আন্তর্জাতিক

নেড়ি কুকুরই আগলে রাখলো ফেলে দেয়া সন্তানকে

২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবসে ছেলের জন্ম৷ তার আগেই অবশ্য নাম ঠিক করে ফেলেছিলেন মা৷ অনিকেত৷ তবে নামের মানেটা জানতেন না বাবা-মা কেউই৷ গত শুক্রবার রাতের অন্ধকারে দুধের শিশুকে মা-বাবা যখন ট্রেনের কামরায় ফেলে চলে যান, তখন আক্ষরিক অর্থেই ঘরছাড়া হয়েছিল অনিকেত৷ কিন্ত্ত এক সপ্তাহের মাথায় ফের নিজের ঠিকানা খুঁজে পেল পরিত্যক্ত সেই শিশু৷

গত শনিবার ডায়মন্ড হারবার স্টেশনের লোকাল ট্রেনের কামরায় ৯ মাসের অনিকেতকে ফেলে গিয়েছিলেন উত্তর ২৪ পরগনার ঘোলা থানার নাটাগড় তরুণপল্লির বাসিন্দা ভোলানাথ নন্দী ও তাঁর স্ত্রী সোমা৷ বছর দুয়েক আগে প্রেম করে বিয়ে করার সময় তরুণ এই দম্পতি ভাবতেও পারেননি তাঁদের প্রথম সন্তানের জীবনে এত বড় ট্র্যাজেডি নেমে আসবে৷

জন্মের ২৩ দিনের মাথাতেই ধরা পড়ে অনিকেতের দু’টি চোখেই সমস্যা৷ একটি চোখে টিউমার এবং আর একটি চোখের রেটিনা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় দৃষ্টিশক্তিহীন হয়ে পড়ে সে৷ সন্তানের চিকিত্সায় নিম্ন মধ্যবিত্ত দম্পতি সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েন গত কয়েক মাসে৷ শেষ পর্যন্ত চিকিত্সার খরচ চালাতে না পেরেই গত শুক্রবার ছেলেকে নিয়ে ডায়মন্ড হারবারে চলে যান ভোলানাথ ও সোমা৷ নদীর জলে ভাসিয়ে দিতে৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত সে কাজ আর করে উঠতে পারেননি তাঁরা৷ দিনভর নানা জায়গায় ঘুরেও অসহায়, দৃষ্টিহীন ছেলেকে কোলছাড়া করতে পারেননি মা৷

রাত বাড়তে ডায়মন্ড হারবার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে আশ্রয় নেন তাঁরা৷ ফাঁকা স্টেশনে অনিকেতকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন ভোলানাথ ও সোমা৷ ভোরের আলো ফোটার আগেই প্ল্যাটফর্মের পাশে কারশেডে দাঁড়িয়ে থাকা রাতের শেষ ডাউন ডায়মন্ড হারবার লোকালের একেবারে পিছনের কামরার কোণের সিটে ঘুমন্ত ছেলেকে শুইয়ে দেন মা৷ পাশে যত্ন করে গুছিয়ে দেন তার জামাকাপড়, শীতের পোশাক, দুধের বোতল, ওষুধপত্র৷ আশা ছিল হয়তো কেউ আশ্রয় দেবে তাঁদের সন্তানকে৷

তবে মানুষের নজরে পড়ার আগে অনিকেতকে রাতভর আগলে রাখে স্টেশনেরই একটি নেড়ি কুকুর৷

সংবাদ মাধ্যমে এই খবর প্রকাশ হওয়ার পর তা নজরে আসে নাটাগড়ে ভোলানাথের প্রতিবেশীদের৷ সন্দেহ হওয়ায় ওই দম্পতির কাছে ছেলের খোঁজখবর নেন তাঁরা৷ শুক্রবার সেই খবর চোখে পড়ে সোমার মায়েরও৷ তার পরই থানায় মিসিং ডায়েরি করতে যান পরিবারের সদস্যরা৷ শনিবার সকালে প্রতিবেশীদের সঙ্গে ডায়মন্ড হারবারে দক্ষিণ ২৪ পরগনা চাইল্ড লাইনের অফিসে আসেন ভোলানাথ ও সোমা৷ ছেলের জন্মের সার্টিফিকেট-সহ চিকিৎসার বিভিন্ন নথিপত্র জমা দিয়ে একমাত্র সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আবেদন জানান তাঁরা৷ কিন্ত্ত আইনের জটিলতায় কবে অনিকেত বাবা-মায়ের কোলে ফিরবে তা স্পষ্ট নয়৷ জেলা চাইল্ড লাইন কমিটির নির্দেশে শিশুটি আপাতত লক্ষ্মীকান্তপুরের একটি হোমে রয়েছে৷

শনিবার সকালে চাইল্ড লাইনের অফিসে ছেলের অন্নপ্রাশনে তোলা একটি ছবি নিয়ে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন ওই দম্পতি৷ জানা গিয়েছে স্কুলে পড়তে পড়তেই পাশের মল্লিকপাড়ার সোমার প্রেমে পড়েন তরুণপল্লির বাসিন্দা ভোলানাথ৷

দু’বছর আগে বিয়ে করেন বছর পঁচিশের ভোলানাথ ও তেইশ বছরের সোমা৷ উচ্চমাধ্যমিক পাশ ভোলানাথ রাতে সামান্য মাসোহারায় কেটারিংয়ের কাজ করেন৷ আর সকালে ঘোলা বাজারে অন্যের দোকানে সবজি বিক্রি করেন৷ বিয়ের বছর ঘুরতেই অনিকেতের জন্ম৷ কিন্ত্ত জন্মের পর থেকেই নানাবিধ শারীরিক সমস্যা দেয় অনিকেতের৷ কামারহাটির সাগর দত্ত হাসপাতালে চিকিত্সকেরা জানিয়ে দেন শিশুটির বাঁ চোখে দু’টি টিউমার রয়েছে ও ডান চোখের রেটিনায় সমস্যা রয়েছে৷ চিকিত্সার প্রচুর খরচ জেনেও পিছু হঠেননি মা-বাবা৷ কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরতে থাকেন তাঁরা৷ একাধিকবার হায়দ্রাবাদের একটি নামী চোখের হাসপাতলেও নিয়ে গিয়ে ব্যয়বহুল চিকিত্সা করান৷

কাঁদতে কাঁদতে ভোলানাথ এ দিন বলেন, ‘হায়দ্রাবাদে ডাক্তারবাবুকে বলি দরকার হলে আমাদের চোখের রেটিনা নিয়ে ছেলেকে সুস্থ করে দিন৷ কিন্ত্ত ওঁরা জানিয়ে দেন তা হবে না৷ এই কয়েক মাসে লাখ দুয়েক টাকা খরচ করে ফেলেছি৷ ধারদেনা করেও ছেলেকে সুস্থ করতে চেয়েছিলাম৷ কিন্ত্ত শেষ পর্যন্ত পারিনি৷ ওকে ফেলে আসার পর একটা রাতও চোখের পাতা এক করতে পারিনি আমরা৷’

অনিকেতের মাসি প্রীতি দেবনাথ বলেন, ‘ছেলের অসুখেই ওদের মাথা খারাপ হয়ে গেল৷ আমি বোনকে বলেছিলাম তোরা না পারলে ছেলেটাকে আমি মানুষ করব৷ কিন্ত্ত আমরা জানতেও পারিনি ওরা এমন অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে৷’

ভোলানাথ বলেন, ‘ছেলের চিকিত্সার খরচ চালাতে গিয়ে বাজারে অনেক ধার হয়েছে আমার৷ ডাক্তাররাও আর ভরসা দিচ্ছিলেন না৷ উপায় না দেখে কয়েক মাস আগে কলকাতার একটি মিশনে নিয়ে গিয়েছিলাম ছেলেকে৷ ওকে দেখে অনেকেই দত্তক নিতে আগ্রহ দেখাল৷ কিন্ত্ত ছেলে চোখে দেখে না শুনে সবাই পিছিয়ে গেল৷’ পরিবারের লোকজনকে না জানিয়েই গত ২৭ নভেম্বর সকালে অনিকেতকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হন ভোলানাথ ও সোমা৷ পরদিন সকালে ফিরে এসে বাড়িতে জানান ছেলেকে হোমে রেখে এসেছেন৷

কিন্ত্ত ট্রেনের কামরায় অনিকেতের উদ্ধার হওয়ার খবরটি পরপর তিনদিন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হতে দেখে সন্দেহ হয় তাঁদের প্রতিবেশীদের৷ শেষ পর্যন্ত আত্মীয়স্বজন ও পড়শিদের চাপে শুক্রবার রাতে ঘোলা থানায় মিসিং ডায়েরি করতে যান অনিকেতের মেসোমশাই দেবাশিস সাহা৷ অভিযোগ পেয়ে থানার পুলিশকর্মীরা ঘটনাটি জানান উত্তর ২৪ পরগনা চাইল্ড লাইনে৷ রাতেই চাইল্ড লাইনের কর্মীরা নন্দী বাড়িতে গিয়ে ঘটনার বিশদ খোঁজ খবর নিয়ে ফোনে জানান দক্ষিণ ২৪ পরগনা চাইল্ড লাইনের অফিসে৷

সকাল সাড়ে ন’টা নাগাদ শিশুটিকে ফিরে পেতে ডায়মন্ড হারবারে দক্ষিণ ২৪ পরগনা চাইল্ড লাইনের অফিসে আসেন মা-বাবা৷ ভোলানাথ বলেন, ‘চোখের সামনে ছেলের মৃত্যু দেখতে পারব না৷ তাই অনেক যন্ত্রণা সহ্য করে ছেলেকে ফেলে যেতে বাধ্য হয়েছি৷ কাগজে দেখেছি কুকুর ওকে আগলে রেখেছিল৷ শুনে আমাদের বুক ফেটে গিয়েছে৷ আমরা মরে গেলেও ছেলেকে আর কাছ ছাড়া করব না৷’ দক্ষিণ ২৪ পরগনা চাইল্ড লাইনের কো-অর্ডিনেটর সমীর কয়াল জানান, ‘মঙ্গলবার শিশুটিকে জেলা চাইল্ড ওয়েল ফেয়ার কমিটির বোর্ডে পাঠানো হবে৷ সেখানে শিশুটির বাবা-মাকেও উপস্থিত থাকার কথা জানানো হয়েছে৷ বোর্ড যা সিদ্ধান্ত নেবে সেটাই হবে৷’

অনিকেতের অসুস্থতার বিবরণ শুনে ও তার চিকিত্সার রিপোর্ট জেনে কলকাতার ইনস্টিটিউট অফ চাইল্ড হেলথের চিকিত্সক ঋতব্রত কুণ্ডু বলেন, ‘শিশুটির সমস্যা চোখে নয়৷ শুনে যেটুকু বুঝতে পারছি তাতে ওর আসল সমস্যা মস্তিষ্কে৷ পেডিয়াট্রিক নিউরো মেডিসিন বিভাগে নিয়ে এসে শিশুটিকে দেখানো দরকার৷’ প্রতি মঙ্গল ও বুধবার ওই হাসপাতালে এই বিভাগের চিকিত্সকেরা বসেন বলেও জানিয়েছেন তিনি৷ জটিল এই রোগের চিকিত্সা ব্যয়বহুল জেনেও ভোলানাথ আর সোমার আশা নিশ্চয় কোনও সহূদয় মানুষ তাঁদের পাশে এসে দাঁড়াবেন৷ নিজের নামের অর্থকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে মায়ের হদিস পেল অনিকেত৷ এবার তার লড়াই সুস্থ হয়ে ওঠার৷-এই সময়

নিউজ ডেস্ক || আপডেট: ০৬:৫৩ পিএম,০৬ ডিসেম্বর ২০১৫, রোববার

এমআরআর  

Share