চাঁদপুর

গবেষকদের চোখে পদ্মা-মেঘনায় কমে যাচ্ছে ইলিশ উৎপাদন

দেশের সর্বদক্ষিণের শেষ সীমা নিঝুম দ্বীপের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা নদী। এরপরই বঙ্গোপসাগরের মোহনা। দ্বীপের কোল ঘেঁষে শত শত জেলেনৌকার প্রস্তুতি, এগুলো সাগরে যাবে ইলিশ ধরতে। সাগর থেকে ইলিশের দল এই পথ দিয়ে মেঘনা হয়ে ভোলা-চাঁদপুর-শরীয়তপুরের পাশের নদীগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে।

গত বছর দেশে ইলিশের যে রেকর্ড উৎপাদন হয়েছিল, তার বেশির ভাগই এই বিস্তীর্ণ এলাকা থেকে এসেছে। তবে সাগরের মোহনা ও মেঘনা অববাহিকায় ইলিশ ধরার এই সাফল্যের সঙ্গে পদ্মায় ইলিশ কমে যাওয়ার বেদনাও অবশ্য যোগ হয়েছে।

গত দুই বছরের ব্যবধানে প্রাকৃতিক উৎসের মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ চতুর্থ থেকে তৃতীয় স্থানে উঠে এসেছে। এর পেছনে মূলত ইলিশের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল বলে গবেষকেরা মনে করছেন।

মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে গত বছর দেশে ইলিশের উৎপাদন হয়েছিল ৫ লাখ ১৭ হাজার টন, যার মধ্যে পদ্মার অবদান ছিল সাড়ে ৩ হাজার টন। গত দেড় যুগে ইলিশের মোট উৎপাদন প্রায় তিন গুণ বাড়লেও পদ্মার অবদান কমছে।

ইলিশ উৎপাদনে পদ্মার অবদান কম হওয়ার কারণ খুঁজতে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়, মাছবিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ফিশ এবং ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়া তেরেঙ্গানুর ছয়জন গবেষক বাংলাদেশের ইলিশের নদীপ্রবাহভিত্তিক ভিন্নতা ও তাদের প্রজনন-বিচরণ ক্ষেত্রের ধরন নিয়ে গবেষণা করেছেন। গবেষণার জন্য দেশের ছয়টি নদী থেকে ৯০০ ইলিশ সংগ্রহ করে ডিম পরীক্ষা করা হয়। আর নদীতে প্রায় ২০ হাজার ইলিশ পর্যবেক্ষণ করা হয়।

গবেষকেরা বলছেন, সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী ইলিশের ডিম পাড়া নির্বিঘ্ন করতে এবং মা মাছ ধরা বন্ধে বছরের ৭ থেকে ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত ২২ দিন ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ থাকে। এই সময়ে বঙ্গোপসাগরের মোহনা ও মেঘনায় মা ইলিশের ডিম পাড়ার হার ৫৯ শতাংশ, সেখানে পদ্মায় ১৩ শতাংশ। কিন্তু ১০ নভেম্বরের মধ্যে ৮০ শতাংশ পদ্মার ইলিশ ডিম ছাড়ছে। ওই সময়ে ইলিশ ধরায় কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় ডিমওয়ালা এসব মাছ ধরা পড়ছে। পদ্মার ইলিশ কমে যাওয়ার পেছনে এটি বড় কারণ হিসেবে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গবেষণাটি মৎস্য অধিদপ্তর এবং ওয়ার্ল্ড ফিশের যৌথ উদ্যোগ ইকো ফিশ, বাংলাদেশ প্রকল্পের আওতায় হয়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও ইকো ফিশ প্রকল্পের প্রধান আবদুল ওয়াহাব প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের নানা উদ্যোগের কারণে দেশের ইলিশের উৎপাদন ব্যাপক হারে বেড়েছে। একসময় ইলিশ ধনীদের মাছ হিসেবে পরিচিত হলেও এখন তা মধ্যবিত্তের নাগালের মধ্যে। কিন্তু সব ধরনের মানুষের ক্রয়ক্ষমতার আওতায় আনতে হলে ইলিশের উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। তাই পদ্মার ক্ষেত্রে ইলিশ ধরায় নিষেধাজ্ঞার সময়কাল নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে।

এ ছাড়া পদ্মায় দূষণ ও ইলিশের বিচরণের পথ পলি পড়ে ভরাট হয়ে গেছে। ফলে সেখানে ইলিশের উৎপাদন কম হচ্ছে বলেও গবেষকেরা মনে করছেন।

একদল গবেষকের হাতে ইলিশ।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান বলেন, ‘বিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং তাঁদের পরামর্শকে আমলে নিয়ে আমরা দেশের ইলিশ রক্ষায় অনেকগুলো উদ্যোগ নিয়েছি, যার সফলতা হিসেবে দেশে ইলিশের উৎপাদন বেড়েছে। পদ্মায় ইলিশ যদি নভেম্বরে ডিম পাড়ে, তাহলে আমরা অবশ্যই ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞার সময়কাল পদ্মার ক্ষেত্রে নভেম্বরে করব। আমাদের গবেষকদের মাধ্যমে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে তারপরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।’

তিন ধরনের ইলিশ তিন এলাকায় ডিম পাড়ে

ওই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা ইলিশের তিনটি জাত চিহ্নিত করেছেন। বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন, পদ্মা ও যমুনা, মেঘনা ও কুশিয়ারা এবং বঙ্গোপসাগর ও তার মোহনা এলাকার ইলিশ জিনগতভাবে আলাদা। তারা নিজেদের এলাকা ছাড়া অন্য কোথাও ডিম পাড়ে না, বড় হয় না। জাটকা থেকে পরিণত হওয়ার পর তারা সাগরে চলে যায়। ডিম পাড়ার সময় হলে তারা আবার নদীতে ফিরে আসে। এক নদীর মাছ অন্য নদীতে যায় না।

গবেষণাটিতে আরও দেখা গেছে, মেঘনা ও বঙ্গোপসাগরের মোহনায় এসে ইলিশের ডিম পাড়ার দুই সপ্তাহ পর পদ্মার ইলিশ তার জন্মভূমি পদ্মায় পৌঁছায়। আর সেখানে ডিম পাড়ে।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে ওই গবেষক দলের অন্যতম সদস্য ও চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সমুদ্র থেকে স্রোতের উল্টো পথে সাঁতার কেটে পদ্মার ইলিশ ডিম পাড়তে পদ্মায় পৌঁছায়। সেখানকার ঘোলা পানি ও জৈব উপাদান খাবার হিসেবে পাওয়ায় এদের স্বাদ অনেক ভালো হয়। পুষ্টিমানও বেশি। আমাদের গবেষণায় পদ্মার ইলিশের উৎপাদন কীভাবে বাড়ানো সম্ভব, তা বের করেছি।’

বার্তা কক্ষ
২৫ জানুয়ারি, ২০১৯

Share