পিতার চোখের সামনেই ছেলেকে গুলি করলো মিয়ানমার সেনাসদস্য। বাড়ির সবাইকে হত্যা করা হলো। শিশু ও নবজাতকদের ছুড়ে ফেলে দেয়া হলো পানিতে। সেনাবাহিনীর নৃশংসতা থেকে রক্ষা পায় নি ৬ মাস বয়সী শিশু হাসিনা।
পাশে দাঁড়িয়ে বা আত্মগোপনে থেকে এসব দৃশ্য প্রত্যক্ষ করেছেন রোহিঙ্গা পিতা-মাতারা। এরপর পালিয়ে বাংলাদেশে এসে বিদেশি মিডিয়ার কাছে এমন সব সাক্ষ্য দিয়েছেন তারা। এ সময় ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে আসতে থাকে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য গার্ডিয়ান ও বার্তা সংস্থা এএফপি।
তাদের মধ্যে অন্যতম ১৬ বছর বয়সী জুনায়েদের পিতা মোহাম্মদ আলী, জহির আহমেদ, খালেদ হোসেন, পিতম আলী, কবির আহমেদ, মোহাম্মদ ইদ্রিস। এর মধ্যে রাখাইনের তুলাতলির জহির আহমেদ বর্ণনা করেছেন ভয়াবহ এক চিত্র।
তিনি বলেছেন, তিন দিক থেকে পানিতে আবদ্ধ তাদের গ্রাম। ফলে সেনাবাহিনী তা ঘিরে তাদের সবাইকে নিয়ে যায় একদিকে। তিনি কৌশলে পালিয়ে নদীর সরাসরি অন্যপ্রান্তে পৌঁছে যান। সেখানে ঘন জঙ্গলে পালিয়ে প্রত্যক্ষ করেন নিজের পুরো পরিবারের ওপর ধ্বংসলীলা। জহির আহমেদের বয়স ৫৫ বছর।
তিনি পরিবারের সবাইকে হারিয়েছেন। বলেছেন, আমি জঙ্গলে আত্মগোপন করে অপেক্ষা করি। শুনতে পাই সেনাবাহিনী গুলি করছে। ঠিক উল্টোদিকে তখন আমি নদীর অপর পাড়ে। এক পর্যায়ে পরিবারের সদস্যদের বাঁচাতে এগিয়ে যায় আমার ছেলে। কিন্তু কাউকে বাঁচতে দেয় নি তারা। বলতে বলতে কেঁদে ফেলেন তিনি।
জহির আহমেদ বলতে থাকেন, আমার স্ত্রী রাবিয়া বেগম (৫০), বড় ছেলে হামিদ হাসান (৩৫), মেয়ে নাইমা (২/৩), ছেলে রশিদ (৭ মাস), ছেলে নূর কামেল (১২), তৃতীয় ছেলে ফয়জুল কামেল (১০), চতুর্থ ছেলে ইসমাইল (৭), বড় মেয়ে সফুরা (২৫), তার স্বামী আজির হাসান (৩৫), আমার দ্বিতীয় মেয়ে সানজিদা (১৪), তৃতীয় মেয়ে ইস্তফা (৬), চতুর্থ মেয়ে শাহিনা বেগম (৫), ষষ্ঠ মেয়ে নূর শোমি (৩), সপ্তম মেয়ে হাসিনা (৬ মাস)কে মেরে ফেলেছে ওরা। আমার চোখের সামনে এসব ঘটেছে। হাসিনাকে ওরা দূরে পানিতে ফেলে দিয়েছে। আমি নাড়ির টানে সেখানে ৫ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি।
তারপর যখন দেখলাম সব শেষ তখন চলে আসি বাংলাদেশে। ওদিকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বিছানার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে ১৬ বছর বয়সী মোহাম্মদ জুনায়েদকে। তার শরীরে রয়েছে গুলির আঘাত। মাথায় গুলি লেগেছে তার। তাকে পেইন কিলার দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এর কার্যকারিতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অসহ্য বেদনায় চিৎকার করছেন জুনায়েদ।
তিনি উঠে বসার চেষ্টা করছেন। বিছানা থেকে যাতে উঠতে না পারেন সেজন্য তার দু’হাত ও পা বেঁধে রাখা হয়েছে। জুনায়েদের পিতা মোহাম্মদ নবী।
তিনি বলেছেন, সেনারা আমার চোখের সামনে জুনায়েদকে গুলি করে। এরপর থেকেই মারাত্মক ব্যথায় কাতরাচ্ছে সে। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে গুলিতে গুরুতর আহত রোহিঙ্গাদের। কিন্তু এত বেশি রোহিঙ্গা রোগী আসছে যে তাদেরকে জায়গা করে দেয়া যাচ্ছে না আর।
অনেকে আশ্রয় নিয়েছেন মেঝেতে। সেখানেই ৭০ রোহিঙ্গাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। এর মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
প্রসঙ্গত, মিয়ানমার সীমান্ত থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল। এখানকার সার্জন কামাল উদ্দিন এএফপিকে বলেছেন, চিকিৎসাসেবার সরঞ্জাম সীমিত। দরিদ্র রোহিঙ্গাদের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তারা গুরুতর আহত। তাদের ভবিষ্যৎও অনিশ্চিত।
ওদিকে জুনায়েদের পিতা মোহাম্মদ নবী মংডু থেকে পালিয়ে আসার সময় তার ছয় সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। পরে তিনি শুনেছেন, তার সন্তানরা সীমান্ত পার হতে পেরেছে।
খালেদ হোসেন (২৯) একজন দিনমজুর। তিনি বলেন, গণহত্যা শুরুর তিনদিন আগে তার গ্রামে প্রবেশ করে প্রায় ৯০ জন সেনা সদস্য। তারা গ্রামের কয়েক শত বাসিন্দাকে মাঠের মধ্যে হাজির হতে বলে। এ সময় ওই সেনা সদস্যদের নেতা যিনি তার কাঁধে দেখা যায় দুই তারকা।
ওই কর্মকর্তা আমাদের বলেন, রাখাইনে লোকজনকে সেনারা হত্যা করছে বলে গ্রামে খবর ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু আপনারা সবাই কৃষিকাজ ও মাছ ধরা চালিয়ে যেতে পারবেন। আমরা আপনাদের একটিই কথা বলবো। তা হলো সেনাদের দেখলে দৌড়াবেন না। যদি দৌড়ান তাহলে আমরা গুলি করবো। এই বক্তব্য দেয়ার পরে সেনা সদস্যরা বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে। এ সময় তাদের সঙ্গে ছিল রাখাইনের বৌদ্ধরা। তারা স্বর্ণালংকার, নগদ অর্থ, কাপড়চোপড়, আলু, ধান, চাল যা পেয়েছে সবই নিয়ে গেছে। তারা তিন চারজনের বাড়িতে ধ্বংসলীলা চালায়।
তাদের অভিযোগ এসব বাড়ির মানুষ গুজব ছড়িয়ে দিয়েছে। তারা যোদ্ধা খুঁজছিল। এমন আরেকজন রোহিঙ্গা হলেন ধান-চালের ডিস্ট্রিবিউটর পিতম আলী। তিনি বলেছেন, হামলা শুরুর আগের দিন সেনাবাহিনীর হাত থেকে রেহাই পেতে দুয়ালতলি নদী পাড়ি দেয়া শুরু করি। এই নদীতেই মারা যান কমপক্ষে ১০ জন।
পিতম দেখতে পেয়েছেন নদীর অপর পাড়ে তাদের গ্রাম জ্বলছে। পরের দিন ভোর সাড়ে তিনটার দিকে তিনি গুলির শব্দ শুনতে পান। তবে সেটা কোন্দিক থেকে আসছিল তা তিনি জানেন না।
তিনি বলেন, আমি গ্রামের উত্তর দিকে বসবাস করতাম। সেনাবাহিনী নদী অতিক্রম করে উত্তরদিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এ সময় আমি ও আমার পরিবার পালাতে জঙ্গলের দিকে ছুটি। সকাল ৮টা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষায় থাকি। সেনারা গাঢ় সবুজ পোশাক পরে গ্রামে ঢোকে। তারা সবাই পায়ে হেঁটেই প্রবেশ করে। আমি এবার দৌড়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে ছুটে যাই।
আমাদের ভীষণ তাড়াহুড়ো ছিল। আমার দাদীও ছিলেন খুবই বৃদ্ধ। জঙ্গলে বসেই দেখতে পেলাম আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে সেনারা। তুলাতলি গ্রামে এই বাড়িটিই প্রথমে পোড়ানো হয়। পিতম আলীর পরিবারে সদস্য ১৬ জন।
তারা তিন ভাই। পরিবারের সবার থাকার জন্য আট রুমের বাসা বানানো হয় কাঠ দিয়ে। এ জন্য এ বাড়িটিতে আগুন দেয়ায় তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সেনারা রকেটচালিত গ্রেনেড ছুড়ে মারে। তারা পাশের বাড়িগুলোতে ম্যাচকাঠি দিয়ে অগ্নিসংযোগ করতে থাকে।
এভাবে সব বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। রাস্তার ওপর একটি মৃতদেহ দেখতে পাই। আমি তাকে চিনতে পারি। তিনি হলেন আবু শামা। তার বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর। পিতম আলী তার বাড়ি ফিরে গিয়ে দেখতে পান সেখানে পড়ে আছে তার দাদীর মৃতদেহ। তার নাম রুকেয়া বানু। বয়স ৭৫ বছর। পিতম ফিরে যান জঙ্গলে। বলেন, পরিবারের বাকি সদস্যদের কাছে পুরো ঘটনা খুলে বলি।
এ সময় তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তারপর আমরা তিন দিন ধরে হাঁটতেই থাকি। নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মধ্যে ৭৫ বছর বয়সী ধান চাষী কবির আহমেদ অন্যতম। তিনি বলেন, আমি যখন শুনতে পাই সেনাবাহিনী উত্তর দিক থেকে আক্রমণ শুরু করেছে, সঙ্গে সঙ্গে আমি নদীতে ঝাঁপ দিই। এ সময় ১০ ও ১২ বছর বয়সী আমার দুটি ছেলে আমার সঙ্গে সাঁতার দেয়। কবির আহমেদের পরিবারের আট জন সদস্য নিহত হয়েছেন।
তিনি বলেন, সেনাবাহিনী যখন অভিযান চালায় তখন তারা শিশুদের নদীতে ছুড়ে ফেলেছে। আমার তিন বছর বয়সী নাতি মাকারা, পুতি আবুল ফয়েজকেও একই পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। আমি নদীর দক্ষিণ পাশে আত্মগোপন করেছিলাম। হামলাকারী সেনা সদস্য ও তাদের সাঙ্গাপাঙ্গরা যাদের সামনে পেয়েছে তাদের সবাইকে এক করেছে।
তারপর তাদের হাঁটতে বলে। এরপরই তাদেরকে গুলি করা হয়। এ সময় আমরা পাহাড়ের আড়ালে, গাছের আবডালে পালিয়ে ছিলাম। সন্ধ্যার দিকে তারা নদীর পাড়ে জমা করে সব মৃতদেহ। মাটিতে গর্ত করে তার ভেতর ফেলে পুড়িয়ে ফেলে। আমার অবস্থান থেকে মাত্র ৪০ মিটার দূরে এ ঘটনা ঘটে। তারা পোড়ানো মৃতদেহগুলো দুই থেকে তিন মিটার দূরে মাটিচাপা দেয়।
মোহাম্মদ নবীর ছোট ছেলে বশির উল্লাহ। ১৪ বছরের রোহিঙ্গা কিশোর বশির উল্লাহরও পায়ে গুলি লেগেছে। সীমান্তের কাছে বেসরকারি একটি হাসপাতালে তাকে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। সেখানে ব্যথায় কাতরাতে কাতরাতে বশির উল্লাহ বলেন, প্রাণ বাঁচাতে যখন আমরা ছুটছিলাম, তখন সেনাসদস্যরা নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। আমি মাটিতে পড়ে যাই। পায়ে গুলি এসে লাগে। আমি সৌভাগ্যবান। গুলি লাগলেও আমার খুব বেশি রক্তক্ষরণ হয়নি।
গ্রামে আরো অনেককে হত্যা করা হয়েছে। ২২ বছরের রোহিঙ্গা তরুণ হোসেন জহুর। তিনি বলেন, মাঝরাতে সেনারা আমার গ্রামে প্রবেশ করে। আমাকে ও পরিবারের সবাইকে বাড়ি থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে। সেনারা আমাদের মারধর করে এবং অত্যাচার চালায়।
একপর্যায়ে আমি পালানোর চেষ্টা করি। কিন্তু এক সেনা আমার দিকে বোমা ছুড়ে মারে। বোমা বিস্ফোরণে আমার হাতের কিছু অংশ উড়ে যায়। তা সত্ত্বেও আমি হেঁটে পাড় হই সীমান্ত। তিনি এখন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন।
জহুর বলেন, মিয়ানমার সেনাবাহিনী আমাদের সঙ্গে কুকুরের মতো আচরণ করে। আমাদের পূর্বপুরুষরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সেখানে বসবাস করছে। তারপরও সেনারা রোহিঙ্গাদের উচ্ছেদ করতে চায়।
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ ১১: ৫০ পিএম, ০৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ শনিবার
ডিএইচ