হজ্জের জাহেলি রসম রেওয়াজে যেসব সংস্কার আনা হল :
১) সর্ব প্রথম কাবা ঘরের মুর্তিগুলো ভেঙ্গে ফেলা হল। আল্লাহ ছাড়া গায়রুল্লাহর যে পুজা সেখানে হত, সব বন্ধ করে দেওয়া হল। মেলা বসিয়ে উৎসব হাসি তামাশার যে ব্যাপকতা ছিল তা নিষেধ করা হল। এর ফলে আল্লাহর শেখানো ইবাদাত বন্দেগী অর্থাৎ নামাজ, তাসবিহ, জিকির এর মাধ্যমে তাওয়াফ ছায়ী, উকুফ ও কুরবাণী নির্দিষ্ট করা হল।
২) হজ্জের সময় সকল অন্যায় ও বাজে কর্মতৎপরতা যৌনচার, অশ্লীলতা অন্যায় আচরণ খোদাদ্রোহীতা, যুদ্ধ বিবাদ ঝগড়া ফাসাদ নিষিদ্ধ হল।
৩) কুরবানীর পশুর রক্ত কাবার দেয়ালে লেপে দেয়া এবং গোশত কাবার দরজায় ফেলে রাখার কুপ্রথা বন্ধ করে দেওয়া হল।
৪) উলংগ হয়ে কাবার চারপাশে তাওয়াফ কর নিষেধ করা হল।
৫) পথের সামান সঙ্গে না নিয়ে খালি হাতে হজ্জের লম্বা সফরে বের হওয়া কোন বুজুর্গির আলামত নয়। তাই এরূপ করতে নিষেধ করে দেয়া হল।
৬) অভিজাত শ্রেণির লোকেরা আরাফার ময়দানে সাধারন লোকদের সাথে অবস্থান করতনা, অহমিকাবশতঃ মুযদালিফায় একটা স্বতন্ত্র উপত্যকা নিদিষ্ট করে রেখেছিল আল্লাহপাক এরুপ অহংকারও চূর্ণ করতে দ্বিধা করেননি।
৭) হজ্জের সময় ব্যবসা বানিজ্য বন্ধ করে দেওয়া এমনকি হজ্জের উদ্দেশ্যে বের হলে রুজি রোজগারের জন্য কিছু বেচাকেনা থেকে বিরত থাকা এবং একেবারে কপর্দকহীন মুসাফির বনে যাওয়া বড় ছওয়াবের কাজ মনে করা হত। আল্লাহপাক এ ভূল ধারনারও অপনোদন করলেন।
৮) জাহেলি যুগে হজ্জ সমাপনান্তে মিনার ময়দানে একত্র হয়ে কবিতা, লোক-গাথা ইত্যাদির মাধ্যমে পূর্ব পুরুষদের শৌর্য-বীর্য বর্ণনায় প্রথা ছিল সেটা বাতিল করে তার পরিবর্তে নিষ্ঠা ও একগ্রতার সাথে আল্লাহকে স্বরণ করতে বলা হয়েছে।
৯) হজ্জ থেকে ফিরে এসে লোকেরা ঘরের সন্মখভাগ দিয়ে প্রবেশ না করে পশ্চাৎ দিকের দরজা ব্যবহার করত। তাদের ধারনা ছিল সন্মখ দিয়ে প্রবেশ করলে হজ্জ নষ্ট হয়ে যাবে। আল্লাহপাক এরূপ অমূলক রেওয়াজও খতম করে দিলেন।
এভাবে জাহেলিয়াতের সকল প্রকার কুসংস্কার একে একে উৎখাত করে হজ্জকে খাঁটি ইবাদত হিসাবে পুনরায় ইব্রাহীম (আ.) প্রচলিত পবিত্রতা, ভাব গাম্ভীর্যতা ও মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হল। এমনকি হজ্জ ব্যক্তিগত ইচ্ছা অনিচ্ছার উপর ছেড়ে দেয়া হয়নি। যেসব মুসলমানের কাবা পর্যন্ত যাতায়াতের আর্থিক সঙ্গতি আছে, বাড়িতে সফরকালীন অনুপস্থিতির সময়ে পরিবারের ভরণ-পোষন মজুদ আছে, শারীরিকভাবেও যারা অসুস্থ বা দুর্বল নয় তাদের জীবনে অন্তত একবার হজ্জ করা ফরজ ঘোষণা হয়েছে। চাকরী, ব্যবসা, ছেলে মেয়ের বিয়ে-সাদী যত ঝামেলাই থাকুক না কেন, হজ্জকে কোন ভাবেই পিছানো উচিৎ নয়। হতে পারে একারণে হজ্জের পূর্বেই মৃত্যু এসে হাজির হবে আর এ মহা-সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে। আবার অর্থকড়ি আছে বলে বারবার হজ্জ করাকে একটা ফ্যাশন পরিণত করাও সংগত নয়। আল্লামা ইউসুফ আল কায়যাভীর মতে এক্ষেত্রে অগ্রাধিকারের মাছআলা হল ফরজ হজ্জ আদায় হওয়ার পর অর্থ সম্পদ বেশী হলে জনকল্যণে, দরিদ্রতা দুরীকরণে ব্যয় করা অধিকতর ছওয়াবের কাজ। তাইতো আমাদের নবী (সা.) জীবনে একবার হজ্জ আদায় করেন।
হজ্জের শিক্ষা
বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্টা ঃ হজ্জের সময় পৃথিবীর দুর দুরান্ত থেকে আগত লক্ষ মানুষের গায়ের রং আকৃতি ভাষা, পোশাক ভিন্ন ভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও যখন তারা সবাই আল্লাহর ঘরে সমবেত হয় তখন নিজ নিজ পোশাক বর্জন করে এহরামের পোশাক পরিধান করে। তখন মনে হয় যে সব একই সা¤্রাজ্যের প্রজা, সকলের প্রভু ও মনিব একজনই। যতদিন এখানে থাকে ততদিন সকলের কন্ঠে এক আওয়াজ “লাব্বাইকা আল্লাহুম্মা লাব্বাইক”। একই ইমামের পেছনে একই কায়দায় রুকু সেজদা তাসবীহ পড়ে। সকরের চিন্তা ধ্যারধারণা যেন একবিন্দুতে এসে সন্মিলিত হয়ে গেছে। এ যেন এক শীসা গলানো প্রাচীন। কার মাজহাব কি? কার পীর কে? কার দল কোথায়? সব যেন বিলীন হয়ে গেছে। তাওয়াফ, ছায়ী, মীনা মুযদালিফায় অবস্থান, কুরবাণী কোথাও প্রভেদ করার উপায় নেই। কে হানাফী, আর কে ওহাবী। অদ্ভূত এক মিলেমিশে এক তাবুর নীচে একই ইমামের আনুগত্য চলছে। হজ্জ থেকে বেরিয়ে যদি এরূপ সারাজীবন কায়েম থাকত তাহলে মুসলমানের গায়ে আঁচড়তো দুরে থাক, চিমটি কাটাও কোন ফেরাউনের বাচ্চার সাহস হতনা। বড় দুঃখের বিষয় মাযহাবী ফেরকা, রাজনৈতিক ফেরকা,খানকা ভিত্তিক ফেরকা আজ আমাদের শক্তিকে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
নির্মল পবিত্র মন:
একজন হাজী যখন হজ্জে যাওয়ার নিয়ত করে তার মনের মধ্যে স্বতঃস্ফুর্তভাবে আল্লাহর ভয়, তওবা এস্তেগফার ও পবিত্র চরিত্রের ভাবধারা জেগে ওঠে। সে তার প্রিয় আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধব ও সহকার্মী, পরিবার পরিজনের কাছে বিদায় চায়, দোয় ভিক্ষা করে আর বলে ভাই মাফ করে দিও যদি আর দেকা না হয়। হজ্জের যাত্রা শুরুর অন্ততঃ দু’তিন মাস আগে থেকেই নফল নামাজ, তাসবীহ তাহলীল, কুরআন তেলাওয়াতের দিকে মন রজু হয়ে কথা বার্তায় সর্তক হয়, পাছে কারো গীবত না হয়, পরনিন্দা না হয়ে যায়। সে মিথ্যা বলে না, মিথ্যা ওয়াদা দেয় না। কারো মনে এতটুকু কষ্ট হবে, এমন আচরণও তার কাছ থেকে প্রকাশ পায়না।
হাঁটতে উঠতে বসতে সদা সর্বদা কাবার নমুনা, রাসুল (সা.) এর রওজার ছবি যেন তার চোখে ফুটে উঠে। যার সঙ্গে দেখা হয় তাকেই বলে ভাই দোয়া কর, এ বছর হজ্জের নিয়ত করেছি। তার এ আচরণে আরো অনেক লোকের আত্মা হজ্জ করার উৎসাহে জেগে ওঠে।
কিন্তু পরম দুঃখের বিষয় হজ্জ শেষ হয়ে যাবার চল্লিশ দিনও যেতে পারেনা হাজী সাহেব যেন সম্পূর্ণ বদলে যায়। যত দ্রুত পবিত্র ভাবধারা পরিলক্ষিত হয় হজ্জ থেকে ফেরার পর তত দ্রুতই যেন এর প্রভাব বুদবুদের মত বিলীন হয়ে যায়।
এহরাম নয় যেন মৃত্যুর পোশাক:
এহরামের অবস্থায় হাজী সাহেবগণ সাদা বর্ণের দু প্রস্থ সেলাই বিহীন কাপড় পরেন, মাথা ও পা থাকে অনাবৃত। এতো এহরাম নয় যেন মৃত্যুর পর পরিয়ে দেয়া কাফন। সব এক, কে রাজা, কে প্রজা, কে ধনী, আর কে ফকির, কোন প্রভেদ নেই। বাদশাহকে তার সকল শাহী চিহ্ন মুুছে ফেলতে হয়, সেনাপতিকে খুলতে হয় তার শক্তি সাহসের সমস্ত পদক। আল্লাহর কাছে দুনিয়ার কোন পরিচই আজ ফায়দা দেবে না।
এতে কেউ কি মনক্ষুন্ন হয়? অথচ দুনিয়ার কোন অর্জন বিফলে গেলে, কাঙ্খিত কোন বস্তু হাছিল না হলে আমরা পেরেশান হয়ে পড়। কেউ আবার যেকোন উপায়ে সেটা পেতে অবৈধ পথ অবলম্বনেও দ্বিধা করি না।
ইহরামের পোশাক তো হাজিকে মৃত লাশে পরিণত করে। মৃত ব্যক্তির কি কোন প্রতিক্রিয়া থাকে? লোভ-লালসা কামনা-বাসনা থাকে? তার কি কোন ইচ্ছা, স্বাধীনতা, রাগ অনুরাগ থাকে? হজ্জের যে কয়টা দিন হাজী সাহেব এহরাম অবস্থায় থাকে সে কয়টা দিন মানুষ মারা তো দুরের কথা একটা মশা মাছিও মারতে পারেনা।
এমনকি গাছের একটা সবুজ পাতাও বিনা কারণে ছিড়া যায় না। সংযম প্রদর্শনের এত বড় একটা মহড়ার পর কোন হাজী কি হজ্জ থেকে ফিরে এসে এ প্রাকটিস অব্যাহত রাখেন?
ইসলামী জামায়াতের সকল বিষয়ে একটাই কেন্দ্র:
মুসলমানদের শুধু নামাজের কেবলাই নয় বরং জীবনের সকল দিক ও বিভাগের আদেশ নিষেধের একক কেন্দ্রবিন্দু কাবাঘর। তা না হলে পৃথিবীর সকল জায়গা থেকে মুসলমানদের এখানে জড়ো করে বাস্তব ভাবে এটা দেখিয়ে দেওয়ার প্রযোজন ছিল না।
এ রকম একটা জামাতের উদ্দেশ্য তো এটা নয় যে সকলে এখানে এসে পিকনিকের মত কিছু সময় খাওয়া, দাওয়া, ঔতিহাসিক স্থান দর্শন এবং আসমানি গল্পগুজব করে কাটিয়ে দেবে বরং এক আল্লাহর সন্তুষ্টির নামে পৃথিবীর সমস্ত কোন থেকে কালেমা পড়া মুসলমানদের টেনে এনে একত্রিত করা, যাতে করে আল্লাহর বন্দারা নিজ নিজ অঞ্চলে, জাতিতে এবং রাষ্ট্রে তার দ্বীন কায়েমের উত্তম কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারে।
বড়ই আফসোসের ব্যাপার আজ মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববীর খাদেমাইন নামে যারা খ্যাত তারা হজ্জের এত বড় একটা প্রোগ্রাম হাতে পেয়েও কাজে লাগায় না, মুসলমান জাতির স্বার্থের উন্নয়নে একটা শব্দও উচ্চারণ করে না, ইসলামী উম্মার বাঁচা-মরার বিষয়ে কোন কর্মসূচী প্রণীত হয় না।
হজ্জের খোতবা নামক বিশেষ ভাষণে সারা দুনিয়ার মুসলিম নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোন নিন্দা বাক্যও বলা হয়না। এ কারণে হজ্জ করতে আসা লাখ লাখ হাজীর জন্য আজ হজ্জ একটা গতানুগতিক সফরে পরিণত হয়েছে।
জীবন থেকে শয়তানি শক্তি চির দিনের জন্য উৎখাত ঃ হজ্জে অনুষ্ঠানাদির মধ্যে রয়েছে মীনায় শয়তানকে পাথর মারার প্রতিকী বিষয়। এ মহড়া এজন্যে যে হাজীগণ যাতে শয়তানের কর্মকান্ডে চিহ্নিত ও প্রতিহত করতে উদ্বুদ্ধ হন।
হাজী সাহেবগণও জানেন শয়তান কেবল জিলহজ্জের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ হাজীর কংকরের আঘাত খাবার জন্য অপেক্ষা করে না। তাহলে কোথায় কাকে কেন কংকর নিক্ষেপ করা হচ্ছে? মানুষকে দুনিয়ায় পাঠিয়ে আল্লাহ পাক শয়তানকে তার প্রতিপক্ষ স্থির করে দিয়েছেন। সে প্রতি পদে পদে নিত্য নতুন ষ্টাইলে মানুষকে গোমরাহ বানানোর ফাঁদ পাতে।
শয়তানী শক্তিকে পরাজিত করে আল্লাহর গোলামীর শৃংখলে আবদ্ধ থাকাই মোমিনের ইবাদতের লক্ষ। জীবনের সকল দিক ও বিভাগে হয় সে আল্লাহর বন্দিগী অনুগত্যকে মেনে নিবে নতুবা শয়তানের অনুসারী হবে। মাঝামাঝি কোন অবস্থান নেই। শয়তানকে পাথর নিক্ষেপ কালে হাজী সাহেবগণ তো এই শপথের পুনারাবৃত্তি করেন। শয়তানকে জোশের সাথে পাথর নিক্ষেপ করে হাজী সাহেবগণ বাড়ি ফিরেন অথচ আল্লাহর কিতাব রসুলের সুন্নাতের সাথে নিজ চরিত্র, কর্মনীতি মিলান না।
এমন বহু হাজী আছেন যাদের কর্মনীতি ও জীবনাচারে কুরআরও হাদীসের সর্মথন মিলেনা, বরং শয়তানের সঙ্গে সখ্যতার প্রমাণ পাওয়া যায়।
কাবার সাথে মায়ের মত সম্পর্ক মোমিনের:
আল্লাহ তা’আলা কুরআনুল করীমে মক্কাকে নগর সমূহের মা বলে সম্বোধন করেছেন- “এভাবে আমি তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি আরবী ভাষায় যাতে তুমি সতর্ক করতে পার নগরীর মা মক্কা ও তার চতুষ্পার্শের জনগনকে।” (সূরাহ আশ শুরা-৭)
মায়ের সাথে সন্তানের যে সম্পর্ক মোমিনের সাথে মক্কার সে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা হজ্জের উদ্দেশ্য। সন্তান দেশে-বিদেশে যেখানেই অবস্থান করুক সুখে বা দুখে যে অবস্থায় থাকুক মায়ের কথা কি কোন ভাবেই বিস্মৃত হতে পারে?
সন্তান তো প্রতি মুহূর্তে শ্রদ্ধাভরে স্বরণ করে তার মায়ের কষ্টকাতরতার কথা। কষ্টের পর কষ্ট সহ্য করে যিনি গর্ভে ধরেছেন, সব বেদনা সয়ে জন্ম দিয়েছেন আর শিশু কালে লালন-পালন করেছেন। মায়ের আদেশ মায়ের নিষেধ তা সন্তানের জন্য মঙ্গল-অমঙ্গল যাই হোক সন্তান বিনা বাক্যে তা মেনে নেয়।
কোন কথা বা কাজ মায়ের মনে কষ্টের উদ্রেক করতে পারে এমন কথা ও কাজ করা থেকে বিরত থাকে। মক্কা আমাদের মুসলমানদের মা কিন্তু আজ এই মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক নেই।
মক্কার চেয়ে আজ আমেরিকা, রাশিয়া, দিল্লী, আমাদের প্রিয়। রাজনীতি, অর্থনীতিতে আজ এরা আমাদের মুরুব্বি। হজ্জের মাধ্যমে আমরা এসব তথাকথিত মুরুব্বিদের অন্ধ অনুগত্য পরিহারের শিক্ষা পাই।
পরের পর্ব ক্লিক/টাচ্ করে পড়ুন- পবিত্র হজ্জ ও ওমরার বিধান : পর্ব -২
পরের পর্ব ক্লিক/টাচ্ করে পড়ুন- পবিত্র হজ্জ ও ওমরার বিধান : পর্ব -১