হজ্জ সম্পর্কে কুরআন ও হাদীসের ঘোষণা হচ্ছে-
১. মানুষের মধ্যে যারা সেখানে যাবার সার্মথ্য রয়েছে আল্লাহর উদ্দেশ্যে ঐ গৃহে হজ্জ করা তা অবশ্য কর্তব্য। যে কুফরী করল সে জেনে রাখুক আল্লাহ বিশ্বজগতের মুখাপেক্ষী নন। (সূরা আল ইমরান আয়াত – ৯৭)
২. মহানবী (সা.) বলেছেন – ‘হে লোক সকল ! তোমাদের উপর হজ্জ ফরজ করা হয়েছে অতএব হজ্জ আদায় কর।’ – মুসলিম।
হজ্জের ইতিহাস:
হজ্জ শুরুর ইতিহাস পবিত্র কুরআন থেকে আমরা জানতে পারি। হযরত ইব্রাহিম (আ.) ছিলেন দুনিয়ার হজ্জ প্রচলনকারী পয়গাম্বর। কিতাবধারী প্রতিটি ধর্মের অনুসারীরা কমবেশী তাঁর সঙ্গে পরিচিত। হযরত (আ.), হযরত মুসা (আ.) এবং শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) তাঁর বংশজাত। এক পূজারী বংশে তাঁর জন্ম। আকামের তারকা, গ্রহ নত্র থেকে গাছ-পালা পর্যন্ত এমনকি মাটি বা পাথর দিয়ে তৈরী পুতুলকে তারা প্রভুজ্ঞানে পূজা করত। রাজা বাদশাহদেরও মানুষ প্রভূত শক্তির অধিকারী দেবতা মনে করত। জ্ঞান হওয়ার সাথে সাথে ইব্রাহিম (আ.) ভাবতে শুরু করলেন চন্দ্র, তারকা, গ্রহ নক্ষত্র যদি খোদা-ই হয় তবে তাদের উদয় অস্ত কেন হবে?
মুর্তি যদি মানুষের ভাগ্য নির্মাতা, কল্যাণ অকল্যাণ নির্দেশক হয় তবে সে নিজেই এতো দুর্বল কেন যে তার মুখে মাছি বসে বাহ্যত্যগ করলে সে তা তাড়াতে পারে না? এক সময় ভাবতে ভাবতে আবিস্কার করেন আকাশ ও জমিনের মালিককে, মানুষ সহ সকল সৃষ্টির স্রষ্টা পালনেওয়ালকে। তিনি ঘোষণা করলেন- ‘‘আমি সব দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কেবল সেই মহান স্বত্তাকেই ইবাদতের জন্য নিদিষ্ট করলাম যিনি আকাশ ও জমিনের স্রষ্টা এবং আমি ঘোষণা দিচ্ছি যে আমি অংশীদারীদের দলভুক্ত নই।’’ (আনআম – ৭৯)
এরূপ বিপ্লবাত্মক ঘোষণার পর ইব্রাহিম (আ.) এর উপর বিপদ মুসিবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। পিতা আজর ছিল মূর্তিপুজারীদের নেতা। তিনি পুত্রের উপর কঠোর শাসন আরোপ করলেন। সমগ্র জাতি তার বিরুদ্ধে গেল এমনকি শাসক শ্রেণিও।
তিনি ধর্য্যরে সাথে সব সহ্য করলেন। একদিন নিজ হাতে মূর্তি ভেঙ্গে মুর্তির গলায় কুঠার ঝুলিয়ে বললেন আমাকে এর জন্য দায়ী না করে যাদের তোমরা শক্তি ও ক্ষমতার উৎস জেনে পূজা কর তাদের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ মুর্তিটাকে বরং জিজ্ঞাসা কর। ইব্রাহিমের যুক্তির কাছে নমরুদের লোকেরা পরস্থ হলেও তার জন্য প্রস্তুত হলো অগ্নিকুন্ড। কিন্তু আল্লাহ পাক অগ্নিকুন্ডকে শান্তিদায়ক পরিণত করে দিলেন।
অতএব জালিম সম্পদায় তাকে দেশ থেকে বহিস্কার করল। তিনি দ্বিধাহিন চিত্তে স্বজাতি, আত্মীয়স্বজন, জন্মভুমি সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে যাযাবর জীবন বরদাশত করে নিলেন। জীবনের ছিয়াশি বছর পর আল্লাহ পাক সন্তান ইসমাইলকে দান করলেন।
ছোট্র শিশু ইসমাইলকে সাথে করে প্রসূতি হাজেরাকে নিয়ে অনির্দিষ্ঠ গন্তব্যে চললেন। পথ চলা যেন শেষ হয় না অবশেষে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মক্কার এক মানবতীন প্রান্তে পৌছলেন। এখানে না আছে খাবার পানীয়ের বন্ধোবস্ত আর না আছে কোন সাহায্যকারী মানুষজন। এরই মধ্যে ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে অসুস্ত স্ত্রী আর শিশু ইসমাইলকে আল্লাহর কাছে সোপর্দ করে বেরিয়ে গেলেন।
কোন মমতাই তাকে রবের আহবান থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারলনা। দুগ্ধ পোষ্য ইসমাইলকে নিয়ে হাজেরা মরুভূমির তীব্র সূর্যতাপে তৃষ্ণার্ত হলে পানির জন্য হন্যে হয়ে ছাফা মারওয়া দু পাহাড়ের মধ্যে সাতবার ছোটাছুটি করলেন। আল্লাহ পাক অবশেষে করুণা করেন এবং শিশুপুত্র ইসমাইলের পায়ের নিচে পানির ধারা সৃষ্টি করে দিলেন। যা আজ দুনিয়ার লক্ষ কোটি হাজীর কাছে একটা নিদর্শন হিসাবে ইতিহাসের নিরব সাক্ষী হয়ে আছে।
আল্লাহ এ ঘটানা কুরআনে এভাবে বলেছেন-
‘‘নিশ্চয়ই ছাফা ও মারওয়া আল্লাহর নির্দশন সমূহের মধ্যে অন্যতম। সুতরাং কোন ব্যক্তি হজ্জ ও উমরায় পাহাড়দ্বয় সায়ী করলে কোন দোষ নেই। কেউ স্বতঃস্ফুর্তভাবে সৎকাজ করলে আল্লাহকে সর্বোত্তম পুরস্কার দাতা হিসামে পাবে’’। (বাকারা-১৫৮)
এর পর তৃতীয় পরীক্ষা এসে উপস্থিত হলো। ইসমাইল (আ.) বয়ঃপ্রাপ্ত কিশোর হলে আল্লাহপাক ইব্রাহিম (আ.) কে স্বপ্নে নির্দেশ দিলেন পুত্রকে জবেহ করতে। পুত্রকে প্রস্তাব দিতেই তিনি কালবিলম্ব না করে রাজী হলেন।
আল্লাহপাক জগৎবাসীর কাছে এ ঘটনা বর্ণনা করেছেন-
‘‘অতঃপর সে যখন তার পিতার সাথে কাজ করার মত বয়সে উপনীত হল তখন ইব্রাহীম বলল, হে পুত্র ! আমি স্বপ্নে আদিষ্ট হয়েছি তোমাকে জবেহ করতে। বল, তোমার অভিমত কি? সে বলল হে পিতা! আপনি নিশ্চিন্ত মনে আদেশমত কাজ করুন। আল্লাহ চাইলে আপনি আমাকে ধৈর্য্যশীলদের মধ্যে পাবেন’’।
“অতঃপর তারা উভয়ে যায় উপর যে আদেশ ছিল তা পালন করল। ইব্রাহীম পুত্রকে জবেহর উদ্দেশ্যে কাত করে শোয়াল। তখন আমি ইব্রাহীমকে ডেকে বললাম, হে ইব্রাহীম তুমি তো স্বপ্নাদেশ বাস্তবায়ন করেই ছাড়লে। এভাবে আমি মুহসিন বান্দাদের প্রতিদান দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই এটা ছিল এক স্পষ্ট পরীক্ষা।” (সূবাহ সাফফাত ১০২-১০৬)
এভাবে যৌবনের শুরুতে নবী আপন মালিকের আহবান ও দাওয়াতকে বিনাশর্তে কবুল করেছিলেন। যখন তাকে বলা হল, ‘আত্মসমর্পন কর’ তিনি বলেছিলেন, ‘আমি সারা জাহানের রবের কাছে পূর্ণ আত্মসমর্পন করলাম। একথা বলেননি যে মা’বুদ বেছে বেছে তোমার হুকুমের যে গুলো নিরাপদ, শান্তিপূর্ণ সেগুলো মানবো কিন্তু জেল জুলুম অত্যাচারের ভয় আছে যেখানে, সেগুলো মানবো না। এজন্যেই পুরোহিতের ঘরে জন্ম নিয়ে পৌরহিত্যের আসন নিশ্চিত থাকার পরও তা ত্যাগ করলেন, বংশ পরিবার ধর্ম ছাড়লেন, নির্বাসনের কষ্ট বরণ করলেন এমনকি স্বৈরাচারের তৈরী করা অগ্নিকুন্ডে ঝাপ দিয়ে খোদানুগত্যের প্রমাণ দিলেন। শুধু ইব্রাহীমই নয় আল্লাহর যে গোলামই হক প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর হবেন, রক্তের নজরানা পেশ করবেন তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে পুরস্কারের ওয়াদা রয়েছে।
আল্লাহ বলেন-
“ইব্রাতীমের উপর সালাম। আর এভাবে আমি সৎকর্মশীলদের পুরস্কার দিয়ে থাকি।” (সূরাহ সাফফাত ১০৯-১১০)
একে একে কঠিন থেকে কঠিনতম পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হওয়ার পর আল্লাহর পক্ষ থেকে তাকে বলা হল- এখন তোমাকে সারা জাহানের ইমাম পদে নিযুক্ত করা হল যার যোগ্যতা তুমি অর্জন করেছে। “স্বরণ কর যখন ইব্রাহীমকে তাঁর রব কয়েকটা ব্যাপারে পরীক্ষা করলেন এবং সে সফল ভাবে উর্ত্তীণ হল, তখন তাকে জানিয়ে দেওয়া হল তোমাকে মানব জাতির নেতা নিযুক্ত করেছি। তিনি বললেন, আমার বংশধরদের মধ্য থেকেও কি? আল্লাহ বলেন জালেমদের জন্য আমার ওয়াদা প্রযোজ্য নয়।” (সূরা বাকারা ১২৪)
ইব্রাহীম (আ.) বিশ্ব জাহানের ইমাম পদে নিযুক্ত লাভের পর প্রয়োজন অনুভব করলেন একটা প্রশাসনিক রাজধানীর। পিতা পুত্র ইব্রাহীম ও ইসমাঈল মিলে খানায়ে কারা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করলেন। উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এক আল্লাহ বিশ্বাসী সকল মুসলমান বৎসরে একবার এখানে এসে মিলিত হবে। সংঘবদ্ধভাবে এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং এখান থেকে ইসলামী বিপ্লবের কর্মসূচী নিয়ে নিজ নিজ দেশে ফিরে যাবে। বিশ্ব মুসলিমের এ বাৎসরিক সন্মেলনের নামই হজ্জ। কুরআন হাকীমে কাবা ঘর পুনঃপ্রতিষ্ঠাও হজ্জের ইতিহাস বিস্তারিত ভাবে বর্ণনা করেছে।”
“নিশ্চয়ই মানব জাতির জন্য সর্ব প্রথম গৃহ নির্মাণ হয়েছিল মক্কায় এটা বরকতময় ও সারা দুনিয়ার হেদায়েতের কেন্দ্র। এতে আল্লাহর প্রকাশ্য নিদর্শণসমূহ বিদ্যামান যেমন মাকামে ইব্রাহীম। যে সেখানে প্রবেশ করবে সিই নিরাপত্তা পাবে। মানুষের মধ্যে যাদের সেখানে যাওয়ার সামর্থ্য আছে আল্লাহর উদ্দেশ্য ঔ ঘরের হজ্জ করা তার কর্তব্য। কেউ প্রত্যাখ্যান করলে সে জেনে রাখুক আল্লাহ বিশ্বজগতের কারো মুখাপেক্ষী নন।” (আলে ইমরান ৯৬-৯৭)
শুধু কাবা ঘরই নিরাপদ স্থান নয়, এর চার পাশে বহুদুর বিস্তৃত যতটুকু হারাম এলাকা রয়েছে ততটুকু এলাকা সম্পর্ণ নিরাপদ। এখানে হত্যা, লুন্ঠন, মারামারি, যুদ্ধ বিগ্রহ নিষিদ্ধ। এমনকি দুধর্ষ কোন বেদুইন যদি এ সীমান মধ্যে তার পিতার হত্যাকারীকে পাশেও পায় তবুও তাকে স্পর্শ করার অধিকার নেই।
ছোট একটা ক্ষুদ্র প্রাণী মশা কিংবা মাছিও মারা যাবে না। এমনকি অহেতুক বিনা কারণে জীবন্ত গাছের পাতা কিংবা দুর্বাঘাষও উপড়ানোর অনুমতি নেই। আল্লাহ বলেন- “তারা কি দেখেনা আমি হারামকে কিভাবে বিপদশূণ্য ও নিরাপদ স্থান করেছি। অথচ এর চার পাশে মানুষের উপর হামলা হত। তবুও কি তারা বাতিলকেই বিশ্বাস করবে আর আল্লাহর নেয়ামতকে অস্বীকার করে যাবে?” (সূরাহ আনকাবুত- ৬৭)
“ স্বরণ কর যখন কাবা ঘরকে মানবজাতির মিলনকেন্দ্র ও নিরাপদ আশ্রয় করেছিলাম এবং নির্দেশ দিয়েছিলাম মাকামে ইব্রাহীমকে নামাজের স্থানরূপে নির্দিষ্ট কর। ইব্রাহীম ও ইসমাইলকে আরো বলেছিলাম তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সেজদা কারীদের জন্য এ ঘরকে পবিত্র রাখতে ”(সূরাহ বাকারা-১২৫)
কা’বাঘর প্রতিষ্ঠাকলে আল্লাহর নবী ইব্রাহীম (আ.) ও তার পুত্র ইসমাঈল (আ.) যে দোয়া করেছিলেন আল্লাহপাক তাও কুরআনে হাকীমে উদ্ধৃত করে দিয়েছেন।
“ স্বরণ কর যখন ইব্রাহীম ও ইসমাইল কাবার দেয়াল তুলছিলেন তখন তারা প্রার্থণা করেছিল, হে আমাদের রব! আমাদের এ মেহনত তুমি কবুল কর। নিশ্চয়ই তুমি সর্বশ্রোতা ও সর্বজ্ঞ।”
“ হে আমাদের রব! আমাদের উভয়কে তোমার অনুগত বান্দা কর, আমাদের বংশ থেকে অনুগত উম্মত বানিও, আমাদের ইবাদতের নিয়ম পদ্ধতি শিখিয়ে দাও এবং আমাদের ক্ষমা কর। তুমি তো ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু।”
“ হে আমাদের রব! সে জাতির কাছে তাদের মধ্য থেকে এমন একজন রাসুল পাঠাও যিনি তোমার আয়াত সমূহ তাদের কাছে পড়ে শুনাবেন, তাদেরকে কিতাব শিক্ষা দেবেন এবং তাদের চরিত্র সংশোধন করবেন। তুমি তো পরাক্রমশালী এবং প্রজ্ঞাময়।” (সূরাহ বাকারা ১২৭-১২৯)
ধুসর মরুভূমিতে খাদ্য ও পানীয়ের যেন অভাব না হয় সে জন্য আল্লাহ এ বান্দা পরম রিজিকদাতার কাছে সে আবেদনটুকুও জানাতে ভুলে যাননি।
“স্বরণ কর যখন ইব্রাহীম বলেছিল হে আমার রব! একে নিরাপদ শহর বানাও আর এর অধিবাসীদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের উপর ঈমান আনে তাদেরকে ফলমূল থেকে জীবিকা দান করঃ।” (সূরাহ বাকারা- ১২৬)
একই ধরনের প্রার্থণা সুরাহ ইব্রাহীমের ৬ষ্ঠ রুকুতে বর্ণনা করা হয়েছে। অত্যন্ত বিনীতভাবে আল্লাহর খলিল তার রবের কাছে কি বলছেন শুনুন- “স্বরণ কর যখন ইব্রাহীম বলেছিলেন হে আমার রব! এ শহরকে শান্তিপূর্ণ বানিয়ে দাও। আমাকে ও আমার সন্তানকে মুর্তিপূজার শিরক থেকে বাঁচাও। হে আমাদের রব। এ মুর্তিগুলো বহু মানুষকে গোমরাহ করেছে। সুতরাং যে আমার তরিকা অনুসরণ করবে সে আমাদের দলভুক্ত হবে আর যে আমার অবাধ্য হবে (তুমি ক্ষমা কর) তুমি তো বড় ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” “হে পরওয়ারদেগার! আমার বংশধরদের একটা অংশকে তোমার ঘরের কাছে এ ধুসর মরুভূমিতে এনে পুর্নবাসিত করেছি মাবুদগো এ উদ্দেশ্যে যে তারা নামাজ প্রতিষ্ঠা করবে। তুমি লোকদের অন্তরে এতটুকু উৎসাহ সৃষ্টি করে দাও যেন তারা (দলে দলে) এদিকে ছুটে আসে এবং ফল ফলাদির দ্বারা তাদের রিজিকের বন্দবস্ত করা। সম্ভবত এর দ্বারা তারা তোমার কৃতজ্ঞ বান্দায় পরিণত হবে।”
“হে আমাদের পালনেওয়ালা! তুমি তো জান যা আমরা গোপনে করি আর যা প্রকাশ্যে করি। আকাশ আর জমিনের কোন কিছু আল্লাহর কাছে গোপন থাকেনা। সমস্ত প্রশংসা আল্লাহর যিনি আমার বার্ধ্যক্য বয়সে ইসমাঈল ও ইসহাককে দান করেছেন। নিশ্চয় তিনি আমাদের দোয়া শুনছেন।”
“হে আমাদের মালিক! আমাকে ও আমার বংশধরদের নামাজ কায়েমকারী বানাও। মাবুদগো আমাদের দোয়া কবুলকর। ওগো মাওলা! যে দিন হিসাব নিকাশ হবে সেদিন আমাকে, আমার মা বাবাকে আর মুমিনদের তুমি ক্ষমা কর।”
নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তার অনুসারীদের ভূলে যাননি বরং কায়মনোবাক্যে প্রতিপালকের কাছে তাদেরকে সৎপথে থাকার, আনুগত্য ও ইবাদতে অনুরাগী হওয়ার জন্য এবং তাদের জীবন জীবিকার জন্য প্রার্থণা করেছেন। আখেরাতের আদালতে যখন হিসাম নিকাশ হবে তখন সে মুছিবতের সময়ও যেন দলীয় লোকদের প্রতি আল্লাহ পাক ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখেন। নেতৃত্বের এমন আদর্শ অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সেই নবীরই শোভা পায় যাকে আল্লাহ জাতির পিতা খেতাব দিয়েছেন।
মূলত: আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর খলীল ইব্রাহীম (আ.) এর উপর হুকুম ছিল হজ্জের উদ্দেশ্যে কারাঘর তৈরী করা, পরিস্কার পরিচ্ছন্ন রাখা এবং সর্বোপরি হজ্জের ঘোষণা দেয়া। “স্বরণ কর যখন আমি ইব্রাহীমের জন্য এ ঘরের জায়গাকে ঠিক করে বলেছিলাম আমার সাথে কোন প্রকার শিরক করোনা আমার ঘরকে পাকসাফ রাখ তাদের জন্য যারা তাওয়াফ করে যারা নামাজ আদায়; রুকু ও সেজদা করে।
লোকদের প্রকাশ্যভাবে হজ্জের আহবান জানাও যেন তারা এ স্থানে আসে পায়ে হেঁটে কিংবা ক্ষীণকার উটের পিটে চড়ে (ঐ সময়ে যে যানবাহন ব্যবহৃত হত) তারা আসবে দুর-দুরান্তের পথ পাড়ি দিয়ে। এখানে পৌঁছে তারা কল্যাণময় স্থানগুলি দেখতে পারে এবং আল্লাহর নাম উচ্চারণ করতে পারে নির্দিষ্ট দিনে রিজিক হিসাবে প্রদত্ত পশু কুরবাণী করে। তা থেকে নিজেরাও খাবে, দরিদ্র ও অভাবগ্রস্থ লোকদেরও খাওয়াব্ ে” (সূরাহ হজ্জ ২৬-২৮)
উপরোক্ত আয়াত সমূহ পর্যালোচনা করলে এ বিষয়টা স্পষ্ট হয় যে, হযরত ইব্রাহীম (আ.) বিশ্বব্যাপী যে ইমামত প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং সে লক্ষ্যে দাওয়াত দিয়েছিলেন তার কেন্দ্র ছিল মক্কা। এর উদ্দেশ্য ছিল দুনিয়ার যে প্রান্তে যারাই আল্লাহকে তাদের ইলাহ মেনে নিয়ে বাস্তব জীবনে তার আনুগত্য করবে তারা যে দেশের আধিবাসীই হোক না কেন বছরের কয়েকটা দিনের জন্য এখানে সমবেত হবেন।
একই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নবী মুহাম্মদ (সা.) কেও আল্লাহ তা’আলা হজ্জের নির্দেশ দিয়েছেন। এ জন্য দীর্ঘ সময় পর্যন্ত তিনি লোকদের মস্তিস্ক ধোলাইর কাজ চালিয়েছেন। মক্কার কঠিন দিন গুলোতে অত্যাচার আর জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে মদীনায় যেতে বাধ্য হন। মাত্র দুই থেকে আড়াই হাজার সাথী নিয়ে রাসূল (সা.) এ হিজরত সম্পন্ন হয় মেরাজের মাত্র দুই বছরের মাথায়।
এ পর্যায়ে একটা পুর্ণাঙ্গ ও পরিপূর্ণ ইসলামী রাষ্ট্র কাঠামো তৈরি করার হুকুম নাজির হতে শুরু করে। প্রথমে নামাজ ফরজ হয় অতপর হিজরতের অব্যবহিত পরেই ২য় ও ৩য় সনে যথাক্রমে রোজা ও যাকাত ফরজ হয়। ৬ষ্ট হিজরিতে যখন মুসলমানরা যুদ্ধ বিগ্রহর পর শক্তিশালী জাতি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে, স্বাধীনতা ও স্বার্বভৌমত্ব সুসংহত হয়, তদানীন্তন বড় বড় শক্তি গুলো ইসলামের বশ্যতা স্বীকার করে নেয় ঠিক তখনই মুসলমানদের কাবা কেন্দ্রিক আর্ন্তজাতিক সন্মেলন হজ্জের আনুষ্ঠানিক বাধ্যবাধকতার নির্দেশ আসে।
হজ্জের সংস্কারঃ হযরত ইব্রাহীম (আ.) পরবর্তী সময় জাতি শিরক মুক্ত খাঁটি তাওহীদ ভুলে গিয়ে পুনরায় মুর্তি পুজা শুরু করে দেয় এমনকি কাবা ঘরের ভিতরে ৩৬০ টি মুর্তি স্থাপন করে। তাদের মুর্খতা এতদুর বিস্তৃত হয় যে হজ্জকে তারা তীর্থযাত্রার আনুষ্টানিকতায় রূপান্তর করে ছাফা মারওয়ায় দেবদেবীর মুর্তি স্থাপর করে এবং সেগুলিকে ঘিরে নারী পুরুষ উলংগভাবে তাওয়াফ ও ছায়ী করত।
নাচ গান ব্যভিচার মদপানের এক মহোৎসব হত এবং নির্লজ্জ কাজ কর্মের অনুষ্ঠান বিশেষ জাঁকজমকের সাথে সম্পন্ন হত। তারা কুরবাণী করত কিন্তু কুরবানীর রক্ত কাবা ঘরের দেওয়ালে লেপে দিত এবং গোশত কাবার দুয়ারে ফেলে রাখত। এভাবে হজ্জের সকল কানুন বিকৃত করেই ক্ষান্ত হয়নি এ উপলক্ষে নতুন নতুন রেওয়াজেরও প্রচলন করে।
যেমন কোন সময় মালপত্র ছাড়াই এক কাপড়ে কপর্দকহীন অবস্থায় হজ্জ যাত্রা করত, হজ্জ উপলক্ষে ব্যবসা ও কামাই রোজগারকে নাজায়েজ ভাবতো, অনেকে আবার হজ্জের সময় পানাহার এবং কথাবার্তা বন্ধ রাখত।
আল্লাহপাক তার খলীল ইব্রাহীম (আ.) এর অনুরুপ হজ্জ ফিরিয়ে আনতে তাঁর হাবীব মুহাম্মদ (সা.) কে শুধু হজ্জের নির্দেশই দিলেন না একই সাথে যেসব কুসংস্কার ও মুশরেকী রীতি পদ্ধতি ও অজ্ঞতা এর মধ্যে ঢুকে পড়েছিল তার উৎখাত করার হুকুম ধারাবাহিক ভাবে দিতে থাকলেন। এর ফলে সমস্ত প্রকার বিকৃতি রোধ করে হজ্জ একটি খাঁটি ইবাদতে পরিণত হল।
আগের পর্ব পড়ুন– পবিত্র হজ্জ ও ওমরার বিধান : পর্ব -১
[author image=”https://chandpurtimes.com/wp-content/uploads/2016/06/Shamsuddin-Mahmud-e1466897735328.jpg” ] লেখক- মাও. শামছুদ্দিন [/author]
Chandpur Times | চাঁদপুর টাইমস Top Newspaper in Chandpur