সারাদেশ

প্রথম পর্যায়ে ৮০৩২ রোহিঙ্গার তালিকা হস্তান্তর

নিপীড়নের মুখে পালিয়ে আসা এক হাজার ৬৭৩টি পরিবারের আট হাজার ৩২ রোহিঙ্গার তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছে বাংলাদেশ। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার (প্রত্যাবাসন) প্রাথমিক উদ্যোগ হিসেবে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এ তালিকা দেয়া হয়েছে। বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান।

শুক্রবার বিকেল ৩টায় সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লেফটেন্যান্ট জেনারেল কিয়াও সোয়ের নেতৃত্বে বৈঠক শুরু হয়। বৈঠকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ১৮ জন এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলে ১৫ সদস্য অংশ নেন।

সন্ধ্যা সোয়া ৬টার দিকে বৈঠক শেষ হয়। বৈঠক শেষে সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দল সচিবালয় ত্যাগ করে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।

মিয়ানমারের সঙ্গে অত্যন্ত ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে দাবি করে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘অত্যন্ত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে আলোচনা হয়েছে। তারাও পজেটিভ মুড নিয়ে এসেছিলেন। তাদের আমন্ত্রণে আমি যখন মিয়ানমারে গিয়েছিলাম তখন ১০টি পয়েন্টে ঐকমত্য হয়েছিল। সেগুলো বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, এর অগ্রগতি কী- এগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে যে পাঁচটি পয়েন্টের কথা বলেছিলেন সেগুলো এবং কফি আনানের রিপোর্টের ভিত্তিতে ১০টি পয়েন্টে অ্যাগ্রি করেছিলাম, সেখানে আমরা সাইন করেছিলাম। সেটা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে।’

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বৈঠকে আলোচনার বিষয়ে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমাদের রেজিস্ট্রেশন অনুযায়ী ১০ লাখ ৬০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। এ লোকগুলোকে তারা কীভাবে ফেরত নেবে সে বিষয়ে আলাপ হয়েছে। তারা এ ব্যাপারে খুবই আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। তারা বলেছেন, তারা ক্রমান্বয়ে তাদের (রোহিঙ্গা) নিয়ে যাবেন। তারা যে এলাকায় থাকেন সেটা অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এলাকা। তাদের রাখার জন্য ওই এলাকায় তারা একটা প্ল্যান করছেন, তারা ভিলেজ ডেভেলপ করবেন। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও ফাইনাল পর্যায়ে তাদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করবেন।’

‘প্রাথমিকভাবে রোহিঙ্গাদের চিহ্নিত করে তাদের জায়গায় নেয়া হবে। দ্বিতীয় পর্যায়ে তাদের পুনর্বাসনের জন্য বাড়িঘরের ব্যবস্থা করবেন। তৃতীয় পর্যায়ে তারা যাতে থেকে যেতে পারেন… কারণ এগুলো সবই কফি আনান কমিশনের রিপোর্টে ছিল, আমাদের ১০ পয়েন্টে ছিল, আজ সেগুলো নিয়ে আলোচনা করেছি। এ লোকগুলো যদি যায় তবে তারা আবার চলে আসবেন। সেই সামাজিক পরিবেশ পাবে না, হয়তো ওই এলাকার লোকগুলো তাদের থাকতে দেবে না। এ সমস্ত কথা তারা সবই স্বীকার করে বলেছেন যে, তারা এ সমস্ত কাজগুলো করবেন এবং ক্রমান্বয়ে আমাদের দেশে মিয়ানমারের অধিবাসী যারা এসেছেন তাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন।’

মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা আমাদের অসুবিধার কথাগুলো বলেছি, তারাও তাদের অসুবিধার কথা বলেছেন।’

আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমরা ১১ লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গার লিস্ট করেছি, সেখানে তারা (মিয়ানমার) বলেছিল ফ্যামিলি ওয়াইজ লিস্ট দিতে। আমরা আজ এক হাজার ৬৭৩টি পরিবারের আট হাজার ৩২ জনের তালিকা করে তাদের দিয়েছি। তারা এটা কর্ডিয়ালি রিসিভ (আন্তরিকভাবে গ্রহণ) করেছেন।’

‘মিয়ানমার এ তালিকায় থাকা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে’ জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা তালিকাটা যাচাই করবেন। সত্যিকার তাদের নাগরিক কিনা, সেটা যাচাই করে তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে ফিরিয়ে নেয়া যায়।’

কতদিনের মধ্যে তারা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেবেন- জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘১০ লাখ মানুষ বললেই তো চলে যাবে না। এগুলো যাওয়ার জন্য যে পরিবেশ সেই পরিবেশ তো তৈরি করতে হবে। তারা তিন পর্যায়ে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করবেন। তাদের (রোহিঙ্গা) ফিরে যাওয়ার জন্য পরিবেশ তৈরি, ব্যবসা বাণিজ্য- সেই প্রাথমিক পর্যায়ের কাজ তারা (মিয়ানমার সরকার) করছেন। আমাদের তারা সেটা অ্যাসিউর করেছেন। তবে সুনির্দিষ্ট কোনো তারিখ তারা জানায়নি। আমরা মনে করি খুব শিগগিরই এ প্রসেস তারা শুরু করবেন, আমাদের বিশ্বাস এটা।’

সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গার বিষয়ে সিদ্ধান্ত মঙ্গলবার

দুই দেশের শূন্যরেখায় অবস্থানকারী সাড়ে ছয় হাজার রোহিঙ্গার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বলেছি এরা তো আমাদের দেশে প্রবেশ করেনি, তোমাদের দেশেই রয়েছে। তারা স্বীকার করেছেন এবং বলেছেন, তাদের নেয়ার জন্য তারা প্রক্রিয়া শুরু করেছেন। তারা আমাদের একটি মিটিংয়ে বসার অনুরোধ করেছেন। আগামী ২০ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টায় মিটিংটি হবে তাদেরই একটি জেলায়।’

‘এখান থেকে জেলা প্রশাসক ও অন্য যে প্রতিনিধিদের প্রয়োজন তারা গিয়ে এ বিষয়ে আলোচনা করবেন। ছয় হাজারের বেশি এ লোকগুলো কারা, কীভাবে তাদের বাসাবাড়িতে চলে যাবেন…। (মিয়ানমার) আমাদের অনুরোধ করেছেন তাদের (সাড়ে ছয় হাজার রেহিঙ্গা) চলে যাওয়ার জন্য যেন আমরা সহযোগিতা করি। আমরা বলেছি, তোমাদের ওখানে যদি নিরাপদ মনে করে অবশ্যই চলে যাবে। আমাদের যা যা সহযোগিতা লাগবে আমরা তা দেব।’

তিনি বলেন, ‘২০ তারিখে (ফেব্রুয়ারি) সিদ্ধান্ত হবে তারা কবে চলে যাবেন।’

জাতিগত নিপীড়নে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে বসবাস করছেন। মিয়ানমারের সীমান্তে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর চেকপোস্টে হামলার ঘটনা নিয়ে গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে নতুন করে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর অভিযান চালায় দেশটির সেনাবাহিনী। তখন থেকে রোহিঙ্গারা জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসছেন।

কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২টি অস্থায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে ঠাঁই হয়েছে রোহিঙ্গাদের। তাদের সবাইকে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের আওতায় আনছে বাংলাদেশ সরকার। কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত রোহিঙ্গাদের সংখ্যা মোট ১০ লাখ ৬৮ হাজার ২৩৬।

গত বছরের ২৩ থেকে ২৫ অক্টোবর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জমান খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল মিয়ানমার সফর করে। সেখানে দুই দেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনে সম্মত হয়। পরে ১৯ ডিসেম্বর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়।

গত বৃহস্পতিবার ঢাকা সফরে আসেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কিয়াও সোয়ে।

বাংলাদেশের প্রতি মিয়ানমারের আস্থা বাড়ছে

রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ আবার কবে সভায় বসবে- এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘যেভাবে চলছে এটা অব্যাহত থাকবে। এটা যাতে ঘন ঘন হয় সেটাও আমরা বলেছি।’

এখনও রোহিঙ্গা আসছে। এ বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এখনও ৫০-১০০ এভাবে লোক (রোহিঙ্গা) আসছে, এটাও আমরা বলেছি। তারা সবকিছু স্বীকার করেছেন। বলেছেন, এগুলো তারা বন্ধ করার প্রচেষ্টা নেবেন।’

আজকের বৈঠক নিয়ে বাংলাদেশ সন্তুষ্ট কিনা- সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তারা যেভাবে কথা বলে গেছেন, যেভাবে আমাদের সঙ্গে ঐকমত্য প্রকাশ করেছেন, যেভাবে আজকের সিদ্ধান্তগুলো হয়েছে, যে ১০টি পয়েন্টে ঐকমত্য হয়েছিল এগুলো যদি পর্যালোচনা করেন তাহলে আমরা মনে করব, আমাদের বিশ্বাস করতে তারা আশ্বস্ত হচ্ছে, হয়তো তারা (রোহিঙ্গাদের) নিয়ে যাবে।’

৪৯ ইয়াবা কারখানা বন্ধের অনুরোধ

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘ইয়াবার বিষয়ে আমরা তাদের বলেছি। তাদের দেশে ৪৯টি ইয়াবার কারখানা শনাক্ত করে সেগুলোর নামও দিয়েছি। তাদের সহযোগিতা চেয়েছি যাতে আমাদের দেশে ইয়াবা আসা বন্ধ হয়। তারা বলেছেন, ওই ৪৯টি ইয়াবার কারখানা তারা বন্ধ করার চেষ্টা করবেন। আমাদের অনুরোধ করেছেন, আমরাও যাতে তাদের সঙ্গে কাজ করি এই ড্রাগ বন্ধ করার জন্য।’

তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশে বর্ডার কিলিং হয় সেগুলো বন্ধ করার জন্য আলাপ করেছি। বার্ডার পেট্রলিং বিষয়ে যে বিএলও সই হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য।’

হবে বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস

বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস নিয়ে আলোচনা হয়েছে কিনা- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘বর্ডার লিয়াজোঁ অফিস নিয়ে কথা হয়েছে। এটার অগ্রগতি হয়েছে এবং এটা হবে।’

শুক্রবার বেলা পৌনে ৩টায় মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সচিবালয়ে উপস্থিত হলে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে ফুল দিয়ে স্বাগত জানান। লাল গালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাঙ্গণে অস্থায়ী মঞ্চে দাঁড়িয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) একটি দলের সালাম গ্রহণ করেন কিয়াও সোয়ে।

দুদেশের প্রতিনিধি দলে যারা ছিলেন

বৈঠকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলে ছিলেন জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব মোস্তাফা কামাল উদ্দীন, সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব ফরিদ উদ্দিন আহম্মদ চৌধুরী, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মেরিটাইম ইউনিটের সচিব খোরশেদ আলম, পুলিশের মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ জাবেদ পটোয়ারী, বিজিবির মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আবুল হোসেন, কোস্টগার্ডের মহাপরিচালক আওরঙ্গজেব চৌধুরী, বহিরাগমন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের মহাপরিচালক মাসুদ রেজওয়ান, ডিজিএফআইর মহাপরিচালক মেজর জেনারেল সাইফুল আবেদীন, পুলিশের বিশেষ শাখার অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক শহীদুল ইসলাম, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের মহাপরিচালক জামাল উদ্দিন আহমদে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব সামছুর রহমান, চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার আব্দুল মান্নান, শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার আবুল কালাম, প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মহাপরিচালক খলিলুর রহমান, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিভাগের মহাপরিচালক মঞ্জুরুল করিম চৌধুরী, মিয়ানমারে বাংলাদেশ দূতাবাসের ডিফেন্স অ্যাটাচি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশেদুল মান্নান এবং জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক এম মনিরুল ইসলাম।

মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে প্রতিনিধি দলে ছিলেন দেশটির স্বরাষ্ট্র সচিব উ টিন মিন্ট, পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থো, পুলিশ প্রধান মেজর জেনারেল অং ইউন অ, বাংলাদেশে নিযুক্ত মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত লইন অ-সহ ১৫ জন সদস্য।
(জাগো নিউজ)

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১২: ৫৫ পি.এম, ১৭ ফেব্রুয়ারি২০১৮, শনিবার।
এএস.

Share