পরিবেশ দিবসে প্রাসঙ্গিক ভাবনা

“অন্ধ ভূমিগর্ভ হতে শুনেছিলে সূর্যের আহ্বান প্রাণের প্রথম জাগরণে/ তুমি বৃক্ষ, আদিপ্রাণ;/ উর্ধ্বশীর্ষে উচ্চারিলে আলোকের প্রথম বন্দনা/ ছন্দোহীন পাষাণের বক্ষ-’পরে;/ আনিলে বেদনা নিঃসাড় নিষ্ঠুর মরুস্থলে।”

বিশ্ব পরিবেশ দিবসে কবিতার এ লাইনগুলো খুবই প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় বৃক্ষের ভূমিকা অনন্য। আমাদের পরিবেশ ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখীন। এ বিপর্যয় প্রাণী বসবাসের একমাত্র উপযোগী ‘পৃথিবী’ নামক গ্রহটির অস্তিত্বকেই হুমকীর সম্মুখীন করছে।

যদি আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশের কথা বলি, তবে এ তথ্যটি সামনে চলে আসে এষড়নধষ ঈষরসধঃব জরংশ ওহফবী এর প্রতিবেদন অনুসারে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে যেসব দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তাতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭ম;পরিবেশ দূষণে অবস্থান ২য়।

এ বিপর্যয়মূলক পরিস্থিতির একটি অন্যতম কারণ পর্যাপ্ত বৃক্ষরোপণ না হওয়া-বৃক্ষ কেটে ফেলা। কিন্তু আমরা বিষয়টি বুঝতে ব্যর্থ হই। একটি দেশে বনভূমি থাকা প্রয়োজন ২৫%। বাংলাদেশে আছে খাতা-কলমে ১৭%, বাস্তবে যার অস্তিত্ব কোনভাবেই ৭-৮% এর বেশি নয়।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “সৃষ্টির প্রথম পর্বে পৃথিবী ছিলো পাষাণী,বন্ধ্যা। জীবনের প্রতি তার করুণার কোন লক্ষণ সেদিন প্রকাশ পায়নি। চারদিকে অগ্ন্যিদগীরণ চলছিল, পৃথিবী ছিল ভূমিকম্পে প্রকম্পিত। এমন সময়ে কোন সুযোগে বনলক্ষ্মী তাঁর দূতীগুলিকে প্রেরণ করলেন পৃথিবীর এই অঙ্গনে।

চারিদিকে তার তৃণশষ্পের অঞ্চল বিস্তীর্ণ হল,নগ্ন পৃথিবীর লজ্জা রক্ষা হল। ক্রমে ক্রমে এল তরুলতা প্রাণের আতিথ্য বহন করে। তখনো জীবের আগমন হয়নি; তরুলতা জীবের আতিথ্যের আয়োজনে প্রবৃত্ত হয়ে তার ক্ষুধার জন্য এনেছিল অন্ন, বাসের জন্য দিয়েছিল ছায়া।” এই ধরণীকে রক্ষায় বৃক্ষরোপণের কোন বিকল্প নেই।

কিন্তু শুধুমাত্র বৃক্ষরোপণ করলেই আর না কাটলেই পরিবেশকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। কারণ বৃক্ষের যে কাজ তার জন্য তো তাকে পরিবেশ দিতে হবে। সেই পরিবেশ এখানে নিশ্চিত হচ্ছেনা। বায়ু দূষণের মাধ্যমে বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনচক্র রক্ষা পাচ্ছেনা।

সালফার ডাই অক্সাইড,নাইট্রোজেন অক্সাইড,হাইড্রোজেন সালফাইড,ক্লোরিন ইত্যাদি বায়ূ দূষক উপাদান বৃক্ষের স্বাভাবিক জীবনকে মারাত্বকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। সালফার অক্সাইড, হাইড্রোজেন ফ্লুরাইডের প্রভাবে বৃক্ষের স্বাভাবিক সালোকসংশ্লেষন বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে অক্সিজেন কমে কার্বন ডাই অক্সাইড বেড়ে যায়। এর নেতিবাচক প্রভাব পৃথিবীর সকল প্রাণীকূলের উপর পড়ে। এ সমস্ত বায়ু দূষক বৃক্ষের স্বাভাবিক বৃদ্ধিসহ সকল বিষয়কে বাধাগ্রস্ত করে। উদ্ভিদের আয়ু কমিয়ে দেয়।

বাংলদেশের বায়ুমন্ডলে ক্ষতিকর এ বায়ূ দূষকের উপস্থিতি ভয়াবহ পর্যায়ে। বায়ুর খারাপ মানের জন্য জনস্বাস্থ্যও বিপর্যয়ের সম্মুখীন।

সুইজারল্যান্ডের দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের সমীক্ষায় দেখা গেছে, বায়ু দূষণে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মতো এবারও ১ম এবং ঢাকা রাজধানী শহরগুলির মধ্যে ২য়। যেখানে ডবিøওএইচও এর বায়ুমান নির্দেশক গাইডলাইন অনুসারে পিএম ২.৫ নামে পরিচিত ছোট ও বিপজ্জনক বায়ু বাহিত কনার গড় বার্ষিক ঘনত্ব প্রতি ঘনমিটারে ৫ মাইক্রোগ্রামের বেশি হওয়া উচিত নয়। সেখানে বাংলাদেশে এর পরিমাণ ৭৬.৯ মাইক্রোগ্রাম।

বায়ু দূষণের কারণগুলি কী? এর মধ্যে রয়েছে ইটভাটা, রাস্তাঘাট ও বাড়ি নির্মাণের সময় সৃষ্ট ধুলোবালি, যানবহনের দূষণ। এ সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশে বায়ু দূষণ প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের এখন যে সমস্ত অসুখ হচ্ছে এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হারে শ্বাসনালীর অসুখ বেশি দেখা যাচ্ছে। যা সৃষ্টির প্রধান কারণ বায়ু দূষণ।

আজকে দেশে পরিবেশের যে বিপর্যয় এর অন্যতম আরো একটি কারণ শব্দ দূষণ। যখনই শব্দ ক্ষতিকর এবং বিরক্তিকর হয় তখনই সেটা হয় শব্দ দূষণ। আমরা ২০ ডেসিবেল থেকে ১২০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ শুনতে পাই।

২০ ডেসিবেল নিচে এবং ১২০ ডেসিবেল উপরে আমরা শব্দ শুনতে পাইনা। মানুষের স্বাভাবিক শ্রবণমাত্রা ৬০-৭০ ডেসিবেল মাত্রার শব্দ। অর্থাৎ ৭৫ ডেসিবেলের উচ্চমাত্রার শব্দই শব্দ দূষণ। এখানে আমাদের চারপাশে হরহামেশাই ৭৫ ডেসিবেলের বেশি শব্দ হচ্ছে।

এ শব্দ দূষণ শুধুমাত্র মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি করছেনা, অন্য সকল পশু-পাখি-গাছ-পালা সবার জন্য ক্ষতি করছে। শব্দ দূষণের কারণে এখন গাছগুলিতে পাখি আর তেমনভাবে বসেনা। অর্থাৎ জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব তৈরি করছে। আধুনিকতা আর উন্নয়নের নামে যে যথেচ্ছার চলছে এটা বন্ধ করা আশু প্রয়োজন। যানবাহনের অতিরিক্ত হর্ণের ব্যববহার, কলকারখানার উচ্চ শব্দ, উচ্চ শব্দযুক্ত গান বাজনা, বিশেষকরে আবাসিক এলাকায় বন্ধ করা আবশ্যক।

এসব ছাড়াও পানি দূষণ, নদ-নদী সংরক্ষণ করতে না পারা, মাটির দূষণ সবকিছু মিলিয়ে আমাদের ইকোসিস্টেম ভেঙে পড়ছে। আমরা উন্নয়নের মহাসড়কে দৌড়ে বেড়াচ্ছি! কিন্তু এর জন্য আমাদের কতেটা ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে এর মূল্যায়ন করছিনা।

বাংলাদেশে পরিবেশ বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০২১), জাতীয় পরিবেশ নীতি (২০১৮), বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন (২০১৭), পরিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা (২০১৬), পরিবেশ আদালত আইন (২০১০), শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা (২০০৬) এধরণের এতোসকল আইন-বিধি আর নীতিমালার পরেও পরিবেশ বিপর্যয় কোনভাবেই রোধ করা সম্ভব হচ্ছেনা। কারণ, শাসকগোষ্ঠী যখন আইনের তোয়াক্কা করে তখন সাধারণকে সেই আইন মানানো কোনভাবেই সম্ভব হয়না।

আজকের পরিবেশ দিবসে আমাদের জাতীয় জীবনের মর্মান্তিক ট্রাজেডি চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড আর বিস্ফোরণে ইতিমধ্যে ৩৮ জনের (লেখাটি প্রস্তুতকালীন সময় পর্যন্ত) প্রাণহানী ঘটেছে।

হতাহত শতাধিক এর উপরে। ইতিমধ্যে জানাগেছে ডিপোটির মালিক সরকার দলীয় এবং এ ধরণের ডিপো প্রকৃতঅর্থে আবাসিক এলাকার পাশে স্থাপনের কোন সুযোগ নেই উপরিল্লিখত আইন ও বিধিমালা অনুসারে। অর্থাৎ এই আইন-বিধিমালাকে অস্বীকার করেই ডিপোটি স্থাপন করা হয়েছিলো।

পরিবেশ সমীক্ষাকে পাশ কাটিয়ে রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র,রুপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ মেগা প্রজেক্টগুলি করা হচ্ছে। কীভাবে বাংলাদেশ পরিবেশ বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাবে? এখানকার ‘বিপর্যয়’কে অনেকটাই আমরা আমন্ত্রণ করে আনছি!

সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত ‘গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুসারে, শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে ২০১৯ সালে সারা পৃথিবীতে মৃত্যুবরণ করেছে ৯০ লাখ মানুষ। যার মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যু হয়েছে ২ লাখের বেশি। দূষণে মৃত্যুর হিসাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৬ষ্ঠ।

চেঞ্জ ইনিসিয়েটিভের এক গবেষণায় দেখা গেছে, পরিবেশদূষণজনিত অসুস্থতায় বাংলাদেশে প্রতিবছর খরচ হয় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা। এ দূষণে প্রতি পরিবারের বছরে গড়ে চিকিৎসাবাবদ ব্যয় হয় ১০ হাজার ৫৮৭ কোটি টাকা। বাংলাদেশে অসংক্রামক রোগের একটি অন্যতম কারণ এই পরিবেশ দূষণ।

আমাদেরকে সামগ্রীকভাবে ভাবতে হবে। উন্নয়ন আমরা করবো, করতে চাই কিন্তু উন্নয়নের মাধ্যমে অর্জন আর বিষর্জনের তুলনামূলক আলোচনায় নজর দিতে হবে।

গত ২৫ বছরে ৬৫ হাজার হেক্টর বনভূমি নেই হয়ে গেছে,স্বাধীনতার পর থেকে ৩০ লাখ হেক্টর কৃষিজমি কমেছে! ঢাকার এক-চতুর্থাংশ শিশুর ফুসফুসের সক্ষমতা কমেছে।

বিশ্ব ব্যংকের সমীক্ষা অনুসারে, ঢাকায় সীসা দূষণের স্বীকার ৬ লাখ মানুষ। ১ কোটি ২৭ লাখ মানুষের শরীরে অস্বাভাবিক কোষের বৃদ্ধি ঘটেছে।

আগামি প্রজন্ম কাউকেই রক্ষা করতে পারবোনা পরিবেশ বিপর্যয়ের হাত থেকে। আমাদেরকে প্রশ্ন তুলতে হবে এ দূর্বৃত্তায়িত ভূমিকার বিরুদ্ধে। একটি সুস্থ পরিবেশ পাওয়া আমার সাংবিধানিক অধিকার। এ অধিকার যখন সাধারণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়না তখন পরিবর্র্তীত পরিস্থিতিতে আন্দোলনের বিকল্প কিছু থাকে না।

আবু নাসের অনীক, উন্নয়ন কর্মী,
৫ জুন ২০২২
এজি

Share