চাঁদপুর টাইমস নিউজ ডেস্ক । আপডেট: ০৩:৩২ অপরাহ্ণ, ২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার
কক্সবাজার জেলার উখিয়া উপজেলার বাসিন্দা মোহাম্মদ জাফর আলম। দুই ছেলে ও এক মেয়ের জনক। একটু সুখের আশায় নিম্নআয়ের জাফর বড় ছেলে আবদুল হামিদকে মালয়েশিয়া পাঠাতে তুলে দিয়েছিলেন দালালের হাতে। কিন্তু দেড় বছর হল ছেলের কোনো খবর জানেন না তিনি। হামিদ জীবিত আছেন নাকি মারা গেছেন সে তথ্যও নেই জাফরের কাছে। জাফরের আশঙ্কা দালালরা তার ছেলেকে হত্যা করে চোখ, কিডনিসহ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি করেছে। আর লাশ পুঁতে রেখেছে জঙ্গলে।
নিজের সন্তান পাচার হওয়ার বর্ণনা দিয়ে জাফর আলম বলেন, ‘দেড় বছর আগে আবদুল্লাহ নামের এক দালাল এসে তার ছেলেকে সুমদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাঠানোর কথা বলে। ভাল বেতন-ভাতা পাওয়ার প্রতিশ্রুতি পেয়ে জাফর তার বড় ছেলেকে মালয়েশিয়াতে পাঠাবে বলে মনস্থির করেন। এ জন্য আদম ব্যবসায়ী আবদুল্লাহকে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে।’
ছেলে বিদেশে কীভাবে গেল সে বিষয়ে জাফর বলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় আবদুল্লাহ এসে ছেলেকে নিয়ে যান। ভাল পোশাক পরিয়ে ছেলেকে বিদায় দেওয়া হয়। সেদিন ছেলে শেষ বিদায় নিয়েছে। আর কোনো যোগাযোগ হয়নি। ফোনও করে নাই। এরপর ছেলের খবর নিতে গেলে আবদুল্লাহ বিভিন্ন কথা বলছে। কিছুদিন আগে আবদুল্লাহ কক্সবাজার থেকে পালিয়ে যান।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে জাফর আলমের এ আশঙ্কার প্রমাণ মিলেছে। জানা গেছে, পাচারকারীরা বাংলাদেশ থেকে মানুষ নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াসহ ইউরোপের সেরা হাসপাতালগুলোতে কিডনি, চোখ, কিংবা পাকস্থলী বিক্রি করছে। হত্যার পর অঙ্গ নেওয়ার আগে পাচারকৃতদের পরিবার থেকে আদায় করছে মুক্তিপণও। পাচারকারীরা বছরে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে বলে ইতোমধ্যে সরকার নিশ্চিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘প্রতিবছর মানবপাচারকারীরা বাংলাদেশীদের কাছ থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা মুক্তিপণ আদায় করছে। এ দেশের মানুষ সহজ-সরল হওয়ায় দেশী-বিদেশী একাধিক পাচারকারী চক্র আদম ব্যবসার ফাঁদ পেতে মুক্তিপণ আদায় করছে। আর বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারের জন্য থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় ৩০টি শক্তিশালী চক্র রয়েছে। তারা চারটি ধাপে ৬টি রুট দিয়ে মানবপাচার করে আসছে।
গত সপ্তাহে মানবপাচার সংক্রান্ত এই প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এ সব বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে জানাতে বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে মানবপাচার করে তাদের অঙ্গ বিক্রির কৌশল হিসেবে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পাচারকৃতদের নৌকা অথবা জাহাজ থেকে নামানোর পর প্রথমেই তাদের রক্ত পরীক্ষা করা হয়। যাদের রক্ত ম্যাচ হয় চাহিদা অনুসারে তাদের কিডনি, লিভার, চোখসহ প্রতিস্থাপনযোগ্য বিভিন্ন অঙ্গ বিক্রি করে দেওয়া হয়।’ সম্প্রতি থাইল্যান্ডের শংখলা প্রদেশের গণকবরগুলোতে পাওয়া মৃতদেহের ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন হাতে পাওয়ার পর এ বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট দফতর নিশ্চিত হয়েছে।
থাইল্যান্ড ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপের সেরা হাসপাতালগুলোতে প্রতিস্থাপনের জন্য বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের অঙ্গ পৌঁছে দেওয়া হয়। বিশ্বের মধ্যে ইরানে মানবদেহ বিক্রির বৈধতা দেওয়া আছে। ফলে সেখানেও পাচারকারীরা সুস্থ অঙ্গের মানুষদের পাঠায়। এ ছাড়াও জাপান, ইতালী, ইসরাইল, কানাডা, তাইওয়ান, আমেরিকা এবং সৌদি আরবে স্বাস্থ্যকর অঙ্গ বিক্রি করা হয়ে থাকে।’
মানবপাচারের বিভিন্ন ধাপের বর্ণনা তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চারটি ধাপে লোক সংগ্রহ করে মূলত ৬টি রুটে মানবপাচার হয়েছে থাকে। প্রথম ধাপে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে সামান্য টাকার বিনিময়ে নিরীহ ও অশিক্ষিত বেকার যুবকদের উন্নত জীবনের প্রত্যাশা, বেকারত্ব থেকে মুক্তি এবং ভাল কাজের প্রলোভন দেখিয়ে লোকজন সংগ্রহ করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে লোকজন সংগ্রহ করে সীমান্ত এলাকা, বিশেষ করে কক্সবাজারের স্থানীয় দালালদের কাছে ১০-১৫ হাজার টাকায় বিক্রি করা হয়।
তৃতীয় ধাপে সংগৃহীত লোকজনদের কক্সবাজার উপকূলবর্তী এলাকার পাচারকারীদের ঘাঁটিতে রাখা হয়। পরে ৩০-৩৫ হাজার টাকা দরে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের ট্রলারে বিক্রি করা হয়।
শেষ ধাপে পাচারকৃতরা চলে যান আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের হাতে। তারা এ সব ব্যক্তিদের ট্রলারে করে নিয়ে যান থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার জঙ্গলে। সেখানের আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের কাছে পাচারকৃতদের ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দেওয়া হয়। ২০১৪ সালে মালয়েশিয়া ও থাইল্যান্ডে নারী শিশুসহ ৫০ হাজার মানবপাচার হয়েছে। ২০১৫ সালের প্রথম তিন মাসে ২৫ হাজার বাংলাদেশী ও রোহিঙ্গা পাচার হয়েছে।’
পাচারকারীদের রুটের বর্ণনায় বলা হয়েছে, ‘দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকার ৬টি রুটে মানবপাচার হয়ে থাকে। লঞ্চযোগে ঢাকা থেকে বরিশাল এবং ঢাকা হতে সড়কপথে যশোর এবং সাতক্ষীরা। আবার বরিশাল থেকে যশোর হয়ে বেনাপোল। ঢাকার গাবতলী থেকে আরিচা হয়ে সরাসরি যশোর হয়ে সাতক্ষীরা, ঢাকা হতে দিনাজপুর, লালমনিরহাট, দর্শনা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে মানবপাচার রুট ব্যবহার হয়। এর বাইরে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ, রামু, উখিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়াসহ সদর থানার বিভিন্ন এলাকা পাচারকারীরা ব্যবহার করে থাকে। কক্সবাজার এলাকার সমুদ্র সৈকতের ইনানীসহ ১৪টি পয়েন্ট থেকে ট্রলারযোগে মানবপাচার হয়েছে থাকে। কক্সবাজার থেকে মূলত সমুদ্রপথে থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া হয়ে মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে মানবপাচার হয়ে থাকে। এ ছাড়া যশোর, সাতক্ষীরা, বেনাপোলসহ ভারত সীমান্ত এলাকা দিয়ে মানবপাচার করে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে পাকিস্তানকে ব্যবহার করা হয়। সেখান থেকে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে মানবপাচার হয়ে থাকে।’
মানবপাচারে দেশী-বিদেশী বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর তথ্য সম্বলিত ১৩ পৃষ্ঠার ওই গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্য অনুসারে, মিয়ানমারের দালালদের সঙ্গে যোগসাজশে থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াভিত্তিক মানবপাচার শুরু হয়। বর্তমানে ৩০টি উপ-প্রধান ও ৩টি প্রধান মাফিয়া চক্রের মাধ্যমে আদম ব্যবসা চলছে। এক পর্যায়ে তারাই মানবপাচার ও বিদেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে মুক্তিপণ আদায় শুরু করে। বিশ্বব্যাপী মানবপাচারের অর্থনীতি প্রতিবছর প্রায় ১২ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। আর প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে মানবপাচারকারীরা মুক্তিপণ আদায় করছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
বিভিন্ন দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবপাচারের প্রধান ভূমিকায় থাকার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘থাইল্যান্ডের জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে পুলিশ, মিলিটারিসহ ইমিগ্রেশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সরাসরি জড়িত রয়েছে। আর বাংলাদেশের পুলিশ, বিজিবি ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা পাচারকারীদের সহায়তা করছে।’
মানবপাচার বন্ধ না হওয়ার কারণে হিসেবে বলা হয়, ‘সমুদ্রপথে মানবপাচারে বাংলাদেশ, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার অনেকেই জড়িত। কিছু পাচারকারীর নাম আসলেও মূল হোতারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এ ছাড়াও বিভিন্ন সময় মালয়েশিয়াগামী যাত্রীদের আটক বা উদ্ধার করার পর তাদের ভিকটিম হিসেবে ছেড়ে দেওয়ার কারণে মানবপাচার বাড়ছে।’
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, গোয়েন্দা সংস্থা থেকে পাচার হওয়া ব্যক্তিদের সম্পর্কে কোনো তথ্য জানানো হলে কোস্টগার্ড, পুলিশ, বিজিবির সদস্যরা সেসব তথ্য পাচারকারীদের কাছে পাচার করে দেয়। এ সব সংস্থার কিছু সদস্য পাচারকারীদের কাছ থেকে যাত্রী প্রতি ৩০০ থেকে এক হাজার টাকা উৎকোচ আদায় করে আসছে। এমনকি বিজিবি কিংবা পুলিশ অভিযানে গেলে পাচারকারীদের কাছে অগ্রিম তথ্য চলে যাচ্ছে। ফলে পাচারকারীরা যাত্রীদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারছে। একই সঙ্গে মামলা বহির্ভূত পাচারকারীদের আটক করে থানায় এনে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১২ সাল থেকে ২০১৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শুধু কক্সবাজার জেলায় ৩০৬টি মামলা দায়ের করা হয়। এর মধ্যে মাত্র ৫৯টি মামলা চলমান রয়েছে। বাকি মামলাগুলোর কার্যক্রম ঝুলন্ত অবস্থায় রয়েছে।
কক্সবাজার জেলার পুলিশ সুপার (এসপি) শ্যামল কুমার নাথ বলেন, কক্সবাজার এলাকায় মানবপাচার বন্ধ রয়েছে। মানবপাচার বন্ধে সরকারের নেওয়া উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫
চাঁদপুর টাইমস ডট কম–এ প্রকাশিত/প্রচারিত সংবাদ, আলোকচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও বিনা অনুমতিতে ব্যবহার করা বেআইনি
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur