পাঁচ বছরের শিশু মো.শিহাবের বাবা থাকেন খুলনায়। মা আছেন বিদেশে। শিহাব থাকত গ্রামে নানার বাড়িতে। ১ সেপ্টেম্বর দুপুরে নানার বাড়ির উঠানে খেলতে খেলতে সবার অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ডুবে যায় সে। অনেক খোঁজাখুঁজির পর নানার পরিবারের লোকজন ওই পুকুরের পানিতে তার ভাসমান নিস্তেজ দেহ দেখতে পান। সেখান থেকে উদ্ধার করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হলে চিকিৎসক শিহাবকে মৃত ঘোষণা করেন। ঘটনাটি ঘটেছে চাঁদপুরের মতলব দক্ষিণ উপজেলার ডিঙ্গাভাঙা গ্রামে।
শিহাব ওই গ্রামের (ডিঙ্গাভাঙা) সুজন মিয়ার ছেলে। শিহাবের মতো এভাবে প্রায় ৯ মাসে (গত জানুয়ারি থেকে গতকাল ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত) এই উপজেলায় ২৩টি শিশু পুকুর ও খালের পানিতে ডুবে মারা গেছে। প্রতি মাসে গড়ে মারা যায় প্রায় তিনটি শিশু। বাবা-মা অথবা অভিভাবকের অযত্ন ও উদাসীনতায় এত শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি ও সংশ্লিষ্ট পরিবার সূত্র জানায়, গত জানুয়ারি থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় ৯ মাসে উপজেলার ৬ ইউনিয়ন ও ১টি পৌরসভায় বাড়ির পাশের পুকুর ও খালের পানিতে ডুবে মারা গেছে ২৩ শিশু।
এর মধ্যে গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনার পর ১৬ শিশু মারা যায়। বাকি সাতটি শিশু মারা যায় ঘটনাস্থলেই। এই ৯ মাসে মতলব পৌর এলাকায় ৭টি, নায়েরগাঁও উত্তর, নায়েরগাঁও দক্ষিণ, উপাদী উত্তর ও উপাদী দক্ষিণ ইউনিয়নে ৩টি করে এবং নারায়ণপুর ও খাদেরগাঁও ইউনিয়ন ২টি করে মোট ২৩টি শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। জানুয়ারিতে পাঁচটি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চে দুটি করে চারটি, মে-তে দুটি, জুলাইতে ছয়টি, আগস্টে পাঁচটি এবং চলতি মাসে (সেপ্টেম্বরে) একটি শিশু মারা যায়। মারা যাওয়া এসব শিশুর মধ্যে ২২টির বয়স ২ থেকে ৫ বছর। ১টির বয়স ১০ বছর।
উপজেলার মতলব পৌরসভার শিলমন্দি এলাকার বাসিন্দা তাউজুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ জানুয়ারি তাঁর তিন বছরের কন্যাশিশু নুসরাত আক্তার বাড়ির পাশের পুকুরের পানিতে ডুবে মারা গেছে। বিষয়টি তাঁরা খেয়াল করতে পারেননি। ওই সময় তিনি ও তাঁর স্ত্রী পারিবারিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তাঁর মেয়েকে চোখে চোখে রাখলে এই দুর্ঘটনা ঘটত না। তাঁদের অসাবধানতা ও অমনোযোগের জন্যই মেয়েটি মারা গেছে বলে মনে করেন তাঁরা।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) রাজিব কিশোর বণিক বলেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মারা যাওয়ার পর পানিতে ডোবা শিশুদের তাঁর হাসপাতালে আনা হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু ক্ষেত্রে পানিতে ডোবা শিশুদের এমন সময় আনা হয়, তখন চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। পানিতে ডোবা অনেক শিশুকে হাসপাতালে আনাও হয় না। থানা-পুলিশ এড়িয়ে চলতে চায় অনেকের পরিবার। এ জন্য পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুর প্রকৃত পরিসংখ্যান জানা কঠিন।
মতলব দক্ষিণ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) স্বপন কুমার আইচ বলেন, পানিতে ডুবে মারা যাওয়া শিশুর তথ্য পুলিশকে জানাতে চান না অধিকাংশ অভিভাবক। এ জন্য এসব ঘটনায় অস্বাভাবিক মৃত্যু বা ইউডি মামলাও হচ্ছে কম।
মতলব সরকারি কলেজের সমাজকর্ম বিভাগের শিক্ষক হাকিকা আক্তার বলেন, শিশুর প্রতি বাবা-মা বা অভিভাবকের সার্বক্ষণিক মনোযোগ থাকা দরকার। চোখে চোখে রাখতে হয় তাঁদের। বাবা-মা বা অভিভাবকের অযত্ন ও দায়িত্বহীনতায় এত হারে শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যাচ্ছে। এটি অপ্রত্যাশিত।
করেসপন্ডেট,১ অক্টোবর,২০২০