বায়তুল মুকাদ্দাস বা মসজিদুল আকসা ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম মসজিদ। বায়তুল মুকাদ্দাস অর্থ পবিত্র ঘর। মসজিদুল আকসা অর্থ দূরবর্তী মসজিদ। মসজিদুল হারামের অবস্থান থেকে মসজিদুল আকসা দূরে অবস্থিত হওয়ায় বায়তুল মুকাদ্দাসকে কোরআনে মসজিদুল আকসা বলা হয়েছে।
ফিলিস্তিনের জেরুজালেমে অবস্থিত এ মসজিদে মিরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.) গমন করেন এবং সব নবী-রাসুলের ইমামতি করেন। এটি মুসলমানদের প্রথম কিবলা। পবিত্র কোরআনে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন অঞ্চল পুণ্যভূমি হিসেবে আলোচিত হয়েছে।
মুসলমানদের প্রথম কিবলা : মসজিদুল আকসা মুসলমানদের প্রথম কিবলা।
এ মসজিদের দিকে মুখ করে রাসুলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিরা নামাজ আদায় করতেন। হিজরতের ১৭ মাস পর কিবলা পরিবর্তনের নির্দেশ সংবলিত আয়াত নাজিল হয়। তাতে মসজিদুল আকসা থেকে মসজিদুল হারাম অভিমুখে নামাজের আদেশ দেওয়া হয়। মহান আল্লাহ বলেন, ‘আকাশের দিকে তোমার বারবার তাকানো আমি অবশ্য লক্ষ করি।
সুতরাং তোমাকে অবশ্যই এমন কিবলার দিকে ফেরাব,যা তুমি পছন্দ করো। অতএব তুমি মসজিদুল হারামের দিকে মুখ ফেরাও। তোমরা যেখানেই থাকো না কেন, তার দিকেই মুখ ফেরাও। আর যাদের কিতাব দেয়া হয়েছে তারা নিশ্চিতভাবে জানে যে তা তাদের রবের প্রেরিত সত্য। তারা যা করে সে ব্যাপারে আল্লাহ অনবহিত নন।’ (সুরা: বাকারা, আয়াত : ১৪৪)
রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর গমনস্থল: মিরাজের রাতে রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সব নবী-রাসুল সমবেত ছিলেন। তিনি সেখানে পৌঁছার পর আজান ও ইকামাত দেয়া হয়। নবী-রাসুলরা কাতারবন্দি হয়ে দাঁড়িয়ে যান। জিবরাইল (আ.) রাসুলুল্লাহ (সা.)- এর হাত ধরে ইমামতির জন্য সামনে বাড়িয়ে দেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) সব নবী ও রাসুলের ইমামতি করেন। (দ্র. সীরাতুল মুস্তফা, প্রথম খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৯৫-২৯৬)
তারপর তাঁর ঊর্ধ্বাকাশে ভ্রমণ শুরু হয়। আল্লাহ বলেন,‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি যিনি তাঁর বান্দাকে রাতে ভ্রমণ করিয়েছিলেন আল-মসজিদুল হারাম থেকে আল-মসজিদুল আকসা পর্যন্ত, যার পরিবেশ আমি করেছিলাম বরকতময়, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১)
বরকতময় ভূখণ্ড ফিলিস্তিন
পৃথিবীর এক বরকতময় স্থান। এখানে অনেক নবী-রাসুলের আবাসস্থল ছিল। ইবরাহিম (আ.), ইসহাক (আ.),ইয়াকুব (আ.), মুসা (আ.), দাউদ (আ.), সুলাইমান (আ.), ঈসা (আ.) ও আরো অনেক নবী-রাসুলের অনুসারীরা এই ভূমিতে বসবাস করতেন। ফিলিস্তিন অসংখ্য নবী-রাসুলের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এর আশপাশে অনেক নবী-রাসুলের সমাধি আছে। পবিত্র কোরআনের পাঁচ স্থানে মহান আল্লাহ ফিলিস্তিনকে বরকতময় ও পুণ্যময় ভূখণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছেন—
১.‘যার (মসজিদুল আকসার) আশপাশে আমি বরকত নাজিল করেছি, তাকে আমার নিদর্শন দেখানোর জন্য; তিনিই সর্বশ্রোতা, সর্বদ্রষ্টা।’ (সুরা : বনি ইসরাইল, আয়াত : ১) এ অঞ্চল প্রাকৃতিক নদ-নদী, ফল-ফসলের প্রাচুর্য এবং নবীদের বাসস্থান ও কবরস্থান হওয়ার কারণে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দাবি রাখে। এ কারণে একে বরকতময় আখ্যা দেয়া হয়েছে।
২. ‘আর আমি তাকে (ইবরাহিম) ও লুতকে উদ্ধার করে নিয়ে গেলাম সেই ভূখণ্ডে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি বিশ্ববাসীর জন্য।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৭১) বেশির ভাগ ব্যাখ্যাদাতার কাছে এ থেকে শাম (বর্তমানে সিরিয়া ও ফিলিস্তিন) দেশকে বোঝানো হয়েছে, যাকে শস্য-শ্যামলতা, ফলমূল, নদ-নদীর আধিক্য ও বহু নবীর বাসস্থান হওয়ার কারণে বরকতময় ও কল্যাণময় বলা হয়েছে।
৩. ‘যে সম্প্রদায়কে (মুসা ও বনি ইসরাইলকে) দুর্বল মনে করা হতো, তাদের আমি আমার কল্যাণপ্রাপ্ত রাজ্যের পূর্ব ও পশ্চিমের উত্তরাধিকারী করি; এবং বনি ইসরাইল সম্বন্ধে তোমার প্রতিপালকের শুভ বাণী সত্যে পরিণত হলো, যেহেতু তারা ধৈর্য ধারণ করেছিল।’ (সুরা : আরাফ, আয়াত : ১৩৭) এখানে শাম বা সিরিয়া ও মিসর ভূমির কথা বলা হয়েছে, যাতে আল্লাহ তাআলা কওমে ফিরআউন ও কওমে আমালেকাকে ধ্বংস করার পর বনি ইসরাইলকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং শাসনক্ষমতা দান করেছিলেন।
৪. ‘এবং সুলায়মানের বশীভূত করে দিয়েছিলাম উদ্দাম বায়ুকে; সে তার আদেশক্রমে প্রবাহিত হতো সেই ভূখণ্ডের দিকে, যেখানে আমি কল্যাণ রেখেছি; প্রত্যেক বিষয় সম্পর্কে আমিই সম্যক অবগত।’ (সুরা : আম্বিয়া, আয়াত : ৮১) কল্যাণময় ভূখণ্ড বলতে শামকে (ফিলিস্তিন ও সিরিয়া) বোঝানো হয়েছে।
৫. ‘ওদের (সাবা সম্প্রদায়) ও যেসব জনপদের প্রতি আমি অনুগ্রহ করেছিলাম সেগুলোর মধ্যবর্তী স্থানে দৃশ্যমান বহু জনপদ স্থাপন করেছিলাম এবং ওই সব জনপদে ভ্রমণের যথাযথ ব্যবস্থা করেছিলাম এবং ওদের বলেছিলাম—তোমরা এসব জনপদে নিরাপদে ভ্রমণ করো দিনে ও রাতে।’ (সুরা : সাবা, আয়াত : ১৮)
এ জনপদ বলতে মুলকে শাম বোঝানো হয়েছে। প্রাচীন শামদেশ হলো বর্তমান সিরিয়া, জর্দান, লেবানন ও ঐতিহাসিক ফিলিস্তিন। আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, এই জনপদ হলো বায়তুল মুকাদ্দাস। (রুহুল মাআনি, ২২/১২৯) এভাবে কোরআনুল কারিমে বায়তুল মুকাদ্দাস ও ফিলিস্তিন অঞ্চলের অসামান্য মর্যাদা ও বৈশিষ্ট্যময় হওয়ার বিষয়টি অলোচিত হয়েছে। কাজেই তা মুসলমানদের অনুরাগ ও ভালোবাসার উৎস এবং প্রাণের চেয়ে প্রিয় বস্তুতে পরিণত হবে—এটাই স্বাভাবিক।
লেখক : ড.আবু সালেহ মুহাম্মদ তোহা, সহযোগী অধ্যাপক,আরবি বিভাগ,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
২২ অক্টোবর ২০২৩
এ জি