Home / তথ্য প্রযুক্তি / পৃথিবীর সেরা ছয় তরুণ গবেষকের একজন চন্দ্র নাথ
পৃথিবীর সেরা ছয় তরুণ গবেষকের একজন চন্দ্র নাথ

পৃথিবীর সেরা ছয় তরুণ গবেষকের একজন চন্দ্র নাথ

আনোয়ারা আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে তিন বিষয়ে লেটারসহ স্টার মার্কস পেয়ে এসএসসি পাস করেন ১৯৯৫ সালে। ভর্তি হন চট্টগ্রাম নৌবাহিনী কলেজে। কলেজে পড়ার সময়টা কেটেছে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে। প্রথম বছর ছিলেন এক আত্মীয়ের বাসায়। দ্বিতীয় বছর থেকে তারাও ‘না’ করে দেন। এরপর চন্দ্র নাথের ঠিকানা চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে, একটা চারতলা বিল্ডিংয়ের ছাদে পুরনো পানির ট্যাংকের পাশে। দারোয়ান জায়গাটা পরিষ্কার করে ওপরে টিনের ছাউনি দিয়ে চন্দ্র নাথসহ আরো দুজনকে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। ভাড়া ৪৫০ টাকা। চন্দ্র নাথকে ৩০০ টাকা দিতে হতো। টিউশনি করেই দিতেন সেটা। না ছিল পড়ার টেবিল, না ছিল ফ্যান। শীতটা কোনো রকমে কাটলেও গরমে টেকা দায় হয়ে পড়ত। এ অবস্থার মধ্যেও ক্লাসে প্রথম ছিলেন চন্দ্র নাথ।

অঝোরে কেঁদেছিলেন সেদিন
১৯৯৭ সাল। এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন সময়কার ঘটনা। টেস্ট পরীক্ষায় কলেজে সবার সেরা হয়েছেন চন্দ্র নাথ। কিন্তু প্রথম হওয়া এই ছেলেটির রেজিস্ট্রেশন করাতে রাজি নয় কর্তৃপক্ষ। কারণ বকেয়াসহ রেজিস্ট্রেশনের ফি প্রায় ছয় হাজার টাকা। পরিবারের পক্ষে এত টাকা জোগাড় এক রকম অসাধ্য সাধনের মতো ছিল। রেজিস্ট্রেশনের সময় গড়াল শেষ দিনে। টাকা জোগাড় হয়নি। মাও গেলেন কলেজ কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে, যাতে তারা ফি মওকুফ করে চন্দ্র নাথের রেজিস্ট্রেশনটা করে দেয়। কিন্তু শত অনুনয়-বিনয়েও বরফ গলল না। সম্বল হিসেবে চন্দ্র নাথদের দুটি হালের গরু ছিল। মা তখন বললেন, ‘তাহলে গরু বেচে দিই। ’ চন্দ্র নাথ বললেন, ‘মা, আরেকটু দেখি। ’ সাড়ে ৪টার মতো বেজে গেছে। ৫টায় অফিস বন্ধ হবে। তার পরও চন্দ্র নাথের ডাক পড়ল না। ভাবলেন—আগে একবার পড়া-লেখা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এত কষ্ট করে এত দূর এলাম। এখানেই কি থেমে যেতে হবে?’ একবার আত্মহত্যার কথাও ভেবেছিলেন। পরক্ষণে মায়ের মুখটা ভেসে উঠল চোখের সামনে। ‘মা যদি পারেন, আমি কেন পারব না?’ নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন। কিন্তু চোখের জল বেশিক্ষণ বাঁধ মানেনি। মনের দুঃখে সেদিন কলেজের বারান্দায় অধ্যক্ষের রুমের কাছে দাঁড়িয়ে অঝোরে কেঁদেছিলেন। শেষ মুহূর্তে এগিয়ে এলেন বন্ধু-বান্ধব ও শিক্ষকরা। পরের দিন আরো ১০০ টাকা জরিমানা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করালেন। এইচএসসিতে প্রথম বিভাগ পেয়েছিলেন। সেবার দুটি বিষয়ে লেটার মার্কসসহ তিনিই নৌবাহিনী কলেজ থেকে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন।

‘বুয়েট আমার আত্মবিশ্বাসের নাম’
এইচএসসির পর সহপাঠীরা সবাই বিভিন্ন কোচিং সেন্টারে ভর্তি হলো। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে চন্দ্র নাথ কোচিং করতে পারছেন না। একটি প্রসপ্রেক্টাস পেয়ে একদিন ব্রেইনওয়াশ কোচিং সেন্টার নামে একটি কোচিং সেন্টারে গেলেন মূলত মেরিনে ভর্তির আগ্রহ নিয়ে। কারণ দুই বছরের কোর্স। এরপর চাকরি। সেন্টারটির পরিচালক এম এম বাশার চন্দ্র নাথকে বেশ কিছু প্রশ্ন করলেন। জবাব দেওয়ার পর বললেন, ‘তুমি তো বুয়েটে পড়তে পারো। ’ এর আগে বুয়েটের নাম শোনেননি। পরে বিনা ফিতে চন্দ্র নাথকে ভর্তি করালেন তিনি। বুয়েটে ভর্তি পরীক্ষা দিলেন। সুযোগ পেলেন যন্ত্রকৌশল বিভাগে। চন্দ্র নাথ বললেন, ‘বিশ্বাস করবেন কি না জানি না। বুয়েটে চান্স পাওয়ার দিনটিই আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন। ’ আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি, সফলতার সিঁড়ি বেয়ে এগিয়ে চলেছেন। ২০০৪ সালে সাফল্যের সঙ্গে শেষ করেন প্রকৌশল বিদ্যার পাঠ। বুয়েটে ১৩৩ জনের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন। ভালো রেজাল্টের কারণে প্রতি সেমিস্টারে মেরিট অ্যাওয়ার্ড, ডিন বৃত্তি, রশীদ মেমোরিয়াল স্কলারশিপ, বুয়েট ’৭০ স্কলারশিপ, ইঞ্জিনিয়ার্স ক্লাব স্টাইপেন্ড, টেকনিক্যাল স্কলারশিপ এবং জেলা বৃত্তিসহ মোট ২৬টি বৃত্তি ও পুরস্কার পেয়েছেন। বুয়েটের পাট চুকিয়ে চুয়েটে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছিলেন। বুয়েটে থাকতেই জীবনকে বুঝতে শিখেছেন। বললেন, ‘বুয়েট আমার আত্মবিশ্বাসের নাম। ’

বিদেশেও সেরাদের কাতারে
বুয়েট থেকে পাস করার পর সিঙ্গাপুরের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্কলারশিপের আবেদন করেন। সিঙ্গাপুরের শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে পিএইচডি স্কলারশিপ নিয়ে সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমান। তখন তাঁর ঠিকানা ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর।

বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে সবচেয়ে কম নম্বর পেয়েছিলেন ‘ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের (আইপিই)’ একটি কোর্স ‘প্রডাকশন প্রসেসেস’—অর্থাৎ ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে। চ্যালেঞ্জ হিসেবে সেই বিষয়ই বেছে নিলেন পিএইচডি গবেষণার জন্য। সেই ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে গবেষণায় এখন তিনি সারা পৃথিবীর ম্যানুফ্যাকচারিং গবেষক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত! নিজেকে নিয়ে গেছেন বিশ্বের সামনের সারির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অধ্যাপক এবং বড় বড় কম্পানির অভিজ্ঞ ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারদের কাতারে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর থেকে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমানের অধীনে পিএইচডি করেন ২০০৮ সালে। এরপর রিসার্চ সায়েন্টিস্ট হিসেবে বছর দুয়েকের মতো কাজ করেন সিঙ্গাপুর ইনস্টিউিউট অব ম্যানুফ্যাকচারিং টেকনোলজিতে। ২০১১ সাল থেকে পোস্ট ডক্টরাল রিসার্চার হিসেবে অধ্যাপক রিচার্ড ই ডেভর ও ড. শিব কাপুরের অধীনে একই বিষয়ে গবেষণা করছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা-শ্যাম্পেইনে (ইউআইইউসি)। এখন থাকেন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে। গবেষক হিসেবে কাজ করেন বিখ্যাত জাপানি কম্পানি হিটাচিতে। হিটাচিতে যোগদান করার আগে জর্জিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে বছরখানেক পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করেন।

ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ‘দ্য সোসাইটি অব ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারস’। ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে উচ্চমানের গবেষণা, সফলতা এবং নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ সংগঠনটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড অ্যান্ড রিকগনিশন কমিটি ২০১৪ সালে চন্দ্র নাথকে দিয়েছে অত্যন্ত সম্মানজনক ‘আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার অ্যাওয়ার্ড’। ওই বছর এই অ্যাওয়ার্ডপ্রাপ্ত পৃথিবীর সেরা ছয় তরুণ গবেষকের একজন ছিলেন চন্দ্র নাথ। পোস্ট ডক্টরেট লেভেলের গবেষক হিসেবে এ রকম সাফল্য খুবই বিরল।

সাড়া ফেলে দেওয়া গবেষণা
এরোস্পেস, অফসোর (নৌযান বা মেরিন), অটোমোবাইল, বায়োমেডিক্যালের যন্ত্রপাতি ও কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তৈরিতে বহুল ব্যবহৃত টাইটানিয়াম এবং নিকেলের সংকর, স্টিল ইত্যাদি ধাতব বস্তু স্বাভাবিক পদ্ধতিতে মেশিনিং করা খুব কষ্টসাধ্য। এই মেশিনিং প্রসেসকে সহজ করতে সম্পূর্ণ নতুন ধরনের ‘কাটিং ফ্লুয়িড অ্যাপ্লিকেশন সিস্টেম’ উদ্ভাবন এবং কার্যকরভাবে প্রয়োগের উপায় বের করেছেন চন্দ্র নাথ। এই গবেষণা কাজটির কারণেই সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলে দিয়েছেন চন্দ্র নাথ।

এই গবেষণা বেশ জটিল। কিন্তু চন্দ্র নাথ সেটিকে সহজসাধ্য করেছেন। যেকোনো ধরনের কাঠামোগত প্রক্রিয়ায় ব্যবহারের জন্য একটি ধাতব বস্তুকে কেটে প্রয়োজনমতো একটি নির্দিষ্ট আকৃতিতে নিয়ে আসা হয়। এ রকম মেটাল বা ধাতু কাটার সময় টুল এবং যে বস্তু কাটা হচ্ছে তার মধ্যে ঘর্ষণের ফলে মাত্রাতিরিক্ত (১ থেকে ২ হাজার ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত) তাপ সৃষ্টি হয়। মেটাল কাটিংয়ের সময় এই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে না পারলে টুল বা কাটার খুব তাড়াতাড়ি ক্ষয়ে যায়। যার ফলে প্রক্রিয়াটি অনেক বেশি ব্যয়বহুল ও কষ্টসাধ্য। এ ছাড়া অনেক সময় কাঙ্ক্ষিত আকারের বস্তুও পাওয়া যায় না। কারণ উচ্চ তাপমাত্রায় বস্তুর আকার সহজেই পরিবর্তন হয়ে যায়।
মেটাল কাটিংয়ের সময় টুলের কোণে মাত্র দুই থেকে তিন বর্গমিলিমিটার জায়গাজুড়ে এই উচ্চ তাপমাত্রার সৃষ্টি হয়। কিন্তু তা নিয়ন্ত্রণের জন্য সাধারণ পদ্ধতিতে মাত্রাতিরিক্ত হারে (মিনিটে এক থেকে পাঁচ লিটার পর্যন্ত) কাটিং ফ্লুয়িড ব্যবহার করা লাগে। তবে এই কাটিং ফ্লুয়িডের খুব সামান্য অংশই তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের কাজে লাগে। বাকিটা অপচয় হয়। কাটার সময় বস্তু থেকে উৎপাদিত চিপ বের হওয়ার কারণে টুলের ওই অংশ ঢাকা থাকে। তাই উচ্চ তাপমাত্রা খুব একটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায় না। আর ফ্যাক্টরিতে বিপুল পরিমাণ কাটিং ফ্লুয়িড জোগান দিতে কম্পানিগুলোর খরচ হচ্ছে বিপুল অর্থ।

কাটিং ফ্লুয়িড হলো এক ধরনের কেমিক্যাল। এর অধিক ব্যবহার মেশিন অপারেটর থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যহানিসহ পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। আবার নির্দিষ্ট সময় পর তা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে।

চন্দ্র নাথ বললেন, ‘এই কাটিং ফ্লুয়িড ব্যবহারের একটা কার্যকর সমাধান বের করার চ্যালেঞ্জ নিয়েই কাজ শুরু করেছিলাম। ’ তাঁর উদ্ভাবিত প্রযুক্তির নাম ‘এটমাইজেশন-বেইসড কাটিং ফ্লুয়িড (এসিএফ) স্প্রে সিস্টেম’। একটা আল্ট্রাসনিক এটমাইজার, একটা ফ্লুয়িড ট্যাংক, উচ্চবেগ গ্যাস ডেলিভারি টিউব এবং দুটি টিউব সংবলিত একটি নজল অ্যাসেমব্লির সমন্বয়ে এটা তৈরি। এটা কিভাবে কাজ করে জানতে চাইলে চন্দ্র নাথ বললেন, ‘এটি দিয়ে টুলের ওপর চিপের কাছে কাটিং ফ্লুয়িডের অতি ক্ষুদ্র কণা স্প্রে করা হয়। এতে ফ্লুয়িডের খুব পাতলা (২০ থেকে ৪০ মাইক্রোমিটার পুরু) উচ্চবেগে প্রবহমান ফিল্ম উৎপন্ন হয়ে সরাসরি টুল ও চিপের অভ্যন্তরীণ ছোট সেই জায়গায় সহজে ঢুকে যায়। ফলে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে এবং ঘর্ষণ কমে। এই সিস্টেমে কাটিং ফ্লুয়িডের ব্যবহার মাত্র ১০ থেকে ২০ মিলিলিটার। যা সাধারণ কুলিং সিস্টেমের তুলনায় একেবারে কম (মাত্র ১ থেকে ২ শতাংশের মতো)। ’ চন্দ্র নাথের উদ্ভাবিত এই পদ্ধতিতে টাইটানিয়াম কাটার সময় টুলের স্থায়িত্ব ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ বাড়তে দেখা যায়।

যেহেতু এই সিস্টেমে কাটিং ফ্লুয়িড খুব কম লাগে, তাই এর সুবিধা অনেক। উচ্চমাত্রার বিদ্যুত্শক্তি (৫০০ থেকে ১৫০০ ওয়াট) চালিত পাম্প চালানো লাগে না। দামি ফিল্টারও বসাতে হয় না। যেটা সাধারণ পদ্ধতিতে লাগে কাটিং ফ্লুয়িড পুনঃ চালনার জন্য। চন্দ্র নাথ উদ্ভাবিত পদ্ধতির আরেকটা সুবিধা হলো, এতে কাটিং ফ্লুয়িড তেমন একটা অব্যবহৃত থাকে না। যে কারণে পরিবেশের ক্ষতি ও মানুষের স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কাও থাকে না। গ্যাস হিসেবে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইডও ব্যবহার করা হয়। তাই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণও কমে। উল্লেখ্য, এই সিস্টেমে একমাত্র বিদ্যুত্শক্তিচালিত ইউনিট এটমাইজার। যেটা কাটিং ফ্লুয়িডকে অতি ক্ষুদ্র কণায় পরিণত করে। চালাতে বড়জোর ১৫ ওয়াটের মতো বিদ্যুৎ লাগে। যা সাধারণ একটা টিউবলাইটের চেয়েও কম।

এসব সুবিধার কারণে মেটাল কাটিং বা অন্য ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পরিবেশবান্ধব এই পদ্ধতি ব্যবহারে উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়বে বলে আশা প্রকাশ করেছেন বিজ্ঞানীরা। আর এটা এত ছোট যে একটা মেশিন ল্যাবের যেকোনো মেশিনে সহজেই স্থাপন করা বা লাগানো যায়।

শুরুতে কাটিং ফ্লুয়িড প্রয়োগের একটা কার্যকর পদ্ধতি উদ্ভাবনের জন্য ফান্ডিং আসে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইয়ো অঙ্গরাজ্যের একটা এরোস্পেস ম্যানুফ্যাকচারিং কম্পানি টেক সলভ ইনকরপোরেশন থেকে। চন্দ্র নাথের উদ্ভাবিত কাটিং ফ্লুয়িড স্প্রে সিস্টেমের সফলতার কারণে পরে ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন থেকেও অর্থায়ন করা হয়।

স্বীকৃতিও মিলেছে
এই সিস্টেমের কার্যকর প্রয়োগ নিয়ে চন্দ্র নাথ ও গবেষক অ্যালেক্স হয়নের লেখা নিবন্ধ গত বছরের জুনে আমেরিকার উইসকনসিনে ‘দি আমেরিকান সোসাইটি অব মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারস (এসএমই)’ আয়োজিত ‘ইন্টারন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কনফারেন্স’-এ ‘বেস্ট পেপার অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছে।

তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় ২০১৩ সালে এই প্রযুক্তির একটি প্যাটেন্ট করেছে। একই বছরের আগস্টে চন্দ্র নাথের গবেষণাকে ‘এসএমই’ তাদের ম্যানুফ্যাকচারিং ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যাগাজিন ‘টেকফন্ট’-এ ‘সাসটেইনেবলিটি প্রগ্রেস’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। এসএমইর এই অ্যাওয়ার্ড নিয়ে চন্দ্র নাথের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট বের করেছে বিশেষ ফিচার। বিশ্বখ্যাত আমেরিকান কম্পানি জেনারেল ইলেকট্রিক এবং জাপানের হিটাচি চন্দ্র নাথের প্রযুক্তি নিয়ে

ইতিমধ্যে তাদের আগ্রহের কথা জানিয়েছে। জেনারেল মোটরসের টেকনিক্যাল ফেলো ড. জন আগাপিউ এই প্রযুক্তিকে উল্লেখ করেছেন ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের একটা বড় সাফল্য হিসেবে। ইউআইইউসি ল্যাবের বাইরে টেক সলভ ইন করপোরেশনও তাদের ল্যাবে এই প্রযুক্তির আরো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই চন্দ্র নাথের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির বাণিজ্যিক ব্যবহার শুরু হবে।

এই প্রজেক্ট ছাড়া আরো বেশ কয়েকটি প্রজেক্টে কাজ করছেন চন্দ্র নাথ। গবেষণার পাশাপাশি তিনি নিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং লেকচারার হিসেবেও বছরখানেক কর্মরত ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমানোর আগে সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ম্যানুফ্যাকচারিং ইনস্টিটিউটে বিজ্ঞানী হিসেবে কাজ করেছেন বছর দুয়েক। অ্যাডভান্সড মাল্টিস্কেল ম্যানুফ্যাকচারিং নিয়ে তাঁর ৫০টির বেশি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নাল, কনফারেন্স এবং বইয়ের অধ্যায়ে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালের বইমেলায় বুয়েট ও বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত দুটি সংকলনে তাঁর পাঁচটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।

আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, চীন, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আন্তর্জাতিক সেমিনারে তিনি তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০০৯ সালে জাপানের কিতাকিয়োশোতে ‘প্রিসিশন ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর ওপর আয়োজিত একটি ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে এশিয়ার ছয়টি দেশ—জাপান, চীন, হংকং, থাইল্যান্ড, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের ছয়জন তরুণ গবেষকের সঙ্গে পেয়েছিলেন ‘ইয়ং রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’। বর্তমানে ১০টির বেশি আন্তর্জাতিক জার্নালের ‘রিভিউয়ার’ তিনি। ‘আউটস্ট্যান্ডিং রিভিউয়ার অ্যাওয়ার্ড’ও পেয়েছেন একবার। বিখ্যাত ‘জার্নাল অব ম্যানুফ্যাকচারিং প্রফেসেস’-এর এডিটরিয়াল বোর্ডের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য তিনি।
অন্যের কথাও ভাবেন
এখন আমেরিকার মিশিগানে থাকেন চন্দ্রনাথ। হিটাচির অ্যাডভান্স ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যান্ড ডিজাইন বিভাগের রিসার্চার। নিজেকে সব সময় সাধারণ মানুষের কাতারে ভাবতেই পছন্দ করেন। নিজের দেশ, শিকড়কে ভুলতে রাজি নন বিন্দুমাত্র। স্মৃতির ঝাঁপি খুলে বলছিলেন—‘১৯৯১ সালের কথা। চট্টগ্রামে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী দিনগুলোতে আমি দাঁড়িয়েছিলাম বিশাল লম্বা লাইনে, পেটের ক্ষুধা চেপে। মাঝেমধ্যে সন্ধ্যা গড়িয়েছে ওই লাইন শেষ হতে। কখনো দাঁড়িয়েছি একটা কম্বলের জন্য, আবার কখনো দুমুঠো চালের জন্য। কখনো কোনো ধনী পরিবারের উঠানে, আবার কখনো বা ইউনিয়ন বোর্ডের সামনে করিডরে। ’ সেই সব অসহায় মানুষের কথা মনে আছে। দেশে এ রকম মানুষদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য ‘মানুষ মানুষের জন্য’ নামের একটি চ্যারিটি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছেন। প্রতিবছর এই ফাউন্ডেশন থেকে শিক্ষার্থীদের সহায়তা, শীতার্ত মানুষের জন্য গরম কাপড়, চিকিৎসাসেবাসহ নানা সেবা দেওয়া হচ্ছে। চেষ্টা করেন বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মেধাবী শিক্ষার্থী ও দরিদ্র পরিবারগুলোর পাশে দাঁড়ানোর। সে জন্য ২০০৯ সাল থেকে আনোয়ারা থানায় নিজের হাই স্কুল, যেখানে তিনি পড়াশোনা করেছেন, সেখানে মায়ের নামে একটা ট্রাস্ট ফান্ড বৃত্তি চালু করেছেন। প্রতিবছর ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণির প্রতিটি ক্লাসের তিনজন শিক্ষার্থীকে দিচ্ছেন ছাত্রবৃত্তি। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের আর্থিকভাবে অসচ্ছল ৭০ জন শিক্ষার্থীর জন্য মাসে মোট প্রায় তিন লাখ টাকার মতো বৃত্তি প্রদান করছে মানুষ মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন।(এই বেলা)

নিউজ ডেস্ক:
আপডেট, বাংলাদেশ ৫:০৫ পিএম, ২৬ নভেম্বর, ২০১৭ রোববার
এএস

Leave a Reply