কম্পিউটারের কোনো পাসওয়ার্ডই অভেদ্য নয়। তা সে যতই জটিল হোক না কেন। যে কেউ যখন তখন আমার, আপনার এই নিরাপত্তার দেওয়াল ভেঙে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়তে পারে। চুরি, ছিনতাই তো সামান্য, বড়ো বড়ো ডাকাতিও হয়ে যেতে পারে। প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙেচুরে দিয়ে কোনো দেশকে ধ্বংসও করে দিতে পারে শত্রুপক্ষের সেনাবাহিনী।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কম্পিউটার প্রযুক্তির যতো উন্নতি হচ্ছে, ততই দুর্বল হয়ে পড়ছে আমার, আপনার অত্যন্ত গোপন পাসওয়ার্ডের নিরাপত্তা। সেই ‘তালা’ খোলার ‘চাবি’র অভাব হচ্ছে না। চাবি বানানোটাও খুব সহজ হয়ে যাচ্ছে।
ভাবছেন, পাসওয়ার্ড বদলে বদলে আগলে রাখবেন আপনার সারা জীবনের সঞ্চয়ের পরিমাণ? স্থাবর, অস্থাবর সম্পত্তির খতিয়ান? ভাবছেন, প্রেমিকার সঙ্গে অত্যন্ত গোপন ই-মেল আলাপচারিতার যাবতীয় খুঁটিনাটি শুধু থেকে যাবে আপনার প্রেমিকা আর আপনার মধ্যে? কারও পক্ষে তা জানা সম্ভব হবে না?
একেবারেই ভুল ভাবছেন। কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড নামে যে সিংহদুয়ারে শক্ত করে খিল তুলে আমরা নিশ্চিন্তে নাক ডেকে ঘুমোই, ‘আমাদের গোপন কথা কেউ জানতে পারবে না’ ভেবে, অত্যাধুনিক কম্পিউটার প্রযুক্তির দৌলতে সেই সিংহদুয়ার আর খিল দু’টোই পলকা হয়ে যাচ্ছে উত্তরোত্তর।
সেই পাসওয়ার্ডের ‘চরিত্র’ সরল, সাদাসিধে বা অত্যন্ত জটিল, যা-ই হোক না কেন। পাসওয়ার্ডের ‘চরিত্র’ ঠিক হয় তার ‘ক্যারেক্টার’ দিয়ে।
পাসওয়ার্ড ও ক্যারেক্টার
নানা ভাবে সেই ‘ক্যারেক্টার’ বানানো হয়। কখনও শুধুই সংখ্যা (‘নাম্বার’) দিয়ে। কখনও শুধুই ছোটো ও বড়ো ইংরেজি বর্ণ (‘অ্যালফাবেটস?’)। তা সে সংখ্যা হোক বা বর্ণ অথবা প্রতীক, কিংবা তাদের মিশেল ঘটানো হোক যে ভাবেই, কম্পিউটার পাসওয়ার্ডের ক্যারেক্টার খুব কম হলে, হতে হয় তিনটি। সর্বাধিক ১৮টি। এরই মধ্যে নানা ধরনের পারম্যুটেশন ও কম্বিনেশনের মাধ্যমে কোটি কোটি পাসওয়ার্ড তৈরি করা যায়।
সংখ্যা দিয়ে বানানো পাসওয়ার্ড ভাঙা সবচেয়ে সহজ
তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গবেষণা ও উপদেষ্টা সংস্থা ‘গার্টনার’-এর দেওয়া পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, দিন দিন কম্পিউটার প্রযুক্তি যেভাবে তরতরিয়ে এগিয়ে চলেছে তাতে শুধু সংখ্যা দিয়ে বানানো পাসওয়ার্ডের তালা খোলাটাই সবচেয়ে সহজ। সেসব পাসওয়ার্ডগুলোর ক্যারেক্টার যদি ৩ থেকে ৮-এর মধ্যে হয়, তা হলে সবে ‘অআকখ’ শেখা ‘হ্যাকার’রাও তা সঙ্গে সঙ্গে খুলে ফেলতে পারবেন। ৯ ক্যারেক্টারের তালা খুলতে লাগবে ৪ সেকেন্ড। ১০, ১১, ১২, ১৩, ১৪, এবং ১৫ ক্যারেক্টারের তালা খুলতে লাগবে যথাক্রমে ৪০ সেকেন্ড, ৬ মিনিট, ১ ঘণ্টা, ১১ ঘণ্টা, ৪ দিন এবং ৪৬ দিন। ১৬ আর ১৭ ক্যারেক্টরের পাসওয়ার্ড ভাঙতে সময় লাগবে যথাক্রমে ১ বছর এবং ১২ বছর। একটু বেশি সময় লাগবে ১৭ ক্যারেক্টরের ক্ষেত্রে। ১২৬ বছর।
‘ইন্ডিয়ান স্কুল অব অ্যান্টি হ্যাকিং’-এর ম্যানেজিং ডিরেক্টর, ‘ন্যাসকম’-এর সদস্য, সাইবার বিশেষজ্ঞ সন্দীপ সেনগুপ্ত এ বিষয়ে জানান, শুধুই সংখ্যা দিয়ে বানানো পাসওয়ার্ডের চেয়ে ছোটো ও বড়ো বর্ণ মিশিয়ে পাসওয়ার্ড বানানো হলে, তাদের নিরাপত্তা কিছুটা বেশি হয়। তবে সে ক্ষেত্রেও পাসওয়ার্ড তিন থেকে পাঁচ ক্যারেক্টারের মধ্যে হলে সঙ্গে সঙ্গেই তা ভেঙে ফেলা সম্ভব।
যেভাবে হ্যাকাররা পাসওয়ার্ড ভাঙে
৬, ৭, ৮, ৯, ১০ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড ভাঙতে খুব বেশি হলে সময় লাগতে পারে যথাক্রমে ৮ সেকেন্ড, ৫ মিনিট, ৩ ঘণ্টা, ৪ দিন এবং ১৬৯ দিন। ১১ ও ১২ ক্যারেক্টারের রহস্য ভেঙে ফেলা যাবে যথাক্রমে ১৬ বছর আর ৬০০ বছরের মধ্যে। ১৩ ক্যারেক্টারের তালা খুলতে লাগবে ২১ হাজার বছর। ১৪, ১৫ এবং ১৬ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড ভাঙতে লাগবে যথাক্রমে ৭ লাখ ৭৮ হাজার বছর, ২ কোটি ৮০ লক্ষ বছর এবং ১০০ কোটি বছর। ১৭ ক্যারেক্টারের তালা ভাঙতে সময় লাগবে এই ব্রহ্মাণ্ডের বয়সের দ্বিগুণেরও বেশি। ৩ হাজার ৬০০ কোটি বছর। আর ১৮ ক্যারেক্টারের জন্য লাগবে ১ লাখ কোটি বছর।
নিরাপদ পাসওয়ার্ড
‘গার্টনার’-এর পরিসংখ্যান এও জানাচ্ছে, সংখ্যা আর ছোটো ও বড়ো বর্ণ মিশিয়ে পাসওয়ার্ড বানানো হলে, সেই দেওয়াল ভাঙতে একটু অসুবিধা হয় হ্যাকারদের। সময়টা একটু বেশি লাগে। কিন্তু সেই ‘দেওয়াল’টাও অভেদ্য নয় মোটেই। ‘তালা’ খুলে ফেলা যায় একটু কায়দা-কসরত করে।
৩ আর ৪ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড ভেঙে ফেলা যায় সঙ্গে সঙ্গেই। ৫, ৬, ৭ এবং ৮ ক্যারেক্টারের রহস্য ভেদ করতে সময় লাগে যথাক্রমে ৩ সেকেন্ড, ৩ মিনিট, ৩ ঘণ্টা এবং ১০ দিন। ৯ ক্যারেক্টারের জন্য লাগে ১৫৩ দিন আর ১০ ক্যারেক্টারের জন্য সময় লাগে ১ বছর। ১১ ক্যারেক্টারের জন্য ১০৬ বছর। তবে ১২, ১৩, ১৪, ১৫, ১৬ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড ভাঙতে সময়টা একটু বেশিই লাগবে। যথাক্রমে ৬ হাজার বছর, ১০ লাখ ৮ হাজার বছর, ২ কোটি ৫০ লাখ বছর, ১০০ কোটি বছর এবং ৯ হাজার ৭০০ কোটি বছর। আর ১৭ এবং ১৮ ক্যারেক্টারের জন্য লাগে যথাক্রমে ৬ লাখ কোটি বছর আর ৩৭৪ লাখ কোটি বছর।
বার্তা কক্ষ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২০