অবকাশযাপনে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে বেড়াতে এসেছিলেন হাবিবুর রহমান। সন্ধ্যায় উপভোগ করছিলেন সমুদ্রের সৌন্দর্য। ৯ বছর বয়সী এক ছোট্ট শিশু পাশে দাঁড়াল, আলতো হাতে টিপে দিতে লাগল মাথা। ক্লান্ত শরীরে আরামবোধ করায় আর বাধা দেননি হাবিবুর। একসময় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ঘুম ভাঙলে দেখেন মুঠোফোন আর ব্যাগ নেই। সেই শিশুটিও উধাও।
কক্সবাজারের লাবণি, সুগন্ধা ও কলাতলী পয়েন্টে মাঝেমধ্যে এমন ঘটনা ঘটছে বলে জানিয়েছেন কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মহিউদ্দিন। তিনি বলেন, অপরাধী চক্র শিশুদের ব্যবহার করে পর্যটকদের সঙ্গে এমন প্রতারণা করছে। পর্যটকেরা একটু সচেতন হলেই এমন ঘটনা এড়ানো সম্ভব।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের তথ্যমতে, করোনার পরবর্তী সময়ে পর্যটন এলাকাগুলোয় দেশীয় পর্যটকের সংখ্যা দ্বিগুণ বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে অপরাধপ্রবণতাও। তবে দেশের সমুদ্রসৈকত ও সীমান্তবর্তী দর্শনীয় স্থানগুলোয় তুলনামূলক বেশি অপরাধ সংঘটিত হয় বলে মনে করেন পর্যটন বিশেষজ্ঞরা।
পর্যটন এলাকায় পর্যটকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে ট্যুরিস্ট পুলিশ। পুলিশের এই বিশেষায়িত ইউনিটটি বলছে, ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রম চালু হওয়ার পর দর্শনীয় স্থানগুলোয় অপরাধপ্রবণতা অনেক কমেছে। ২০১৬ সালে পর্যটন এলাকায় বিভিন্ন অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছে ৮৫ জন। হারিয়ে যাওয়া শিশু উদ্ধার করা হয়েছে ১৯ জন। মাদকও উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার হয়েছে ৮৩ জন। শিশু উদ্ধার হয়েছে ৪৪ জন। উদ্ধার হয়েছে ২০ কোটি টাকা মূল্যের ৫ লাখ ইয়াবা। ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩৬ জনকে। শিশু উদ্ধার করা হয়েছে ৫১ জন। ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হয়েছে ২৩ জন। শিশু উদ্ধার হয়েছে ৭২ জন। বেওয়ারিশ মরদেহ পাওয়া গেছে ৭টি। ২০২০ সালে গ্রেপ্তার হয়েছে ৩০ জন। ৪৮টি হারিয়ে যাওয়া শিশু উদ্ধার করে অভিভাবকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। মরদেহ পাওয়া গেছে ৩টি।
সারা দেশের তুলনায় কক্সবাজার পর্যটন এলাকায় অপরাধপ্রবণতা কিছুটা বেশি। কক্সবাজার ট্যুরিস্ট পুলিশের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে শুধু কক্সবাজারে হারিয়ে যাওয়া ৬৩টি শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ট্যুরিস্ট পুলিশের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পর্যটন এলাকায় নথিভুক্ত ঘটনার চেয়ে প্রকৃত ঘটনা আরও অনেক বেশি। কক্সবাজার, কুয়াকাটা ও জাফলং পর্যটন এলাকায় ট্যুরিস্ট পুলিশের কাছে দর্শনার্থীরা সাধারণত যেসব অভিযোগ জানান, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে নারীদের উত্ত্যক্ত করা, লুকিয়ে ভিডিও ও ছবি তোলা, বিশ্রাম নেওয়ার সময় পর্যটকদের শরীর মালিশ করে টাকা ও মালামাল হাতিয়ে নেওয়া, খাবারের উচ্চমূল্য। ফটোগ্রাফারদের বাড়তি টাকা দাবি, অনলাইনে বুকিং দেওয়া রুমের সঙ্গে বাস্তবে মিল না থাকা, হোটেল চেক আউটের নিয়ম নিয়েও অভিযোগ রয়েছে পর্যটকদের।
ট্যুরিস্ট পুলিশ কক্সবাজার অঞ্চলের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘ট্যুরিস্ট পুলিশের কার্যক্রমের আগে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে সন্ধ্যার পর লোক থাকত না। এটা ছিনতাইকারীদের স্বর্গরাজ্য ছিল। এখন সারা রাত পর্যটকেরা সৈকতে নিরাপদ বোধ করেন। অপরাধের হার অনেক কমে এসেছে। ২৪ ঘণ্টা সৈকতে আমাদের লোক ডিউটি করে। কেউ সমস্যায় পড়ে কল দিলে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে আমাদের সময় লাগে তিন থেকে পাঁচ মিনিট।’
ট্যুরিস্ট পুলিশের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া শাখার পুলিশ সুপার মো. ইব্রাহিম খলিল বলেন, ‘পর্যটকদের ভ্রমণ নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে দেশের গুরুত্বপূর্ণ ১০৪টি পর্যটন স্পটে ট্যুরিস্ট পুলিশ দায়িত্ব পালন করছে। বর্তমানে পর্যটন এলাকায় সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিদের তালিকাভুক্ত করে তাদের নির্দিষ্ট নম্বরযুক্ত টি-শার্ট প্রদান করায় অপরাধও অনেক কমে এসেছে।’
বাংলাদেশ ট্যুরিজম ফাউন্ডেশনের সভাপতি মোখলেছুর রহমান বলেন, ট্যুরিজমকে কেন্দ্র করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অপরাধ হয়ে থাকে। পর্যটকদের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। এর জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশকে আরও সক্রিয় হতে হবে।
বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাবেদ আহমেদ বলেন, ‘বেশ কিছু পর্যটন এলাকায় অপরাধপ্রবণতা বেড়েছে। বিশেষ করে সমুদ্রসৈকতগুলোয় এমন প্রবণতা রয়েছে। তবে এটা পর্যটনে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করবে বলে মনে করি না। প্রতারণামূলক অপরাধ এড়াতে মানুষকে সচেতন হতে হবে। ট্যুরিস্ট পুলিশের সক্ষমতাও আরও বাড়াতে হবে।’