এ ছাত্রীর নাম বাছিরন নেছা, বয়স ৬৩ বছর। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, এ বয়সে বিদ্যালয়ের ৫ম শ্রেণির ছাত্রী হিসেবে তার রোল ৪। প্রথম শ্রেণি থেকে ক্রমান্বয়ে পাস করে তিনি ৫ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হন।
সাধারণ আর দশজন নারী এমন বয়সে নাতি-নাতনির সঙ্গে ঘরে শুয়ে-বসেই সময় কাটান। কিন্তু বাছিরন ব্যতিক্রম, এই বয়সে তিনি প্রতিদিন বিদ্যালয়ে যাচ্ছেন সহপাঠীদের সঙ্গে।
শিক্ষিত হওয়ার অদম্য বাসনা হার মানিয়েছে তার বয়স ও লোকলজ্জাকে। মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়েন তিনি।
হোগলবাড়িয়া গ্রামের মৃত রহিল উদ্দীনের স্ত্রী বাছিরন। বাবার বাড়িও একই গ্রামে। প্রায় ৩৫ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। এরপর দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে অভাব অনটনের মধ্যে দিয়ে দিনযাপন করতে হয়েছে তাকে। এখন তার সুখের সংসার; সন্তানরা বড় হয়ে গেছে।
ছেলে-মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। বড় মেয়ে ও ছেলের ঘরে দু’টি করে সন্তান। আর ছোট মেয়ের একটি সন্তান। ছেলে মহির উদ্দীনের সঙ্গে বসবাস করছেন তিনি।
এখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী বাছিরন নেছার একটিই স্বপ্ন; প্রাথমিকের গণ্ডি পেরিয়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পা দেওয়া। অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইউনিফর্ম পরেই যাবে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে।
এই বয়সে লেখাপড়া করা নিয়ে কটাক্ষ শুনতে হয়নি তাকে। পরিবার ও প্রতিবেশীরা তার এই পথচলায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।
সম্প্রতি এক দুপুরে হোগলবাড়িয়া পূর্বপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, টিফিন পিরিয়ডে বাছিরন নেছা তার সহপাঠীদের সঙ্গে কপাল টিক্কা (চোখে হাত চেপে ধরে কপালে টোকা দেওয়া খেলা) খেলায় ব্যস্ত। সহপাঠী সিয়াম, নাজমা, আঁখি, মাধবীসহ ১০-১২ জন দুই ভাগে ভাগ করে খেলছে। ক্লাসের ঘণ্টা পড়তেই সবার সঙ্গে ছুটে গেলেন শ্রেণিকক্ষে।
তখন ক্লাস নিচ্ছিলেন সহকারী শিক্ষিক আনারকলি। তিনি জানান, বাছিরন নেছা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের মতোই আমাদের সঙ্গে আচরণ করেন। নিয়মিত ক্লাসে আসেন। কখনো স্কুল ফাঁকি দেন না। দ্বিতীয় শিফটে সকাল ১০ টার সময় তার ক্লাস শুরু হলেও বাছিরন বিদ্যালয়ে আসেন সকাল ৯টায়। তাকে পড়া ধরতেই হবে। পড়া না ধরলে বলেন, ম্যাডাম আমাকে পড়া ধরেন। সামনে সমাপনী পরীক্ষার জন্য অন্য শিক্ষার্থীদের মতো তিনিও প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
বাছিরন বলেন,‘অভাবের কারণে আমি ও আমার কোনো ছেলে-মেয়ে পড়ালেখা শিখতে পারিনি। এনিয়ে মনে কষ্ট ছিল। মনে জেদ ছিল নাতি-নাতনিদের সঙ্গে হলেও লেখাপড়া শিখবো। এজন্য পাঁচ বছর আগে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলাম। এখন পড়ছি পঞ্চম শ্রেণিতে। দ্বিতীয় শ্রেণিতে ছয়, তৃতীয় শ্রেণিতে পাঁচ এবং চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণিতে আমার রোল নম্বর হয় চার।’
আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখলে কলেজেও পড়বো। আমার ছেলের বউ জাহানারা খাতুন লেখাপড়ার ব্যাপারে অনেক সহযোগিতা করে। ছেলে মহির উদ্দীন আর তার ছেলে অনার্স পড়ুয়া জসিমও আমাকে উৎসাহ দেয়, বলেন বাছিরন।
তার সহপাঠী সিয়াম ও আঁখি জানায়, বাছিরন তাদের বান্ধবী। তাকে ক্লাসের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীরা নাম ধরে ডাকে। তাতে রাগ করেন না তিনি। তাদের তিনি বলেন, আমি তো তোমাদের বান্ধবী। বাছিরন তাদের বলেন, তোমাদের কোনো পড়া না হলে আমার কাছ থেকে জেনে নেবে। আর আমার পড়া না হলে তোমাদের কাছ থেকে জেনে নেবো। তাহলে সবারই পড়া হয়ে যাবে। তিনি অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলেন।
বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দীন আহমেদ বাংলানিউজকে বলেন, বাছিরন নেছার লেখাপড়া নিয়ে তার পরিবারের সদস্য ও প্রতিবেশীরা উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছেন। আমার বিশ্বাস, তিনি সমাপনী পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করবেন। তার হাতের লেখাও খুব সুন্দর।
বাছিরনের ছেলে ও পুত্রবধূ জানান, ‘তাদের দুই ছেলে আর মাকে ধরে তিন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করেন। তাই তাদের জন্য সকালে খাবার তৈরিসহ অন্যান্য সহযোগিতা করেন তারা। মায়ের লেখাপড়া করার বিষয়টি নিয়ে তারা গর্ববোধ করেন।’
ওই গ্রামের কাকলী খাতুন ও ববিতা খাতুন জানান, এ বয়সে লেখাপড়া করা বিরাট ব্যাপার। বাছিরন লেখাপড়ার গুরুত্ব অনুধাবন করে এ বয়সেও স্কুলে যাচ্ছেন দেখে প্রতিটি বাবা-মা তাদের সন্তানের লেখাপড়ার প্রতি যত্নশীল হচ্ছে। তার লেখাপড়া এখন আমাদের সন্তানদের শিক্ষিত করার অনুপ্রেরণা যোগাচ্ছে। (উৎস- বাংলানিউজ)
নিউজ ডেস্ক : আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৪:০০ পিএম, ৯ নভেম্বর ২০১৬, বুধবার
ডিএইচ