চ্যালেঞ্জের মুখে পলিথিন নির্মূল

চ্যালেঞ্জে পড়েছে সরকারের পলিথিন নির্মূলের উদ্যোগ। ১ নভেম্বর থেকে হাটবাজার সর্বত্র সর্বনাশা পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ ঘোষণা করা হলেও বদলায়নি চিত্র। সরবরাহ কমেনি পলিথিন ব্যাগের। বন্ধ হয়নি নিষিদ্ধ পণ্যটির পাইকারি দোকান ও কারখানা। বাড়েনি দামও। অলিগলিতে ছোট্ট কক্ষের মধ্যে মেশিন বসিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ। ফলে নভেম্বরের ১৫ দিন পার হলেও এখনো মুদি দোকানে, সবজি বাজারে জোর করে ধরিয়ে দিচ্ছে একাধিক পলিথিন। আবার পলিথিন উৎপাদন কারখানায় অভিযানে গিয়ে কোথাও কোথাও মালিক-শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়তে হচ্ছে ভ্রাম্যমাণ আদালতকে।

গত বুধবার রাজধানীর পুরান ঢাকার কামালবাগ এলাকায় পলিথিন কারখানার বিরুদ্ধে অভিযানে গিয়ে বাধার মুখে পড়েন ভ্রাম্যমাণ আদালত। একটি পলিথিন কারখানা সিলগালা করলে মালিক-শ্রমিকপক্ষের লোকজন জড়ো হয়ে ঘিরে ধরে প্রতিবাদ জানায়। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হলে নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। ফলে দিনভর অভিযান পরিচালনার কথা থাকলেও স্থানীয় শ্রমিকদের তোপের মুখে অভিযানের ইতি টেনে ঘটনাস্থল ত্যাগ করেন পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব বেগম রুবিনা ফেরদৌসী।

২০০২ সালের ১ মার্চ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য হুমকি পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে তৎকালীন বিএনপি সরকার। তবে এ ক্ষেত্রে সফলতা দেখাতে পারেনি কোনো সরকার। উল্টো ২২ বছরে বেড়েছে এর উৎপাদন ও ব্যবহার।

আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পরিবেশবিদ সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ,বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পরই পলিথিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। আইনে আগে থেকে নিষিদ্ধ থাকলেও নতুন করে ১ অক্টোবর থেকে সুপারশপে ও ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন,বিপণন,পরিবহন,ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন।

১ নভেম্বর থেকে বাজারের পাশাপাশি কারখানার বিরুদ্ধেও অভিযান শুরু হয়েছে। কিছু কারখানা সিলগালা ও অনেককে জরিমানাও করা হয়েছে। তবে পলিথিন উৎপাদনকারী কারখানার তুলনায় তা নগণ্য। সরেজমিন দেখা গেছে, সুপারশপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ হলেও বাজারের চিত্র আগের মতোই রয়েছে। বিভিন্ন সুপারশপে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে দেয়া হচ্ছে কাগজের ঠোঙা।

পণ্য বেশি হয়ে গেলে রয়েছে চটের ব্যাগ ও কাপড়ের ব্যাগ,যা ২৫-৩০ টাকায় কিনে নিতে হচ্ছে। কিছু গ্রাহক ব্যাগ কিনতে নারাজ হলেও অধিকাংশ মানুষই বিষয়টাকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। অনেকে গাড়িতে ও বাইকে কাপড়ের ব্যাগ রাখছেন। তবে বাজারগুলোতে পলিথিনের ব্যবহারে কোনো পরিবর্তন দেখা যায়নি। পলিথিন ব্যাগ কোথায় পাওয়া যাবে এমন প্রশ্নে খিলক্ষেতের ডুমনি এলাকার এক সবজি বিক্রেতা বলেন, তারা ইছাপুরা বাজার থেকে কেজি দরে কিনে আনেন। তার বক্তব্যের সূত্র ধরে ইছাপুরা বাজারে গিয়ে প্রতিটি বড় মুদি দোকানে পাইকারি দরে পলিথিন বিক্রি করতে দেখা গেছে।

তারা পলিথিনের উৎস জানাতে রাজি না হলেও এক কর্মচারীর কাছ থেকে জানা যায়, ফোনে অর্ডার করলে চকবাজার থেকে পিকআপ ভরে পলিথিন পাঠিয়ে দেয়। কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, সব দোকানেই নিষিদ্ধ পলিথিন। প্রকাশ্যেই হচ্ছে এর বেচাকেনা ও ব্যবহার। নাজমা আক্তার নামের এক ক্রেতা বলেন, শুকনো বাজার কাপড়ের ব্যাগে নেওয়া যায়। পলিথিন ছাড়া মাছ কীভাবে নেব? বিকল্প হিসেবে বহুবার ব্যবহারযোগ্য মোটা প্লাস্টিকের ব্যাগ বের করার পরামর্শ দেন তিনি।

পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন আন্দোলনের সভাপতি এবং পরিবেশ অধিদপ্তরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মো.আবদুস সোবহান বলেন,‘ পলিথিন জরুরি ভিত্তিতে বন্ধ হওয়া দরকার। আগে শুধু মনে করা হতো পলিথিন কৃষিজমি নষ্ট করে, ড্রেনেজ ব্যবস্থা বন্ধ করে দেয়। তবে সবচেয়ে ভয়ংকর বিষয় হলো,পলিথিন পানিতে যাওয়ার পর গুঁড়ো হয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হচ্ছে। এটা মাছ থেকে মানুষের শরীরে ঢুকছে,যা ক্যানসার থেকে শুরু করে নানা প্রাণঘাতী রোগ সৃষ্টি করছে। তবে দু দশকের বেশি সময় পরে পলিথিন বন্ধে একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এটার বিরুদ্ধে আটঘাট বেঁধে নামা দরকার ছিল। এবার ব্যর্থ হলে আর এটাকে বন্ধ করা সম্ভব হবে না। তাই আগেই পলিথিনের বিকল্প বাজারে আনা প্রয়োজন ছিল।’

তিনি বলেন, ২০০২ সালে পলিথিন বন্ধে আইনটি প্রণয়ন করার পরপরই বাজারে পলিথিনের প্রচুর বিকল্প আসে। নিউমার্কেট,কারওয়ান বাজার সবখানেই এগুলো পাইকারি পাওয়া যেত। ফলে দু-তিন বছরের মধ্যে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কমে যায়। তখন বন ও পরিবেশমন্ত্রী ছিলেন শাজাহান সিরাজ। পরবর্তী সময়ে যখন তরিকুল ইসলাম এলেন,তখন থেকে ফের পলিথিন বাড়া শুরু হয়। এরপর থেকে বেড়েই গেছে।

বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫-এর ভিত্তিতে ২০০২ সালে পলিথিনের তৈরি ব্যাগের ব্যবহার, উৎপাদন, বিপণন ও পরিবহন নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়,যদি কোনো ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন করে তাহলে ১০ বছরের কারাদন্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দন্ডও হতে পারে। পলিথিন বাজারজাত করা হলে ছয় মাসের জেল ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা। কিন্তু বাস্তবে আইনের সর্বোচ্চ ব্যবহারের নজির এখন পর্যন্ত দেখা যায়নি।

শামীম আহমেদ ,
বিশিষ্ঠ লেখক ও সাংবাদিক
১৬ নভেম্বর ২০২৪
এজি

Share