চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে প্রতিবন্ধী কিশোরীকে ধর্ষণের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ টাকা। সালিসি বৈঠকে ওই টাকা লেনদেন হয়েছে। টাকার বিনিময়ে ফৌজদারী ও গুরুতর অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার অভিযোগ উঠেছে । বৈঠকে হুমাইয়ুন পাটওয়ারী, সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবু পাটওয়ারী, অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের অভিভাবকসহ বাড়ির লোকজন উপস্থিত ছিলেন। উপজেলার গোবিন্দপুর (দক্ষিণ) ইউনিয়নে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে জুলাই মাসে। সালিসি বৈঠক হয়েছে কয়েকদিন আগে।
সরেজমিন জানা গেছে, গ্রামের মাতৃহীন কিশোরী কন্যা (১৬)। আচার আচরণে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী বলে দাবী করছেন কিশোরীর বাবা। তার জন্মদাত্রী মা নেই। বাবা দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। বাড়ির লোকজনের দাবী কিশোরী অনেকাংশে অযত্নে থাকে। বাড়িতে এঘরে ওঘরে ঘোরাফেরা করে। এরই মধ্যে ২রা জুলাই তাকে নজির পাটওয়ারীর গরুর খামারে নিয়ে যায় অভিযুক্ত সালাউদ্দিন (২৫)। খামারের একটি ঘরে তাকে ধর্ষণ করা হয়। ঘটনা কাউকে না জানানোর জন্য কিশোরীকে ফুসলিয়ে দেয় সালাউদ্দিন। ঘরে ফিরে কিশোরী তার মাকে জানিয়ে দেয়। এতে, এককান দুকান হয়ে ৫ই জুলাই সারা বাড়ি খবর ছড়িয়ে পড়ে। কিশোরীকে নানাজনে জিজ্ঞাসাবাদ করে। এতে, সে জানায় সালাউদ্দিন ছাড়াও একই বাড়ির সুজন তাকে ধর্ষণ করেছে। ঘটনা চাপা রেখে গোপনে দেন-দরবার চলে।
বৃহস্পতিবার বিকালে কথা হয় কিশোরীর বাবা, মা ও অন্যান্যদের সঙ্গে। নিকটাত্মীয় কনস্টেবল মালেক পাটওয়ারীসহ থানায় অভিযোগের দাবী করলেও কিশোরীর বাবা কোন প্রমাণ দেখাতে পারেননি। তিনি জানান, আশ^াস দেয়া হয়েছিল সুজনের সাথে তার বিয়ের ব্যবস্থা করা হবে। অন্যতম নীতি নির্ধারক হুমাইয়ুন পাটওয়ারী ঢাকা থেকে ফেরার পর মিলন পাটওয়ারীর বসত ঘরে বৈঠক বসে।
এতে, হুমাইয়ুন পাটওয়ারীসহ উপস্থিত ছিলেন সংশ্লিষ্ট ইউপি’র সাবেক চেয়ারম্যান আবু পাটওয়ারী, কিশোরীর বাবা, পুলিশের কনস্টেবল (বর্তমানে এলপিআর ভোগ করছেন) আবদুল মালেক, গরুর খামারের মালিক নজির পাটওয়ারী, অভিযুক্ত সালাউদ্দিন ও সুজনের বাবাসহ বাড়ির অন্যান্যরা। নজির পাটওয়ারী স্বীকার করে বলেন, আমার খামারে সিসি ক্যামেরা আছে। খামারের একটি ঘরে সালাউদ্দিন ও কিশোরী ঢোকার ভিডিও চিত্র দেখা গেছে। তারা অনেকটা সময় ঘরের ভিতরে ছিল। বৈঠকে, অভিযুক্তরা দোষী হিসেবে তাদের বাবা স্বীকার করেন। কিন্তু, তাদের কেউই কিশোরীকে বিয়ে করবে না। তবে আর্থিক সাহায্য করা হবে বলে প্রস্তাব দেয়া হয়। এতে, দীর্ঘ আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় অভিযুক্ত সালাউদ্দিন ও সুজনের অভিভাবক তিন লাখ করে ছয় লাখ টাকা কিশোরীর বাবাকে নগদ প্রদান করতে হবে। এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বলা হলে কিশোরীর বাবাসহ কনস্টেবল মেনে নেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কিশোরীর বাবাকে ছয় লাখ টাকা প্রদান করা হয়।
এ ব্যপারে জানতে চাইলে, ধর্ষণের অভিযোগ ও ছয় লাখ টাকা পাওয়ার তথ্য স্বীকার করেন কিশোরীর বাবা। তিনি বলেন, ছয় লাখ টাকা সম্পূর্ণ ব্যাংকে রেখেছি। সালিসি বৈঠকে কারা ছিল জানতে চাইলে তিনি উল্লেখিত লোকজনের নাম বলেন।
সালাউদ্দিনের বাবা মিজানুর রহমান ছয় লাখ টাকায় মিমাংসার তথ্য স্বীকার করে বলেন, বৈঠকে সালাউদ্দিন ও সুজন উপস্থিত ছিল না। তিনি জানান, সালাউদ্দিন বিবাহিত, তার একজন সন্তান রয়েছে।
ধর্ষণের অভিযোগ ছয় লাখ টাকায় মিমাংসা হইছে স্বীকার করে হুমাইয়ুন পটওয়ারী বলেন, টাকা লেনদেনসহ স্টাম্প রাখা হইছে। ধর্ষণের বিচার করা আইনত নিষেধ আছে। এমন মন্তব্য করার পর তিনি এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে বলেন, আপনি আমাকে চেনেন। আমি এতো কথা টেলিফোনে বলতে পারবো না। ফরিদগঞ্জ প্রেসক্লাবে এসে (…কে) দিয়া আপনাকে ডাকাবো, তারপর কথা বলবো।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবু পাটওয়ারী বলেছেন, বৈঠকে ওরা ঝগড়া লাইগা গেছে দেইখা আমি চইলা আইছি। তবে, ছয় লাখ টাকা জরিমানার রায় ও বিয়ের প্রস্তাবের তথ্য তিনি স্বীকার করেছেন।
তিনি বলেন, এরপর কি হইছে আমি জানি না। অন্যরা বলেছে, আপনার উপস্থিতিতে সম্পূর্ণ সমাধান হয়েছে। এমন প্রশ্নে তিনি নিরব থাকেন।
এ ব্যপারে ফরিদগঞ্জ থানার পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) প্রদীপ মন্ডল বলেন, এমন ঠিকানা থেকে আমাদের কাছে কোন অভিযোগ আসেনি। ধর্ষণের অভিযোগ পেলে সাথে সাথে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হতো। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আইনত ধর্ষণের সালিস করতে পারে না।
প্রতিবেদক: শিমুল হাছান, ২ অক্টোবর ২০২৩