পাসপোর্টের সমস্যা নিয়ে আগারগাঁও অফিসে এসেছেন সৌদি প্রবাসী তাহমিনা। তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ। নবায়নের (রিনিউ) জন্য অনলাইনে আবেদন করেছেন। যোগাযোগের তারিখ দেওয়া হয়েছে ২৭ ডিসেম্বর। এদিকে নভেম্বর মাসেই তার ভিসার মেয়াদ শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যে তাকে পাসপোর্ট নবায়ন করে ফিরে যেতে হবে সৌদিআরব। তাই দিশেহারা তিনি।
রাজধানীর আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের সামনে সেবাগ্রহীতাদের এমন দুর্ভোগের চিত্র এখন নিয়মিত। সাধারণ ই-পাসপোর্ট নতুন বা নবায়ন যেটাই করা হোক সময় লাগার কথা ২১ দিন। কিন্তু কারো কারো সেটা লেগে যাচ্ছে তিন থেকে চার মাস। এই দীর্ঘসূত্রতা মূলত শুরু হয়েছে করোনার কারণে। দালালের দৌরাত্ম্যও বেড়েছে। বিশেষ করে যাদের জরুরিভিত্তিতে পাসপোর্ট দরকার তারা রয়েছেন চরম ভোগান্তি আর অনিশ্চয়তায়।
তাহমিনার বাড়ি বরিশাল। গত বছরের মাঝামাঝিতে তার পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়। পাসপোর্ট নবায়ন করতে সঙ্গে এসেছেন তার ভাই ইয়াসিন। তিনি বলেন, আমার বোনের ভিসার মেয়াদ আছে মাত্র তিন মাস। এর মধ্যেই আমাদের পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়িয়ে আবার সৌদি গিয়ে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে হবে। কিন্তু অনলাইনে পাসপোর্টের জন্য আবেদন করলে পরবর্তী তারিখ দেওয়া হয়েছে ২৭ ডিসেম্বর। আমরা তো জানতাম এক মাসের মধ্যে সব হয়ে যাওয়ার কথা। বারবার তাদের কাছে বলেও কোনো লাভ হচ্ছে না। জন্মসনদ আর ভোটার আইডি কার্ডে মায়ের নাম নিয়েও আছে গরমিল। সেটাও কতদিনে ঠিক হবে জানি না।
একই দিনে তাহমিনার মতো সমস্যা নিয়ে আরও বেশ কয়েকজন এসেছেন আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে।
আফজাল নামে এক সৌদি প্রবাসী এসেছেন পাসপোর্ট নবায়ন করতে। তিনি জানান, তার ভিসার মেয়াদ শেষ হবে এবছর ডিসেম্বরে। পাঁচ বছর আগে ট্রাভেল এজেন্সির দালালের মাধ্যমে পাসপোর্ট করিয়েছিলেন। তখন কোনোকিছুই প্রয়োজন পড়েনি। এবার ইন্টারনেটে আবেদন করেছেন নবায়নের জন্য। তাকে কাগজপত্র জমা দেওয়ার তারিখ দেওয়া হয়েছে ২০ ডিসেম্বর। এর মধ্যে তিনি পাসপোর্ট পাবেন কীভাবে আর সৌদি ফিরে যাবেন কবে তা নিয়ে আছেন শঙ্কায়।
যাত্রাবাড়ী পাসপোর্ট অফিস থেকে পাসপোর্ট পেলেও সেখানে সমস্যার সমাধান না করতে পেরে আগারগাঁও এসেছেন এক গ্রাহক। ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে তার নামের গরমিল থাকায় পাসপোর্টের নাম পরিবর্তন করবেন। নয় মাস আগে নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছেন।
ওই ভুক্তভোগী বলেন, আমি পাসপোর্ট করেছি ২০১৪ সালে। তখন ভোটার আইডি ছিল না বলে জন্মনিবন্ধন দিয়ে পাসপোর্ট করেছিলাম। মাঝখানে একবার নবায়নও করেছি। পরে যখন ভোটার আইডি কার্ড পাই, তখন নামের গরমিল দেখা দেয়। নাম পরিবর্তনের জন্য আবেদন করেছি। আমাকে শুধু এই অফিস থেকে ওই অফিস যেতে বলা হচ্ছে। অফিস যেভাবে যা বলেছে সেভাবেই কাগজপত্র তৈরি করে এনেছি। কিন্তু নয় মাসেও আমি নাম পরিবর্তন করতে পারিনি।
এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) মো. রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, এই সমস্যাটা আমাদের আগে ছিল না। করোনা পরবর্তীসময়ে এই সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের যে লোকবল রয়েছে, তাতে একদিনে সর্বোচ্চ দুই হাজার আবেদন গ্রহণ করতে পারি। কিন্তু করোনায় বন্ধ থাকার কারণে খুলে দেওয়ার পর ই-পাসপোর্টে হাজার হাজার আবেদন পড়ছে। আমাদের সক্ষমতার অতিরিক্ত আবেদন পড়ায় ২১ দিনের পাসপোর্ট ডেলিভারি দিতে সময় লেগে যাচ্ছে দুই থেকে তিনগুণ।
যাদের ভিসার মেয়াদ শেষের পথে তারা কীভাবে দ্রুত পাসপোর্ট পেতে পারে- এ প্রশ্নে তিনি বলেন, যাদের ভিসার মেয়াদ শেষের পথে এবং যাদের ইমার্জেন্সি পাসপোর্ট লাগবে, তারা সুনির্দিষ্ট কারণ দেখিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের কাছে আবেদন করতে পারবেন। যদি বিভাগীয় প্রধান প্রমাণসাপেক্ষে মনে করেন তাকে আগে দিতে হবে, সেক্ষেত্রে তার সময় কমিয়ে আনা যেতে পারে। তবে, তাকে সুনির্দিষ্ট কারণ দেখাতে হবে।
এসময় এই চাপ শিগগির কেটে যাবে বলেও জানান তিনি।
অভিযোগ রয়েছে, সাধারণ আবেদনে কাগজপত্র জমা দেওয়ার তারিখ বেশি দূরে হলেও দালালদের মাধ্যমে তা কমিয়ে আনা যায়। তবে এজন্য গুনতে হয় মোটা অঙ্কের টাকা।
মঙ্গলবার (১৪ সেপ্টেম্বর) পাসপোর্ট অফিসের দোতলায় ডেলিভারি কাউন্টারে গিয়ে দেখা যায়, অনেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পাসপোর্ট নিচ্ছেন। যাদের মধ্যে কেউ অনেক সময় নিয়ে পেয়েছেন। আবার কেউ পেয়ে গেছেন দ্রুতই।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে দ্রুত পাসপোর্ট পেয়েছেন এমন এক গ্রাহক বলেন, আমি ই-পাসপোর্টের জন্য আবেদন করি আগস্টের শুরুর দিকে। আমার পাসপোর্ট দ্রুত দরকার ছিল। কিন্তু আমাকে সময় দেওয়া হয় নভেম্বরের প্রথম দিকে। পরে আমার পরিচিত এক ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে একজন দালালের সঙ্গে কথা হয়। তার সঙ্গে বাড়তি পাঁচ হাজার টাকা চুক্তি হয়। তিনি কীভাবে কী করেছেন জানি না। তবে আমি মাসখানেকের মাথায় পাসপোর্ট পেয়ে গেছি।
বিষয়টি নজরে আনলে মো. রুবাইয়াত ফেরদৌস বলেন, দালালদের বিষয়ে আমরা নানান অভিযোগ পাই। কিছু অসাধুচক্র সব সময় সক্রিয় থাকবে। এটা অস্বীকার করছি না। তাদের মাধ্যমে কাজ করতে গিয়ে প্রতারিত হচ্ছে অনেকেই। এর দায়ভার কি পাসপোর্ট অফিস নেবে? দালালদের সঙ্গে পাসপোর্ট অফিসের কোনো সম্পর্ক নেই।
‘অনেকেরই ভিসার মেয়াদ শেষ হচ্ছে, ইমার্জেন্সি কিংবা চিকিৎসার জন্য আবেদন করে দ্রুত পাসপোর্ট নিচ্ছেন। এর বাইরে দুর্নীতির কোনো সুযোগ নেই। এর পরেও কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে যদি এমন অভিযোগ প্রমাণ হয়, তবে অধিদপ্তর কার্যকর পদক্ষেপ সব সময়ই নিচ্ছে।’
যারা আগে পাসপোর্ট নিয়েছেন, কিন্তু পরে ভোটার আইডি কার্ডের সঙ্গে নাম মিলছে না তারা কীভাবে নাম পরিবর্তন করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের এখানে সব সমস্যারই সমাধান আছে। তবে সমাধান পেতে হলে প্রসেসিংয়ের মধ্য দিয়েই আসতে হবে। যদি কেউ তার নাম পরিবর্তন কিংবা যে কোনো কিছু পরিবর্তন করতে চান, তবে তাকে সব ধরনের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস হাজির করে সঠিক পন্থায় আবেদন করতে হবে। করোনা পরবর্তীসময়ে কাজের চাপ বাড়ায় এখন একটু সময় লাগছে ঠিকই, তবে এটা ঠিক হয়ে যাবে।
২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে ই-পাসপোর্ট জগতে প্রবেশ করে বাংলাদেশ। প্রথমদিকে প্রক্রিয়া ঠিক থাকলে সহজেই মিলেছে পাসপোর্ট। করোনার কারণে জট তৈরি হওয়ায় সমস্যা বেড়েছে। শিগগির সব ঠিক হয়ে যাওয়ার আশাবাদ কর্মকর্তাদের তরফে করলেও গ্রাহকের শঙ্কা তাতে কাটছে না।