সারাদেশ

পিঠে করে ২২ বছর সন্তানকে টানছেন মা!

তখন রাত সাড়ে ১০টা। কমলাপুর রেলস্টেশনে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ট্রেন এসে থামছে। আবার ছেড়েও যাচ্ছে। কেউ ব্যাগ হাতে ট্রেন থেকে নামছেন কেউবা ট্রেনের অপেক্ষায়। হকারদের হাক ডাকের পাশাপাশি কুলিদের ব্যস্ত ছুটে চলা প্ল্যাটফর্মজুড়েই।

৫ নম্বর প্লাটফর্মে এসে দাঁড়ালো রাজশাহী থেকে ছেড়ে আসা পদ্মা এক্সপ্রেস। যাত্রীদের মুহূর্তেই ভিড়। ব্যাগ-ব্যাগেজ নিয়ে সবাই ব্যস্ত স্টেশন থেকে বের হওয়ার জন্য। ইতোমধ্যে ট্রেন থেকে নেমে অনেকেই হাঁটা শুরু করেছেন প্ল্যাটফর্ম ধরে।

ভিড় ভেদ করে বিপরীত দিক থেকে আসছেন এক মহিলা। দূর থেকে মনে হচ্ছে কি যেন আছে তার পিঠে। কাছে আসায় ভালোভাবে দেখতে পেলাম মহিলাটি কাউকে পিঠে করে টেনে নিয়ে আসছেন। হাতে একটি ব্যাগও। মহিলাটির যে খুব কষ্ট হচ্ছে সেটা তার কপালে ঘাম ঝরা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।

স্টেশনে অপেক্ষমাণ যাত্রীদের দৃষ্টি তখন ওই মহিলার দিকে। মনে হচ্ছে তিনি কিছু একটা খুঁজছেন। অনেকটা আগ্রহ থেকেই এগিয়ে গিয়ে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি উত্তরবঙ্গগামী লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি খুঁজছেন, যাবেন গাইবান্ধা।

সিগনাল আসছে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৬ নন্বর প্ল্যাটফর্মে অবস্থান করছে, যেই বলা সেই আবার দ্রুত তার ছোটাছুটি। নিজের পিঠে আরেকজনকে টেনে যাওয়ার কারণে মনে হচ্ছে তার দম বন্ধ প্রায়। এরমধ্যে আবার প্ল্যাটফর্ম থেকে রেললাইন পার হয়ে ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্মে যেতে হবে। পিঠে একজনকে ঝুলিয়ে নেয়ার কারণে তিনি একা একা পার হতে পারছিলেন না। এ সময় অন্য একজন যাত্রী এসে মহিলাটির ব্যাগ নিয়ে, পিঠে থাকা আরেকজকে ধরে রেললাইন পার হতে সাহায্য করলেন।

এরপরই প্ল্যাটফর্ম ধরে ট্রেনটির দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় আলাপ হয় মহিলার সঙ্গে। জানা গেল তিনি ওই সন্তানের মা। নিজের পিঠে করে যাকে টেনে আনছেন সে তার শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী সন্তান সুমন। ২২ বছর ধরে এভাবেই নিজের পিঠে সন্তানকে টানছেন মা সোনা বানু। ৪ বছর আগে স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করে চলে তার সংসার। এছাড়া আরও দুই ছেলে-মেয়ে আছে তার।

আলাপকালে তিনি বলেন, এই প্রতিবন্ধী সন্তানকে নিয়ে ভিক্ষা করে সংসার চলে আমাদের। রাজধানীর মেরাদিয়ায় একটি বস্তিতে ২৭শ’ টাকায় ভাড়ায় থাকি। ভিক্ষার টাকায় ভালোভাবে সংসার চলে না, তবুও খেয়ে পরে বেঁচে থাকার চেষ্টা। জন্ম থেকে আমার এই সন্তান প্রতিবন্ধী, কিন্তু আমি তো মা। মা তো আর সন্তানকে ফেলে দিতে পারে না। তাই আমার পিঠে করেই ঘুরে সে। তাকে তুলে খাওয়ানোসহ মলমূত্র সব কিছুই আমার পরিষ্কার করে দিতে হয়। সে কিছুই করতে পারে না।

অনেক সময় হাত, পিঠ ব্যথা হয়ে যায়, আর পা ফেলতে পারি না কিন্তু কি আর করার সন্তান তো আমার, আর সে আমার ওপর নির্ভর করেই বেঁচে আছে। প্রতিবন্ধী আর পাগল যাই হোক না কেন সন্তান সন্তানই। যতই কষ্ট হোক আমাকে এভাবেই চলতে হবে।

আমার এই প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্য হুইল চেয়ার একবার একজন কিনে দিয়েছিল কিন্তু সেটা নষ্ট হয়ে যাওয়ার কারণে আর ব্যবহার করা হয় না, এছাড়া নতুন করে কিনে দেয়ারও সামর্থ্য নেই আমার। এ কারণেই এভাবেই ঘুরি।

ততক্ষণে প্রতিবন্ধী সন্তান সুমনকে পিঠে নিয়ে লালমনি এক্সপ্রেস ট্রেনে উঠে পড়েছেন সোনা বানু। ট্রেনের গেটের পাশে ফ্লোরেই বসে পড়েছেন সন্তানকে পাশে নিয়ে, কারণ টিকিট সংগ্রহের সময় পাননি তিনি। আর এভাবে ট্রেনের ফ্লোরে বসেই পাড়ি দেবেন গাইবান্ধার নলডাঙ্গা পর্যন্ত। যাবেন গ্রামের বাড়ি।

মায়ের পিঠ থেকে নেমে ট্রেনের ফ্লোরে বসে পড়া সমুনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা, ‘সুমন কোথায় যাবে’? কোন উত্তর নেই, কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শুধু মলিন এক হাসি দিয়ে অন্যদিকে আনমনে তাকিয়ে থাকলো। এরই মধ্যে বেজে উঠলো ট্রেনের সিগনাল।

লালনমনি এক্সপ্রেস ট্রেনটি ৬ নম্বর প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। অন্য সব যাত্রীদের সঙ্গে আছেন একজন মা সোনা বানু, যিনি তার প্রতিবন্ধী সন্তান সুমনকে ২২ বছর ধরে নিজের পিঠে বয়ে বেড়াচ্ছেন।

সন্তানের প্রতি মায়ের এই ভালোবাসা দেখতে তখন প্ল্যাটফর্মে অনেকেই গভীর আগ্রহে তাকিয়ে ছিলেন। ধীরে ধীরে ট্রেন চলছে তবুও সবাই তাকিয়ে তাদের দিকে। এমন দৃশ্য দেখে তারাও আলোচনা করছেন সন্তানের প্রতি মায়ের নিখাদ ভালোবাসা ছাড়া বয়ে বেড়ানো সম্ভব নয়।

যাত্রী জামাল উদ্দিন বলেন, সন্তান শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধী কিন্তু তার মা তাকে পিঠে করে ২২ বছর ধরে টানছেন। এটা সম্ভব শুধু মায়ের বেলাতেই। মা বলেই তিনি এমন করতে পারছেন সন্তানের প্রতি ভালোবাসা থেকে। পৃথিবীর সব সন্তানের প্রতিই তার মায়ের এমন ভালোবাসা থাকে। মনের অজান্তেই এই মায়ের জন্য ব্যাপক ভালোবাসা-শ্রদ্ধাবোধ সৃষ্টি হচ্ছে এখানকার সবার।

Share