বর্ষা মৌসুমে নৌকা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে চাঁদপুরের মতলব উত্তর উপজেলার সটাকী বাজারের নৌকার কারিগর ও কাঠ ব্যবসায়ীরা। নতুন নৌকা তৈরির যেমন ধুম পড়েছে আবার অনেকেই পুরনো নৌকা মেরামতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।
বর্ষা মৌসুমে নিচু এলাকার বাসিন্দাদের যোগাযোগের মাধ্যম হয়ে ওঠে নৌকা। চারদিকে বর্ষায় যখন রাস্তাঘাট তলিয়ে যায়, তখন নৌকা, কলাগাছের ভেলা হয়ে ওঠে পারাপারের ভরসা। এ কারণে জ্যৈষ্ঠের শুরু থেকেই বিভিন্ন গ্রামে নৌকা তৈরির কাজ শুরু হয়ে গেছে। তবে চলতি বর্ষা মেসৈুমে বৃষ্টি না হওয়াতে পানি কম হওয়ায় এবার গত বছরের চেয়ে নৌকা বেচা-বিক্রি কিছুটা কম। ব্যস্ততাও গত বছরের তুলনায় অনেকটা কম। নৌকার দাম গতবারের চেয়ে একটু কম বলে জানিয়েছেন কারিগররা।
উপজেলার সটাকী বাজার কাঠপট্টির কারিগররা নৌকা তৈরিতে এখন বেশ ব্যস্ত। দিনরাত নৌকা তৈরি করছেন তারা।
আশপাশের জেলাগুলোতে বর্ষা মৌসুমে নৌকার কদর অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। বিশেষ করে কৃষকদের কাছে। ধানকাটা, বাগান থেকে পেয়ারাসহ, বিভিন্ন ফসল সংগ্রহ এবং বাজারজাত করার কাজে নৌকার বিকল্প নেই। ওইসব জেলার মানুষজন দুই শতাধিক বছরের পুরনো মতলবের নৌকার হাট সটাকী বাজারে নৌকা কিনতে আসে। বিশেষ করে উপজেলার মেঘনা-ধনাগোদা বেরীবাধ এর বাহিরে শিকিরচর,সুগন্ধি,সটাকী,দশানী,মোহনপুরমএখলাছপুর,সানকিভাঙ্গা, চরকাশিম,বোরচর,চর উমেদ,বাহেরচর,সহ মেঘনা-পদ্মার তীরবর্তী গজারিয়া,কালিচর,মুন্সিীগঞ্জর এখানকার নৌকা ব্যবহার হয়ে থাকে। তারা এখানে অন্যান্য নৌকার হাট থেকে এখানে সুলভ মূল্যে রেডিমেট নৌকা কিনতে পারে বিধায় এখানে জমজমাট নৌকার হাট।
আর এ বাড়তি চাহিদার জোগান দিতে নৌকা তৈরির কারিগররা দিন-রাত শ্রম দিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু কাঠসহ নৌকা তৈরির উপকরণের দাম বেড়ে যাওয়ায় নৌকা তৈরিতে খরচও বেড়েছে। তবে সে তুলনায় নৌকার দাম বাড়েনি বলে জানান কারিগররা। নিজস্ব পুঁজি না থাকায় দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে উপকরণ কিনতে হয়। যে কারণে তারা তেমন দাম পায় না। উপজেলার বৃহত্তম নৌকারহাট সটাকী বাজারসহ আশপাশের বিভিন্ন নৌকা বিক্রির হাটগুলো এখন ক্রেতা-বিক্রেতা সমাগমে সরগরম হয়ে উঠেছে।
উপজেলার সটাকী বাজারের ব্যবসায়ী দুলাল প্রধান (৫৫) বলেন,‘আমি দীর্ঘ ৪০বছর যাবত কাঠ ব্যবসা এই নৌকা তৈরি ব্যবসায় জািড়ত । আমি প্রথমে এই সটাকী বাজারে প্রথম নৌকা বানাই এবং বিক্রি করি। এছাড়া আমি বিভিন্ন হাটে বিক্রির উদ্দেশ্যে কমদামি খাট, চৌকি, দরজা, জানালা তৈরি এবং পাইকারি কাঠ বিক্রি করি। আর বর্ষা এলে নৌকা বানাই। এ সময় আমার কারিগররা দম ফেলার সময় পায় না। আমার একজন কারিগর দিনে একটা নৌকা বানায়। সারা সপ্তাহে যা নৌকা বানানো হয় খুচরা দুই-একটা বিক্রি ছাড়া সব নৌকা বিক্রি হয়ে যায় সাপ্তাহিক হাটের দিন শনিবার ও মঙ্গলবার। এ হাটে ৮-১০টি নৌকা বিক্রি করতে পারি। পানি বাড়লে বিক্রি বাড়বে।
মতলবের বেরী বাধের বাহিরে যেসকল অঞ্চল রয়েছে এসব এলাকা এবং পাশের জেলা মুন্সীগঞ্জেরর লোকজন এসেও এখান থেকে নৌকা কিনতে আসে।
এবার ৮ থেকে ১০ হাত দৈর্ঘ্যরে নৌকা চার-পাঁচ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। নৌকা বড় হলে দামও বাড়ে। তবে অন্য বছরের তুলনায় এবার পানি কম থাকায় নৌকা বিক্রি কম। তাই আমরা নৌকা প্রতি ৪০০-৫০০ টাকা কমেই বিক্রি করছি।
একই বাজারের নৌকা তৈরির কারিগর বাবু মিয়া বলেন, আমি সটাকী বাজারে কাঠ ব্যবসা ও নৌকা তৈরি করি ২০ বছর ধরে। বরিশাল থেকে বিভিন্ন জাতের কাঠ এনে এ বাজারে পাইকারী ও খুচরা বিক্রি করি। তবে বছরে দুই মাস নৌকা বানাই। বর্ষাকালে ঘরের কাজ একটু কম থাকে। এ সময়টাতে কাঠ একটু কম বেচা হয়। তাই বিকল্প হিসেবে নৌকা বানাই।
প্রতি বর্ষা আসলেই আমাদের নৌকা ব্যবসা অনেক ভালো হয়। তবে এবার বৃষ্টিা না হওয়ায় পানি কম থাকাতে বর্সার শুরুতে নৌকা বিক্রি তেমন জমে উঠেনি। তবে গত দু’দিন ধরে পানি একটু বৃষ্টি পাওয়ায়াতে নৌকার চাহিদা বেড়েছে। আশা করি এখন বাজার ভালো যাবে।
বাবু মিয়া জানান, ১২ হাত থেকে ১৪ হাত নৌকা বিক্রি করছি ১৩ হাজার,১২ হাজার ও ১০ হাজার টাকায় বিক্রি করছি। আর ১০ হাত, ১১ হাত নৌকা বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা ৬ হাজার টাকায়। পানি না হওয়ায় নৌকার দাম এবার ভালো পাচ্ছিনা। প্রতি নৌকায় পাঁচশত (৫০০) টাকা থেকে এক হাজার টাকা ব্যবসা হয় তার। তিনি জানান আমরা তিনজনে মিলে কাজ করি। প্রতি দিন ২ থেকে ৩টি নৌকা বানানো যায়। দুই দিনে দুইজনে ৬-৭টি নৌকা বানানো সম্ভব।
পাশের দোকানের নৌকা তৈরির কারিগর বিল্লাল বলেন, বর্ষা মৌসুমের এই দুই-তিন মাস আমরা প্রতিদিন গড়ে হাজার টাকা আয় করতে পারি। কাজেও ঝুঁকি কম।
মোহনপুর ইউপির বাহাদুরপুর গ্রামের ইউপির সদস্য আলমগীর কবিরাজ বলেন, বর্ষা মৌসুমে নৌকার চাহিদা বাড়ে। আর নিচু এলাকার মানুষের বর্ষায় যাতায়াতের একমাত্র ভরসা নৌকা। তাই বর্ষার আগেই কেউ কেউ নৌকা কিনে রাখছেন। বর্ষায় চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে দামও বেড়ে যায়। তবে এবার পানি কম হওয়াতে নৌকার চাহিদা আগের মতো নেই। গত দু’দিন বৃষ্টি হওয়াতে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে তাই ক্রেতারা এখন নৌকা কিনতে ভীড় করছেন। আবার কেউ পুরনো নৌকা মেরামত শুরু করেছেন।
প্রতিবেদক: খান মোহাম্মদ কামাল, ৩ আগস্ট ২০২৩