চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার মিষ্টি পানের কদর সারাদেশে রয়েছে । এখানকার সুস্বাদু পানের সুখ্যাতি রয়েছে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়।
এক সময় হাইমচরে পান চাষীদের অনেক ভালো অবস্থা ছিল। বর্তমানে শ্রমিক সংকট ও পান চাষের উপকরণের মূল্য বেশী হওয়ায় আগের অবস্থা এখন আর নেই।
গত বর্ষা মৌসুমে অতি বৃষ্টিতে এলাকার ৪৫% পানের বরজ পানিতে তলিয়ে যায়। এখন অতিরিক্ত কুয়াশা আর শীতে পান ঝরে যাচ্ছে। সবমিলিয়ে হাইমচরের পান চাষীদের চরম দুর্দিন যাচ্ছে।
পান চাষীদের দাবি, চাষের উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, সময় মতো অর্থ যোগান না থাকা, সরকারী পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে উৎপাদিত পণ্যের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়ার কারণে হাইমচরে পান উৎপাদন ক্রমান্বয়ে কমে যাচ্ছে।
ফলে পান চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে পান চাষীরা। অনেকে পান চাষ ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় জড়িয়ে পড়েছে।
প্রাচীন আমল থেকে অদ্যাবধি পান চাষে এ উপজেলা যেটুকু সফলতা অর্জন হয়েছে তার সবটুকু কৃষকদের ব্যক্তিগত মেধা এবং তাদের নিজস্ব পরিকল্পনায় সম্ভব হয়েছে। পান চাষে সরকারি কোন পৃষ্ঠপোষকতা এবং ঋণ সুবিধা না থাকায় অর্থকারি ফসল পানের চাষ হাইমচর থেকে ক্রমান্বয়ে বিলুপ্তির পথে।
হাইমচরে পান চাষ এলাকা ঘুরে ও চাষীদের সাথে কথা বলে জানা যায় হাইমচর উপজেলার নয়ানী লক্ষ্মীপুর হতে জালিয়াচর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় দীর্ঘ অর্ধশতাব্দি ধরে চাষ হচ্ছে সু-স্বাদু পানের।
হাইমচরের পান এলাকা ছাড়িয়ে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন জায়গায় বাজারজাত করা হত। তখন শ্রমিকের মজুরী, বাঁশ, খৈল, সার, কীটনাশকসহ বিভিন্ন উপকরণের দাম ছিল সস্তা। খরচ পুষিয়ে পান বিক্রির টাকা হাইমচরের পান চাষী মোশারফ হোসেন মশু শা, বাদশা ডাক্তার, ছোবহান বেপারী, ছিডু খাঁ, হাবিবুর রহমান রাড়ীসহ অনেকেই স্বাবলম্বী হয়েছে।
কালের পরিক্রমায় বর্তমানে পান চাষের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে অনেক পান চাষী। হাইমচরকে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁথে বিভক্ত হওয়ার কারণে বন্যা হলে সিআইপি বাঁধের বাহিরের পান বরজ নষ্ট হয়ে যায়।
অন্য দিকে অতিবৃষ্টিতে দ্রুত পানি না নামার কারনে সিআইপি বেড়িবাঁধের ভেতরে পানের বরজ নষ্ট হয়ে যায়। মেঘনার ভয়াবহ ভাঙ্গনে উপজেলার বিশাল এলাকার পানের বরজ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
বর্তমানে নদী ভাঙ্গন চলমান থাকায় পান চাষের উপযোগী জমি কমে যাচ্ছে। ৫ শত টাকার কমে শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
পান চাষের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন বাঁশের। এক সময় হাইমচরে বাঁশ দিয়ে পানের বরজের উপকরণ হয়ে যেতো। এখন চট্রগ্রামের পাহাড়ী অঞ্চল হতে বাঁশ সংগ্রহ করতে হয়। বাঁশের মূল্য অত্যধিক, সার ও কীটনাশকের মূল্য চড়া এবং পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে।
সব মিলিয়ে পান চাষীরা পূর্ব পুরুষদের ঐতিহ্য পান চাষ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে।
গত বর্ষা মৌসুমের উপজেলার ৪৫% পানের বরজ অতি বৃষ্টিতে নষ্ট হয়ে যায়, যেটুকো বাকি আছে তাও শীতের তীব্রতায় ঝরে যাচ্ছে।
পান চাষ সর্ম্পকে উপজেলার পূর্বচরকৃঞ্চপুর গ্রামের পানচাষী আইয়ুব সর্দার জানান, ‘আমাদের পূর্ব পুরুষরা পানচাষ করে আসছিল তা ধরে রাখার জন্য আজও করছি। ৫শত টাকার নিচে এক জন শ্রমিক পাওয়া যায় না, পানচাষ করার জন্য যে সকল উপকরণ দরকার তা দাম অনেক বেশী। পানের বরজে যা খরচ করি তার সিকি ভাগও পান বিক্রি করে পাই না। ভাবছি পান চাষ ছেড়ে দিবো।’
মহজমপুর গ্রামের পান চাষী আবদুল কাদির গাজী জানান ‘গত বর্ষা মৌসুমের বৃষ্টিতে মিশিন দিয়ে পানি সেচেও বরজ রক্ষা করতে পারিনি। বর্তমানে আমার অর্ধেক পানের বরজ উঠিয়ে ফেলেছি। যেটুকু আছে তাও শীতের কারণে ঝরে যাচ্ছে। বাজারে পানের দাম থাকলেও ঝরা পান কেউ দাম দিয়ে কিনে না ।’
অধিকাংশ পান চাষিদের অভিযোগ উপজেলা কৃষি অফিস থেকে তেমন কোন সহযোগিতা ও পরামর্শ পাওয়া যায় না। ফলে বিশ্ব বাজারে পানের চাহিদা বাড়লেও উন্নত চাষ পদ্ধতির অভাবে পানের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হচ্ছেনা।
ব্যাংক ঋণে পদ্ধতিগত অসুবিধা, প্রয়োজনীয় উপকরণের মূল্য বৃদ্ধি, কৃষি অফিস থেকে তেমন কোন সহযোগিতা না পাওয়ায় হাইমচরে হতাশাগ্রস্ত পান চাষিরা পেশা ছেড়ে দিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে।