রাজনীতি

পৌরসভা নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না মনে করেও যে কারণে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বিএনপি

নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না- এমন অভিযোগ থাকলেও চার কারণে দলীয় প্রতীকে পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।

প্রায় ৮ বছর পর তৃণমূলে ধানের শীষ প্রতীক পৌঁছে দেওয়া, স্থানীয় পর্যায়ে নেতাকর্মীদের চাঙ্গা করা, বহির্বিশ্বের কাছে দলকে জঙ্গি তকমা এড়ানো ও দলের নেতা-কর্মীদের ঐক্যবদ্ধতা যাচাই- এই চার কারণে বিএনপি পৌরসভা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে দলটির সূত্রে জানা গেছে।

এই লক্ষ্য অর্জনে দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা ইতোমধ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিএনপি এই নির্বাচনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে নেওয়ার ঘোষণাও দিয়েছে। ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে হলেও থাকতে চায় দলটি। যে কারণে দলীয়ভাবে নির্বাচনের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বেশ কয়েকটি মনিটরিং সেল গঠন করা হয়েছে।

আগামী ৩০ ডিসেম্বর দেশের ২৩৫টি পৌরসভায় দলীয় প্রতীকে প্রথম বারের মত স্থানীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ছাড়াও দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলো প্রার্থী দিয়েছে।

পৌর নির্বাচনের করণীয় ঠিক করতে গত ১০ ডিসেম্বর রাতে দলের স্থায়ী কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। বৈঠকে পৌর নির্বাচনে গেলে বিএনপির কী অর্জন হবে তা নিয়ে আলোচনা হয়। খালেদা জিয়া প্রচারণার মাঠে নামলে দলের নেতাকর্মীরা চাঙ্গা হবে এমন মতও দেন কেউ কেউ। ওই সময় খালেদা জিয়া পরিস্থিতি বুঝে মাঠে নামার কথা বলেন। এ নির্বাচনে বিএনপির লক্ষ্য তুলে ধরে সরকারর সকল ‘নির্যাতন’ উপেক্ষা করে নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত মাটি কামড়ে থাকাসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী সময়ে দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তব্যে এ বিষয়গুলো প্রকাশ পেয়েছে।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে স্থায়ী কমিটির বৈঠকের দুই দিন পর গত ১২ ডিসেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করেন দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, ‘আজকে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এটাকেও (পৌর নির্বাচনে অংশ না নেওয়া) একটা ছুতা করে বিএনপিকে জঙ্গিবাদী ও গণতন্ত্রবিরোধী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করতে সমস্ত আয়োজন সম্পন্ন করা হবে। আমাদের সকলের স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত, নির্বাচনে থাকার বিকল্প কোনো পথ নেই। গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমাদের এই পথটা বেছে নিতে হয়েছে।’

ওই রাতে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন খালেদা জিয়া। তিনি দলের নেতাদের নিজ নিজ পৌরসভা নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে দলের নেতাদের এলাকায় যেতে বলেন।

খালেদা জিয়ার সঙ্গে ওই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামছুজ্জামান দুদু। তিনি বলেন, ‘আমরা সিরিয়াসলি পৌর নির্বাচনটি করতে চাই। নির্বাচন পরিচালনার জন্য দলের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকটি মনিটরিং কমিটি করার কথা বলা হয়েছে।’

গত বৃহস্পতিবার (১৭ ডিসেম্বর) রাজধানীর বাংলাদেশ ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন মিলনায়তনে এক আলোচনায় মির্জা ফখরুল বলেন, ‘নির্বাচনে না গেলে তো শাসক দল বিদেশিদের বলবে, জঙ্গি সংগঠন বলে তারা নির্বাচনেও গেল না। মজার ব্যাপার হল, বিদেশিরা সেটা বিশ্বাসও করে নেবে। আমরা মানুষের অধিকার রক্ষা করতে গণতান্ত্রিক পরিস্থিতিতে নির্বাচন করতে চাই। সেটাকে রক্ষা করার জন্য আমরা এই নির্বাচনে গিয়েছি।’

গত ১৪ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘অনেকেই বলতে শুরু করেছে, এটা বোধ হয় সিটি নির্বাচনের মতোই একটা নির্বাচন হবে। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় আমরা এই নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। এ সব জেনেও আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করবো নির্বাচনী লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার জন্য।’

এর একদিন পর (১৫ ডিসেম্বর) গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে ‘কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষণ সেল’ এর প্রথম বৈঠক হয়। বিভিন্ন কমিটি গঠনসহ নির্বাচন পরিচালনার নানা বিষয়ে সেখানে আলোচনা হয় বলে পরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, ‘একটি কথা আমরা পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, অনেকে প্রশ্ন করেন আপনারা আবার মাঝপথ থেকে ফিরে আসবেন কিনা? কোনো সম্ভাবনা নেই। মাঝপথ থেকে ফিরে আসার কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। একেবারে ফলাফল ঘোষণা না হওয়া পর্যন্ত সবাই অ্যাক্টিভলি মাঠে থাকবেন বলে আজকের সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছে।’

এদিকে, শনিবার রাতে বিএনপি পন্থী পেশাজীবী নেতাদের আসন্ন পৌর সভা নির্বাচনে ২০ দলীয় জোট সমর্থিত প্রার্থীদের পক্ষে প্রচরাণায় নামতে আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।

পেশাজীবীদের উদ্দেশ্যে বৈঠকে তিনি বলেন, এই নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না জেনেও আমরা নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। আপনারা প্রচারণায় নামুন। যেখানে অনিয়ম, বাধা, সরকারের পক্ষে কৌশল তা সাথে সাথে জনগণকে অবহিত করতে হবে। ২০ দল সমর্থিত প্রার্থীদের কোথাও কোনো বাধা বা প্রচারে বিঘ্ন ঘটানো হলে তা জনগণের সামনে তাৎক্ষণিকভাবে তুলে ধরতে হবে।

রংপুর বিভাগে চার দিন নির্বাচনী প্রচারণার পর রবিবার ঢাকায় ফিরছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল(অব.) মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘২০০৮ সালের পর ধানের শীষ প্রতীকে কোনো নির্বাচন হয়নি। এ কারণে বিপুল সাড়া পেয়েছি। নেতাকর্মীদের মধ্যেও ব্যাপক উৎসাহ দেখা গেছে। আমি মনে করি, এ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য একটি আলোড়ন সৃষ্টি করবে, আমাদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাব।’

ঢাকা বিভাগের বিএনপির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এ্যাভভোকেট আবদুল সালাম আজাদ বলেন, ‘আমরা (স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ দলের নেতাকর্মীরা) গত কয়েকদিন নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও, টাঈাইলের কালহাতিসহ বেশ কয়েকটি পৌর এলাকায় নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছি। স্থানীয় জনগণ ও নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া পেয়েছি।’

তিনি বলেন, ‘এ নির্বাচনে সরকার পরির্বতন হয় না। সরকার যদি এ নির্বাচন ছিনিয়ে নিতে চায় তাহলে তারাই তাদের কবর রচনা করবে। জনগণই এর উপযুক্ত জবাব দিবে।’

দলের মধ্যম সারির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আমাদের অনেক কিছুই অর্জনের আছে। সিটি নির্বাচনে মাঝ পথে সরে গিয়ে অনেক সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে। ফলে এই নির্বাচনে প্রমাণ হবে মাঠের লড়াইয়ে বিএনপির নেতাকর্মীরা কতটা ঐক্যবদ্ধ আছে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্যাতনের মুখে মাঠ ধরে রাখতে পাড়লে জনগণ বিএনপির পক্ষে রায় দিবে। কারণ সরকারের জুলুম নির্যাতনে রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের পাশাপাশি দেশের মানুষ অতিষ্ঠ। এ থেকে পরিত্রাণ চায় জনগণ। তাই ব্যালটের মাধ্যমে জনগণ এর জবাব দিবে।’

প্রসঙ্গত, এবারের নির্বাচনে দলীয় প্রতীকে ২৩৩টি পৌরসভায় প্রার্থী দিয়েছে বিএনপি। এর মধ্যে মনোনয়ন যাচাই-বাছাইয়ের পর ১২ জনের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। বাকি ২২১টির মধ্যে ৩টি পৌরসভা জোট শরিকদের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১টি জামায়াতকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। ১ জন প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেন। ফলে বিএনপির বৈধ প্রার্থী আছে ২১৭ জন। তবে বেশ কয়েকটি পৌর এলাকায় জামায়াতের বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছে।

সূত্র : দ্য রিপোর্ট

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ১০:০১ পিএম, ২০ ডিসেম্বর ২০১৫, রোববার

এমআরআর  

Share