সদ্য জনপ্রশাসন পদকপ্রাপ্ত চাঁদপুরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ আবদুল হাই (উপ-সচিব) ‘শনিবারের শনির দশা’ শিরোনামে একটি রম্য গল্প শেয়ার করেছেন। উপস্থাপনায় রম্য গল্প মনে হলেও গল্পটি পাবলিক বাসে যারা যাত্রী হয়ে চলাফেরা করেন, তাদের জন্যে শিক্ষণীয় হতে পারে।
তাঁর ফেসবুক ওয়াল থেকে সংগৃহীত গল্পটি চাঁদপুর টাইমস পাঠকদের জন্যে তুলে ধরা হলো-
শনিবারের শনির দশা (রম্য গল্প): ইয়াবা বাবাজিকে বোতলজাত করে “শরবতে ইয়াবা ” বানিয়ে রাস্তার ধুলোয় মিশিয়ে দিলাম!
কক্সবাজার হতে ঢাকায় যাচ্ছি । মাথায় ভীষণ চাপ । সময় একদিন মাত্র । সাপ্তাহিক বাজার, আদরের সন্তানটিকে ডাক্তার দেখানো, তার শীতের ড্রেস কেনা, সহধর্মিণীর জন্য বোরকা কেনা এবং সময় থাকলে তাঁর সাথে খোশগল্প করে যথাসময়ে কক্সবাজারে প্রত্যাবর্তন করে রোহিঙ্গাদের সেবায় নিজেকে বিসর্জন দেয়া । তিন সিটের বাসের নিয়মিত যাত্রী আমি ।
এক পাশের সিঙ্গেল সিটে আরাম করে বসে -ঘুমিয়ে নির্ঝঞ্ঝাট আসা-যাওয়া । কে উঠলো, কে নামলো এতে আমার মাথা ব্যথা নেই সচারাচর। কিন্তু দিব্যি সামনের সিটে যখন এক উর্বশী ললনা বসার ছলে হালকা লাজুক হাসির ঝিলিক মারে, তখন মধ্য বয়সী এ প্রৌঢ় আদমের হৃদয়েও একটু ছলাৎ ছলাৎ করে ভার্সিটি জীবনে ষোড়শী সুশ্রী কন্যার অবহেলার করুন দৃশ্যপট মানসপটে ভেসে ওঠে ।
পাশাপাশি সহধর্মিণীর নিষ্কণ্টক নিখাদ ভালোবাসায় আমার পার্থিব জীবনে শান্তি ও সুখের প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত থাকায়, বোরকা পরে শালীনভাবে চলাফেরা ও নামাজ পড়ার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলায় এবং গৃহপতি এ অধম নামাজ না পড়লে কঠোর ও কঠিন হুঙ্কারের যন্ত্রণা এরইমধ্যে আমাকে স্ত্রৈণ (স্ত্রী বশীভূত) জাতিতে রূপান্তরিত করেছে । ফলাফল আমাকে এখন আর সুখে থাকলে ভুতে কিলাতে পারে না ।
তাই নিজের সিটে বসে সুরা ফাতিহা ৪১ বার, আয়াতুল কুরসি, তিন কুল (সূরা ইখলাছ তিনবার), “বিসমিল্লাহি মাজরেহা ওয়ারমোরছাহা ইন্নারাব্বিলা গাফুরুর রাহিম” পড়ে আল্লাহকে স্মরণ করে ঝিমিয়ে পড়লাম ।
গাড়ি ছাড়া মাত্র কিছুক্ষণ পরপর পুলিশি হামলা মানে চেকআপ । গাড়ির সর্বত্রই চেক করে । কিছু নির্দিষ্ট যাত্রীকে পারলে দিগম্বর করে ফেলে যদিও আমি আর সামনের সিটের উর্বশী ললনাকে কিছুই চেকআপ বা জিজ্ঞাসা করেনি । কক্সবাজার হতে চট্টগ্রাম- এ স্বল্প পথে চারবার পুলিশের চিরুনি অভিযানে তিক্ত ও বিরক্ত যাত্রীরা।
চেক করার সময় কিছু না বললেও পুলিশ নামার পরই শুরু হয় অকথ্য ভাষায় উষ্মা প্রকাশ ।
সর্বশেষ অলংকার-ভাটিয়ারি এলাকায় এক যাত্রীকে চারবার পরীক্ষা করে কিছু না পেয়েও নামিয়ে নিয়ে গেলে যাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যায় । কেউ বলে এটি পুলিশ হয়রানির চরম সীমা অতিক্রম করেছে, কেউ বলে নিশ্চয়ই কোন গোয়েন্দা রিপোর্ট আছে আবার কেউ বলে অন্তত একজন নিয়ে গেছে । ঝামেলা আর না হলেই হয় । সত্যিই আর ঝামেলা হয়নি।
কাঁচপুর পর্যন্ত গাড়ির বাতি নিভে ছিলো। সবাই ঘুমে নিমগ্ন ছিল। কেবল মাঝেমধ্যে আমার সামনের সিটের উর্বশী যাত্রীর গরম নিঃশ্বাসের আর্তনাদ যেন আমিই শুনছিলাম। হয়তো এটা ভ্রম বা অপ্রাসঙ্গিক কল্পনা প্রসূত চিন্তার বহিপ্রর্কাশ হতে পারে । যাক গে সেসব কথা ।
তবে সুপারভাইজারের “কাঁচপুর- চিটাগাং রোড়”: আওয়াজে দু-এক জন যাত্রী নামার সিগনাল দিলে বাসের ভিতরের লাইট জ্বলে ওঠে । আমারও ঘুম ভেঙ্গে যায়, চোখ মুছে সামনে নামার চিস্তা করি। পায়ের খোলা জুতা খুঁজতে নিচে তাকায় । জুতা আছে, তবে জুতার সামনে ঐ উর্বশী ললনার সিটের নিচে একটা টিস্যুর প্যাকেট । ভাবলাম হাত ফস্কে পড়ে গেছে । পা দিয়ে টেনে হাতে নিলাম ।
এক্সকিউজ মি? আপনার টিস্যু পেপার পড়ে গেছে? পিছনে ফিরে মুচকি হেসে বলল, না, আমার না । অন্য কারো হতে পারে । কারো টিস্যু পেপার পড়েছে? কেউ সাড়া দেয় নি।
দুর! কেউ নিবে না । আমিই ব্যবহার করবো । দশ টাকা দামের প্যাকেটটি ছিড়ে একটি টিস্যু পেপার নিতে যাবো । দেখি ভিতরে পাতলা করে কাগজে মোড়ানো আরেকটি প্যাকেট! ঐটি শক্ত করে বাঁধা । খুলতে কষ্ট হচ্ছে । চাপ দিলাম । ভিতরে গুটি গুটি কী যেন আছে । ততক্ষণে আমার অন্তরাত্মা ভয়ে কেঁপে উঠল । বুঝে ফেললাম ভিতরে ইয়াবা বাবাজি আছে। সুপার ভাইজারকে ডাকলাম । বললাম, এ প্যাকেটটি টিস্যুর প্যাকেটে পাওয়া গেছে, একটু খুলুন।’
না, আমি পারবো না । আপনি পেয়েছেন, আপনার হাতে আছে, দায় দায়িত্ব আপনার! পাশের যাত্রীরা বললো, খুলুন, আমরা আছি, দেখি ভিতরে কী আছে । খোলা হল ।
জ্বি, ঐটি আছে ভিতরে। ইয়াবা বাবাজি! গোটা একশোটি হবে । অনেকেই জীবনে প্রথম নাকি ইয়াবা দেখেছে! দেখি ভাইয়া আমি একটু দেখি । কখনো সরাসরি ইয়াবা দেখিনিতো- বললেন ওই উর্বশী ! তাকে দেখালাম এবং বললাম, ইচ্ছা করলে একটু খেয়ে টেস্টও করতে পারেন । “না, আজে বাজে জিনিস খাইনা-প্রত্যুত্তরে বললো । বুঝলাম, শিক্ষিত, ভদ্র ও বনেদি পরিবারের লোক। এখন কী করি এগুলি নিয়ে? কেউ দায়িত্ব নিতে রাজি না । সবাই বলে, আপনি পেয়েছেন, দায়-দায়িত্ব আপনার ।
আমার পরিচয় কেউ জানে না । আমিও বলিনা । ভাবলাম, এডিএম (অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট) থাকতে আপিল মামলায় দেখেছি, একটি ইয়াবার জন্য এক বছরের জেলও হয়েছিল অনেকের ।
এখানে যদি একশো ইয়াবা হয়, তবেতো পুলিশ ধরতে পারলে ঐ হারে একশো বছরের জেল! বাকি জীবন জেলের ঘানিতে শেষ! বললাম, চলেন গাড়ি হতে নেমে নিকটবর্তী থানায় দিয়ে আসি। কেউ রাজি নয় । বলে থানায় গেলে আর ফেরত আসার সম্ভাবনা নেই ! তো কী করা । ভাবছি কী করি। হাতে নিয়েও মহাবিপদে আছি। মনে মনে আল্লাহকে ডাকছি ।
হঠাৎ ওই ভদ্রমহিলা বললো এক কাজ করেন। এ বোতলে ঢালেন। শরবত বানিয়ে বাইরে ফেলে দেন। যে ভাবা সেই কাজ। মামের পানির বোতলে ঢুকিয়ে ভালো করে ঝাঁকুনি দিয়ে শরবত করলাম। তারপর জানালা দিয়ে বাইরে পানি সমেত “শরবতে ইয়াবা ” ঢেলে দিলাম । সবটুকু ফেলে দিয়ে খালি বোতলটাও বাইরে ফেলে দিলাম।
সবাই ভদ্রমহিলার উপস্থিত বুদ্ধির প্রশংসা করলো। সবাই বুঝলো যে, পুলিশ অনর্থক যেখানে সেখানে তল্লাশি করে না। নিশ্চয়ই কোন গোয়েন্দা রিপোর্ট ছিল । হতে পারে যে যাত্রীকে নামিয়ে নিয়ে গেছে সেই যাত্রী কৌশলে টিস্যু প্যাকেটটি গাড়িতে ফেলে দেয় যা গাড়ির টানে ওই ললনার সিটের নিচে নিরাপদ আশ্রয় নিয়েছিল।
পরিশেষে বলবো, সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতিত একা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা মাদক নির্মূল সম্ভব নয়। চট্টগ্রাম-কক্সবাজার-টেকনাফ রুটে যাত্রাপথে সাবধানে চলাফেরা করবেন । অপরিচিত কারো কোন কিছু বহন করবেন না।
মোহাম্মদ আবদুল হাই সম্পর্কে জানতে ক্লিক করে পড়ুন- Mohammad Abdul Hai
: আপডেট, বাংলাদেশ ০৩ : ০৩ এএম, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭ রোববার
ডিএইচ