পদ্মা-মেঘনায় ফের ঢেউ তুলবে প্যাডেল স্টিমার

আবারও পদ্মা-মেঘনা-কীর্তনখোলার বুক চিরে ফেনিল জলরাশির ঢেউ তুলে চলবে ঐতিহ্যের প্যাডেল স্টিমার। যাত্রী নিয়ে রাজধানী ঢাকা থেকে ছুটবে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের বিপৎসঙ্কুল নৌপথে। এমনই আশার কথা শুনিয়েছেন নৌপরিবহন উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। গত সপ্তাহে বরিশাল সফরকালে এ কথা বলেছেন তিনি। বলেছেন, অক্টোবরে তিনি নিজে এই স্টিমারে চেপে আসবেন বরিশালে। যে স্টিমার সার্ভিস বন্ধ রয়েছে ১০৮৯ দিন ধরে।

একসময় ঢাকা-বরিশাল-খুলনা নৌপথে যাত্রী পরিবহণ করত বিআইডব্লিউটিসির প্যাডেল স্টিমার। যাত্রা শুরুর সময়ে এটি ছিল নৌপথে উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম। নদী পথের নিরাপদ যান হিসাবে এর কদরও ছিল ব্যাপক। প্রচলিত ধারার বাইরে পেছনে প্রপেলারের জায়গায় এই নৌযানের বিশাল দুটি প্যাডেল টাইপ বাহু রয়েছে জাহাজের দুই পাশে। প্যাডেল ঘুরে পানি ঠেলে জাহাজ এগিয়ে চলে সামনে। পেছনে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই প্যাডেলই আবার ঘোরে উলটো দিকে। দুই পাশের বিশাল দুটি প্যাডেল পানি কেটে এগিয়ে নেয় বলেই বরিশালসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলে এর পরিচিতি প্যাডেল স্টিমার বা সংক্ষেপে পিএস হিসাবে। জাহাজের নামের আগে বসে এই সংক্ষিপ্ত শব্দ দুটি। দুই পাশে থাকা প্যাডেলের মাধ্যমে চলাচল করায় ঝড়-ঝঞ্ঝাসহ যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে খুব সহজেই চলাচল করত এটি। বিগত প্রায় দেড়শ’ বছরে একবারও প্রাকৃতিক দুর্যোগে দুর্ঘটনায় পড়ার ইতিহাস নেই এই নৌযানের।

দেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশি পর্যটকদেরও একমাত্র নির্ভরযোগ্য নৌযান ছিল এই স্টিমার। বরিশালের প্রবীণ সংবাদকর্মী এবং ইতিহাসবিদ নাসিম উল আলম জানান, ‘১৮৮৭ সালে প্রথম নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদীর তীর থেকে বরিশাল-খুলনাসহ দক্ষিণ উপকূলের বিভিন্ন এলাকার উদ্দেশে শুরু হয় প্যাডেল স্টিমারের চলাচল। পরবর্তীতে রাজধানী ঢাকার বাদামতলী ঘাট থেকে যাত্রী পরিবহণ শুরু করে এটি। ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রিভার স্টিম কোম্পানি সংক্ষেপে আই.জে.এন.আর.এস স্টিমারগুলো বাংলাদেশে আনে। তখন এগুলো চলত কয়লা পোড়ানো বাষ্পীয় শক্তিতে। টানা ৯০ বছর এভাবে চলার পর বাষ্পীয় ইঞ্জিনের প্রচলন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ১৯৭৮ সালে এসব স্টিমারে শুরু হয় ডিজেল ইঞ্জিনের ব্যবহার।

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বেলজিয়াম সরকারের কাছ থেকে আনা আর্থিক সহযোগিতায় প্যাডেল স্টিমারগুলোকে বাষ্পীয় থেকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তরিত করেন। সে সময় এই প্যাডেল স্টিমারের বহরে ছিল ৬টি জাহাজ। এগুলো হলো পিএস টার্ন, পিএস মাহ্সুদ, পিএস কিউই, পিএস লেপচা, পিএস গাজী এবং পিএস অস্ট্রিচ। এ সবগুলো জাহাজকেই একে একে পরিণত করা হয় ডিজেলচালিত নৌযানে। এর মধ্যে দ্রুত চলাচলের যোগ্যতায় বহরের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্টিমার ছিল গাজী। কিন্তু ১৯৯৮ সালে ঢাকায় মেরামতে থাকাবস্থায় রহস্যজনক অগ্নি দুর্ঘটনায় চলাচলের অযোগ্য হয়ে যায় এটি। বর্তমানে বহরে থাকা জাহাজগুলোর মধ্যে পি.এস অস্ট্রিচকে করা হয়েছে ভাসমান রেস্তোরাঁ। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে আসা বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান এবং কূটনীতিকসহ বিদেশি পর্যটকদের নৌবিহারে ব্যবহার করা হয় এটি। বাকি জাহাজগুলো পড়ে আছে নৌরুটে চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকেই।’

যাত্রী সংকটের কারণ দেখিয়ে ২০২২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর বন্ধ করে দেওয়া হয় রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বরিশালসহ দক্ষিণ উপকূলের যোগাযোগের অন্যতম জনপ্রিয় এই স্টিমার সার্ভিস। প্রথমে ঢাকা থেকে বরিশাল হয়ে খুলনা পর্যন্ত এই স্টিমার চললেও পরে নাব্য সংকটসহ যাত্রী না পাওয়ার অজুহাতে স্টিমার যেত বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ পর্যন্ত। এই রুটের নিয়মিত যাত্রী ঝালকাঠীর বশিরুল ইসলাম বলেন, ‘গন্তব্যে পৌঁছতে প্রচুর দেরি করতো স্টিমার। যাত্রী সেবার মানও নেমে গিয়েছিল একেবারে তলানিতে। যে কারণে এই সার্ভিসের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় মানুষ।’

কাউখালীর বাসিন্দা আহসান মুন্সি বলেন, ‘এখনো নিরাপদ নৌ-যাত্রা বলতে আমরা স্টিমারকেই বুঝি। নির্ধারিত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছা আর যাত্রী সেবার মান বাড়ালে খুব ভালোভাবেই চলবে এই স্টিমার সার্ভিস।

বিআইডব্লিউটিসি বরিশাল দপ্তরের কর্মকর্তা জুয়েল কুমার দাস জানান, ‘বর্তমানে বহরে ব্রিটিশ আমলের ৪টি চলাচল উপযোগী প্যাডেল স্টিমার রয়েছে। এগুলো হচ্ছে পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহ্সুদ, পিএস লেপচা এবং পিএস টার্ন। এই স্টিমারগুলোই নতুন করে সার্ভিসে যুক্ত হবে। আপাতত পিএস অস্ট্রিচ এবং পিএস মাহ্সুদকে প্রস্তুত করা হচ্ছে সার্ভিসে ফেরার জন্য। চাহিদা বৃদ্ধি পেলে বাকিগুলোকেও নদীতে নামানো হবে। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আর মাসখানেকের মধ্যেই নদীর বুক চিরে রাজহংসের মতো চলবে দেড়শ’ বছরের পুরোনো ঐতিহ্যবাহী প্যাডেল স্টিমার।

চাঁদপুর টাইমস ডেস্ক/ ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫