কাছে চাঁদা চাওয়ার পর ওই কমিশনার আওয়ামী লীগ অফিসে এসে ড. গোলাপকে বলেন, ‘ভাই কত দেব?’
তখন আওয়ামী লীগ নেতা গোলাপ ওই কমিশনারের কাছে প্রতারণার বিস্তারিত জানতে পারেন। একই কায়দায় ওই প্রতারকচক্র কিছুদিন আগে এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান, পারটেক্স গ্রুপের হাশেমের কাছ থেকে টাকা আদায় করেছেন।
আ. লীগ নেতা ড. আব্দুস সোবহান গোলাপ বলেন, ‘একটি প্রতারক চক্র আমার নাম ব্যবহার করে হাই লেভেল থকে বিভিন্ন পর্যায়ে থেকে চাঁদাবাজি করে আসছিলো। আওয়ামী লীগের সহসম্পাদকের পদ দেওয়া কথা বলে বিভিন্ন নেতাদের কাছ থেকে বিকাশসহ বিভিন্ন মাধ্যম দিয়ে চাঁদাবাজি করে চক্রটি। বিষয়টি আমার দৃষ্টিগোচর হলে সন্দেহজনক কিছু মোবাইল নম্বর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমি দিয়েছিলাম। অভিযোগের ভিত্তিতে সেসব নম্বর ট্র্যাকিং করে সেই প্রতারকদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।’