প্রতীকী গণতন্ত্র

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রথম দিকে গণতন্ত্রের সূচনা বাঁশি বাজে। তবে আধুনিক গণতন্ত্রের আবির্ভাব ঘটে আঠার শতকে। পৃথিবীতে গণতান্ত্রিক দেশ ১২২টি।গণতন্ত্র শব্দটি গ্রীক শব্দ “ডেমোক্রেসিয়া” থেকে উৎপত্তি হয়েছে। গণতন্ত্রের পুঁথিগত সংজ্ঞা হচ্ছে, কোনো জাতি বা রাষ্ট্রের এমন একটি ব্যবস্থা যা প্রত্যেক নাগরিকের নীতি নির্ধারণ বা সরকারি প্রতিনিধি নির্বাচনের সময় সমান ভোট বা অধিকার আছে।

আমার পরিভাষায় গণতন্ত্র এমন একটি তন্ত্র যে তন্ত্রে ভোটের পূর্বে সমস্ত অধিকার দেওয়া হয়, নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটারদের দেয়া সকল প্রতিশ্রুতি ভুলে যাওয়ার অধিকারও দেওয়া হয় ।

বাংলাদেশে সংসদীয় বহুদলীয় গণতন্ত্র বিরাজমান। গণতন্ত্রের আইকন হল ভারত। পৃথিবীর অনেক দেশ গণতন্ত্রের সুঘ্রাণে মুগ্ধ হয়ে গণতান্ত্রিক হচ্ছে। নেপাল তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত । আমাদের দেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটাই শুধু গণতন্ত্রের কক্ষপথ থেকে বিচ্যুতি ঘটে নাই, বিচ্যুতি ঘটেছে গণতন্ত্রের প্রতিটি বর্ণের। এদেশের গণতন্ত্র আজ বিবর্ণ ও বিবস্ত্র । গণতন্ত্র নিজস্বতা হারিয়েছে, হারিয়েছে তার বাক স্বাধীনতাকে। এর জন্য দায়ী দেশের রাজনেতিক দলগুলো।

বাংলাদেশ বিশ্বের ৮৫ তম গণতান্ত্রিক দেশ। স্বাধীনতা যেমন ত্যাগ ও রক্ত ছাড়া আসেনি গণতন্ত্রও তেমনি রাজপথ রক্তাক্ত করে এসেছে। দেশ স্বাধীন হলো অনেক যুগ হয়ে গেল কিন্তু গণতন্ত্র আজও অপরিপক্ব ও অবহেলিত। মাঝে মধ্যে আই সি ইউ তে রাখা হয়। ৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বিভিন্ন সামরিক শাসক দেশটাকে চালিয়েছে সামরিক কায়দায়। আশি শতকের প্রথম দিকে সুনামি আঘাত আনে গণতন্ত্রের উপর। সামরিক শাসকরা গণতন্ত্রের কণ্ঠ রোধ করলো। তারা গণতন্ত্রের রক্ত চুষে দেশ চালালেন, সামরিক লেবাসে।

১৯৮৩ সালে মজিদ খানের শিক্ষানীতি বাতিল ও সামরিক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা বিক্ষোভ করে। স্বৈরশাসকের মদদপুষ্ট পুলিশের গুলিতে জাফর, দিপালী, ডা. মিলন, জয়লালের তাজা রক্তে রাজপথ রক্ত স্নান করেছিল । গণতন্ত্রের জন্য সমস্ত শরীরটা ক্যাম্পাস বানিয়ে শহীদ হলেন নুর হোসেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল। স্বৈরশাসকের পেটুয়া বাহিনীর নির্মম আঘাতে বার বার আমি রক্তাক্ত হয়েছিলাম। যে আঘাতের চিহ্ন এখনও আমার শরীরে দৃশ্যমান। আর সেই স্বৈরশাসক যখন বলেন দেশে গণতন্ত্র নেই, তখন নিজেকে অপদার্থ বলে মনে হয়।

ঐতিহ্যবাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণতন্ত্রের নাম-নিশানা নেই। ডাকসু নামে যে একটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান আছে, তা বর্তমান প্রজন্ম ভুলতে বসেছে। কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন হচ্ছে না।

বর্তমান নির্বাচন কমিশন ও বর্তমান সরকারের গণতন্ত্র পরির্চচার আরেক নাম “প্রতীকী গণতন্ত্র”। কেমিস্টিতে পড়েছি অক্সিজেনের প্রতীক O। প্রতীকী নির্বাচনের আয়োজনটা মন্দের ভাল বলা যেতে পারে । যে দেশের রাজনেতিক দলগুলোর নিবন্ধনই ছিলো না। বর্তমান সরকার এবং নির্বাচন কমিশন সকল দলকে নিবন্ধনের বৃত্ততে আবদ্ধ করার জন্য উভয়েই প্রশংসার দাবিদার।

রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রথমে দলীয়ভাবে প্রকৃত পক্ষে গণতান্রিক হতে হবে। তা না হলে দেশ, সমাজ ও রাজনীতিতে দূরত্ব বৃদ্ধি পাবে। একজন ওয়ার্ডের নেতাও নির্বাচিত হতে হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়।

বর্তমানে অর্থওয়ালার কথাই অর্থপূর্ণ। রাজনীতিতে ত্যাগী নেতার কদর কমে যাচ্ছে। অর্থবান ব্যাক্তিদের পদচারণে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ডে মরন পঁচন ধরেছে। প্রতীকী গণতন্ত্র দেশ ও জাতির বর্তমান প্রেক্ষাপটে কোনো সুফল দিতে পারবে না। কারণ ত্যাগী নেতারা দলের প্রতীক পাবে না। অর্থের কাছে পরাস্ত ও পরাভূত হবে দলের আদর্শ ও ত্যাগী নেতারা ।

দলীয় প্রতীক নির্বাচনের পূর্বে গণতন্ত্র পরিপক্ব হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। এখন দলীয় প্রতীকে নির্বাচন দেওয়া আর কেজি’র বাচ্চাকে কেমিস্টি পড়তে দেওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দলীয় প্রতীকে নির্বাচনে দেশের বড় দলগুলোর মধ্যে দলীয় কোন্দল চরমসীমায় পৌঁছাবে। একেবারে তৃণমূল থেকে শুরু হবে হানাহানি, জনগণ হবে হতভম্ব ।। হ-য-ব-র হবে দেশে দলীয় প্রতীকের নির্বাচন ।

বাংদেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইউনিয়ন পরিষদ আছে। প্রতিটি ইউনিয়নে তেরটি পদে অসংখ্য প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন । দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ব্যর্থ হবে বড় দললো। এটা দিবালোকের মতন স্পষ্ট। ইতোমধ্যে বড় দলের নেতারা দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে ব্যর্থ হবেন তা স্বীকার করছেন। এমনিতেই দেশের বড় রাজনেতিক দলগুলো দলীয় কোন্দলের ভাইরাসে ভুগছে। পাশাপাশি যেহেতু দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতন্ত্রের চর্চা নাই, তাই ঘর সামাল দেওয়া কঠিন হবে। পক্ষান্তরে তাড়াহুড়ো করে আইন তৈরির কারনে আইনি দুর্বলতা থেকেই যাবে ।

আমাদের দেশের জনগণ বলেন আর রাজনেতিক দল বলেন, তাদের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চার বড় অভাব। এ দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য গণতন্ত্রকে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করেন অথবা ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য গণতন্ত্রকে কখনও পেটে আবার কখনও বক্ষে সিজার করেন। যে দেশের গণতান্ত্রিক মানুষগুলো ভোটের অধিকারই পাচ্ছেন না। সে দেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অন্যান্য অধিকার অন্ধকারেই থেকে যাচ্ছে ।

গণতন্ত্র বিকাশের পূর্ব শর্ত হলো দক্ষ প্রশাসন। নিরপেক্ষ হতে হবে নির্বাচন পরিচালনাকারী বডি। গণতন্ত্রের সুফল অর্জনে প্রথমে রাজনেতিক দলগুলো একে অপরের প্রতি বিশ্বাস অর্জন করতে হবে। ধার করে লোক বসিয়ে গণতন্ত্রকে আই সি ইউ থেকে বের করা সম্ভব নয়। মিয়ানমারে সামরিক সরকারে অধীনে বিশ্ববাসী সুষ্ঠু নির্বাচন দেখেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণতন্ত্র সামরিক শাসকরা ক্ষত -বিক্ষত করেছেন।

পর্যায়ক্রমে দলীয় প্রতীক মার্কায় নির্বাচন দিলে গণতন্ত্র বস্ত্র হরণের সম্ভাবনা থাকবে না। প্রথমে সিটি কর্পোরেশন দলীয় মার্কায় নির্বাচন দিয়ে অভিজ্ঞতা নিতে হবে। তারপর পৌরসভা সবশেষে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন দিতে হবে।

সাইদুর রহমান সাইদুল, লেখক ও কলামিস্ট,

|| আপডেট: ০৩:১৮ পিএম, ০৭ ডিসেম্বর ২০১৫, সোমবার

এমআরআর  

Share