অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে আগুন জ্বলছে নিত্যপণ্যের বাজারে। পেঁয়াজের পর এবার সিন্ডিকেটের নজর পড়েছে চাল ও আলুর দিকে। রাতারাতি বাড়ানো হচ্ছে দাম। এক সপ্তাহে রাজধানীর খুচরা বাজারে ১০-১৫ টাকা বাড়িয়ে প্রতিকেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা, যা গত বছর একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৩০ টাকা বেশি।
এছাড়া অতি মুনাফালোভী মিলারদের কারসাজিতে ঢাকায় প্রতি বস্তা চালে (৫০ কেজি) ২৫০ ও চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ ৩৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। পর্যাপ্ত মজুদ থাকার পরও আমদানিকারকদের কারসাজিতে প্রতিকেজি পেঁয়াজ সর্বোচ্চ ১০০ টাকা বিক্রি হচ্ছে। পাশাপাশি বাজারে আকাশচুম্বী সব ধরনের সবজির দাম। এছাড়া ডিম, ভোজ্যতেল ও আদাসহ মসলা জাতীয় পণ্য বিক্রি হচ্ছে বাড়তি দরে। সব মিলিয়ে বাজারে পণ্য কিনতে ভোক্তার নাভিশ্বাস বাড়ছে।
সরকারি সংস্থা ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) বলছে, মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি আলু ২০ শতাংশ, চাল সর্বোচ্চ ৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ, প্রতি লিটার ভোজ্যতেলে সর্বোচ্চ ১৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ দাম বেড়েছে। পেঁয়াজ ৭৮ দশমিক ২২ শতাংশ বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া মাসের ব্যবধানে প্রতিকেজি আদার দাম বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ। শুকনা মরিচে প্রতিকেজিতে দাম বেড়েছে ১০ দশমিক ৬৪ শতাংশ। প্রতি হালি (৪ পিস) ফার্মের ডিম মাসের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্যের অস্বাভাবিক এই দাম বৃদ্ধির যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। বাজার তদারকির অভাবে অসাধুরা কারসাজিতে মেতে উঠেছে। বিভিন্ন সময়ে ওই চক্রের সদস্যদের চিহ্নিত করা হলেও তাদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে নানা ইস্যুতে বছরে কয়েকবার নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে বাজার অস্থিতিশীল করে তোলে। আর সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
সোমবার রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও নয়াবাজার ঘুরে খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ দিন প্রতিকেজি আলু বিক্রি হয়েছে ৫০-৫৫ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৪০ টাকা। গত বছর একই সময়ে মূল্য ছিল ২০ টাকা। দাম বাড়ার বিষয়ে জানতে চাইলে কারওয়ান বাজারের বিক্রেতা মো. লিয়াকদ আলী বলেন, বাজারে আলুর কোনো সংকট নেই। ক্রেতারা যে পরিমাণে কিনতে চাচ্ছে সে পরিমাণে বিক্রি করতে পারছি। তবে দেশের যে সব স্থানে হিমাগার আছে সেখানে আলু সংকট জানিয়ে বাড়তি টাকায় বিক্রি করছে। যে কারণে পাইকাররা বেশি দরে আলু এনে বেশি দরে বিক্রি করছে। ফলে আমাদের মতো খুচরা বিক্রেতাদের বেশি দরে আলু আনতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মোস্তফা সোহরাব বলেন, অক্টোবরের দিকে কৃষকরা যে আগাম আলুর চাষ করেন, তা এবার বন্যার কারণে করতে পারেননি। ফলে আগামী ডিসেম্বরে নতুন আগাম আলু আসবে না। আর হিমাগারে যে পরিমাণ আলু আছে তা শেষের দিকে। যে কারণে চাহিদার তুলনায় জোগান পর্যাপ্ত নয়। তাই দাম বেড়েছে। এখানে সিন্ডিকেটের কোনো কারণ নেই।
রাজধানীর খুচরা বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন কোম্পানিভেদে সর্বোচ্চ ৫২০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, যা সাত দিন আগে সর্বোচ্চ ৫১৫ টাকায় বিক্রি হয়। প্রতি লিটার পাম অয়েল (সুপার) বিক্রি হয়েছে ৯০ টাকা, যা এক মাস আগে বিক্রি হয়েছে ৭০ টাকা। প্রতিকেজি আমদানি করা আদা বিক্রি হয়েছে ২৮০ টাকা, যা সাত দিন আগে বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা। দেশি আদা প্রতিকেজি বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা, যা সাত দিন আগে বিক্রি হয়েছে ১৪০-১৫০ টাকা। এছাড়া খুচরা বাজারে প্রতিকেজি দেশি পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৯০-১০০ টাকা, যা সাত দিন আগে ছিল ৮৫-৯০ টাকা এবং আমদানি করা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে ৭০-৮০ টাকা, যা সাত দিন আগে ৬৫-৭০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।
জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক মো. আবদুল জব্বার মণ্ডল বলেন, বাজারে অধিদফতরের একাধিক টিম তদারকি করছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি টিমও কাজ করছে। মনিটরিং জোরদার করা হয়েছে। আশা করি অচিরেই পণ্যের দাম কমে আসবে।
চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, মিল মালিকদের কারসাজিতে চট্টগ্রামেও বাড়ছে সব ধরনের চালের দাম। ধানের সংকট দেখিয়ে বিভিন্ন ধরনের চাল প্রতি বস্তায় ১০০ টাকা থেকে ৩৫০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। নগরীর পাইকারি বাজার পাহাড়তলী, চাক্তাই ঘুরে জানা গেছে, প্রতি বস্তা (৫০ কেজি) মোটা চালের মধ্যে ইরি ১০০ টাকা বেড়ে ২০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আটাশ প্রতি বস্তায় ১২০ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা।
এছাড়া প্রতি বস্তা স্বর্ণা ৫০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩৫০ টাকা। নাজিরশাল বস্তায় ২০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৭০০ টাকা। দিনাজপুরী পাইজাম সিদ্ধ ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৩০০ টাকায়। মোটা সিদ্ধ চাল বস্তায় ১০০ টাকা বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ২৪০০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চাক্তাই-খাতুনগঞ্জের এক চাল বিক্রেতা বলেন, নতুন ধান আসার আগে কিছু মিল মালিক ও ব্যবসায়ী চালের দাম বাড়িয়ে দিয়ে বাড়তি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছেন।
এ বিষয়ে পাহাড়তলী বাজারের পাইকারি চাল ব্যবসায়ী গোলাম হোসেন মিলারদের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, মণপ্রতি ধানের দাম ৯০০ টাকা থেকে বেড়ে সাড়ে ১২শ’ টাকা হয়ে গেছে। এ কারণে চালের দাম বাড়ছে।
বার্তা কক্ষ,১৩ অক্টোবর ২০২০