দেশের ৬ অভয়াশ্রমে ইলিশ ধরার নিষেধাজ্ঞা শুরু আজ

আজ শনিবার ১২ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে ৩ নভেম্বর রবিবার মধ্যরাত পর্যন্ত নিষিদ্ধ এলাকায় সব ধরনের জাল ফেলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। এ ২২ দিন ইলিশ আহরণ,পরিবহন,বিপণন ও মজুদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। মা ইলিশ রক্ষায় ইলিশের বিজ্ঞানভিত্তিক প্রজনন সময় বিবেচনা নিয়ে আশ্বিন মাসের পূর্ণিমাকে ভিত্তি ধরে বেঁধে দেয়া এ সময়ের মধ্যে কেউ ইলিশ মাছ ধরতে পারবেন না। নিষেধাজ্ঞার সময়টাতে অভয়াশ্রম গুলোয় ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা দণ্ডনীয় অপরাধ। আইন অমান্যকারীদের ১ বছর থেকে সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড অথবা ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হতে পারে বলে বলা হয়েছে উক্ত আইনে। জাটকা সংরক্ষণে ২ মাস দেশের ৬টি জেলার ৫টি অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ ধরা বন্ধ থাকবে।

সরকারের এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হচ্ছে আজ শনিবার মধ্যরাত থেকেই। এ নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা ইলিশের অভয়াশ্রম গুলো হলো-বরিশাল, চাঁদপুর, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, শরীয়তপুর ও পটুয়াখালী জেলার ৩৯২ কি.মি. এলাকা। সুনির্দিষ্ট ভাবে অভয়াশ্রম এলাকা গুলো হলো :চাঁদপুর জেলার ষাটনল হতে লক্ষ্মীপুর জেলার চর আলেকজান্ডার থেকে মেঘনা নদীর নিম্ন অববাহিকার ১শ’ কি.মি এলাকা। ভোলা জেলার মদনপুর থেকে শুরু করে চর ইলিশা, চর পিয়াল হয়ে মেঘনার শাহবাজপুর শাখা নদীর ৯০ কি.মি এলাকা। ভোলা সদর উপজেলার ভেদুরিয়া হতে পটুয়াখালী জেলার চর রুস্তম ও তেঁতুলিয়া নদীর প্রায় ১শ’ কি.মি. এলাকা। শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া, ভেদরগঞ্জ উপজেলা ও চাঁদপুর জেলার মতলব উপজেলার মধ্যে অবস্থিত পদ্মা নদীর ২০ কি.মি. এলাকা। বরিশাল জেলার হিজলা, মেহেন্দীগঞ্জ, বরিশাল সদর উপজেলার কালাবদর, গজারিয়া ও মেঘনা নদীর প্রায় ৮২ কি.মি.এলাকা। প্রতি বছর মার্চ ও এপ্রিল ২ মাস এসব অভয়াশ্রমে ইলিশসহ সব ধরনের মাছ আহরণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকে।

২২ সেপ্টেম্বর রোববার সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন সংক্রান্ত জাতীয় টাস্কফোর্স কমিটির বৈঠকে এ কথা জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আক্তার।
ফরিদা আক্তার বলেন,‘ বাংলাদেশে ইলিশ মাছ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘ বৈজ্ঞানিকভাবে এ মাছ সংরক্ষণের দিন নির্ধারণ করা হয়। ইলিশ মাছ সুরক্ষায় বিজ্ঞানীরা পূর্ণিমা ও আমবস্যার সঙ্গে মিল রেখে করে থাকেন। আজকের বৈঠকে যে তারিখটা নির্ধারণে সবাই একমত হয়েছি সেটা হল- ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন সব ধরনের ইলিশ আহরণ,পরিবহন, বিপণন ও মজুদ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে আমাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যারা আছে-নৌবাহিনী, কোস্টগার্ড, বিজিবি, র‌্যাবসহ যারা জড়িত তারা সবাই নজর রাখবে কোথাও থেকে ইলিশ যেন কেউ সংরক্ষণ,আহরণ, পরিবহন ও বিপণন করতে না পারে।

জেলা মৎস্য কর্মকর্তা গোলাম মেহেদী হাসান ১০ অক্টোবর তার কার্যালয়ে বলেন,‘ চাঁদপুরের মেঘনার ৮০ কি.মি ও পদ্মার ২০ কি.মি নৌ-সীমানার ৩ উপজেলার বেশ কটি জেলে পাড়ায় থাকবে বিশেষ নজরধারী। কোনো অবস্থাইে যেন ঔ সব স্থান থেকে মাছ ধরতে জাল-নৌকা নিয়ে নদীতে নামতে না পারে সেজন্যে কড়া নজরধারী উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ গুলোর মধ্যে রয়েছে -চাঁদপুর সদরের আখনের হাট, আলুর বাজার, মুকন্দি, হরিণা ,বহরিয়া, দোকানঘর, বাঁশগাড়ি, আনন্দ বাজার, সফরমালী ও লালপুর বাজার। মতলব উত্তরের মহনপুর,এখলাছপুর, আমিরাবাদ, ছটাকী,বোরোচর ও জহিরাবাদ চর এলাকা। হাইমচরের চরভৈরবী লঞ্চঘাট, বাবুব চর, জালিয়ার চর গাজীনগর,চকিদার কান্দি, আমতলী,খোরশেদের টেক বা মোড় ,ঈশানবালা, গাজীপুরের একটেলের টেক প্রভৃতি জেলে পল্লী ও এর আশ-পাশের এলাকাগুলোতে কঠোর নজরধারী হবে। এ সব স্থানে উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় নৌ-পুলিশ,গ্রামপুলিশ ও আনসার বাহিনীর প্রতি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণে নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়ার কোস্টগার্ড,জেলা প্রশাসন,উপজেলা প্রশাসন, সাংবাদিক, জেলা মৎস্য ও উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, নৌ-বাহিনী, সেনা বাহিনী মোবাইল টীমে কাজ করবে।’

তিনি আরোও বলেন, ‘ এ বছর চাঁদপুরে ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা হলো -৩৫ হাজার মে.টন। গত অর্থবছর চাঁদপুরে উৎপাদন হয়েছে- ৩৪ হাজার ৮ শ মে.টন। চাঁদপুরে ৪৭ হাজার জেলে রয়েছে। তাদেরকে ২৫ কেজি করে খাদ্য সহায়তা দেযা হবে। গত ’২২-’২৩ অর্থবছরে সারা দেশে ইলিশ উৎপাদন ছিল- ৫ লাখ ৭১ হাজার ৩শ ৪২ মে.টন। সারাদেশে এবারের ৬ টি অভয়াশ্রমের ইলিশ উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা- ৬ লাখ মে.টন। ’

প্রসঙ্গত,ইলিশ এ দেশের জাতীয় প্রাকৃতিক সম্পদ। তাই এর রক্ষণাবেক্ষণ বা সংরক্ষণ করা দেশের প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব ও কর্তব্য। মধ্যপ্রাচ্যের তৈল সমৃদ্ধ দেশগুলোর মত ইলিশকে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ বলা চলে। পৃথিবীর অন্যতম পুষ্টিকর ও সুস্বাদু মাছ হলো এ ইলিশ। ইলিশের জীবনবৈচিত্র্য খুবই তাৎপার্যপূর্ণ।

ইলিশ শুধু ডিম ছাড়ার সময় হলেই মেঘনাসহ অন্যান্য আমাদের দেশের নদী-নদীর মিঠাপানিতে প্রবেশ করে। যে অবস্থানে ইলিশ বিচারণ করে তার নাম হলো অভয়াশ্রম। চাঁদপুরের উত্তরে ষাট নল হতে চর আলেকজান্ডার পর্যন্ত ৮০কি.মি। চাঁদপুর হতে পশ্চিম দিকে পদ্মার ২০ কি.মি এলাকা চাঁদপুরের অভয়াশ্রমের সীমানা বিস্তৃত ইলিশের উৎপাদনকে গুরুত্ব দিয়ে সরকার সমুদ্রে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণা করেছেন আরো ৩ হাজার ১ শ ৮৮ বর্গ কি.মি.এলাকা। ইলিশের উৎপাদন বাড়াতে দেশের সব প্রজননগুলোতে ২২ দিন ইলিশ প্রজনন মৌসুম ঘোষণা করে থাকে সরকার। এ সময়ের মধ্যে ইলিশ ধরা,আহরণ,বিক্রি ও বিপণন বন্ধ থাকবে। ইলিশের এ প্রজনন সময়ে সরকারের মানবিক খাদ্য সহায়তা কর্মসূচির আওতায় চলতি অর্থবছরে জেলেদের ভিজিএফ চাল বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ সহায়তা কর্মসূচির আওতায় ৩৬টি জেলার ১৫২টি উপজেলায় মা ইলিশ আহরণে বিরত থাকা ৫ লাখ ২৮ হাজার ৩৪২টি জেলে পরিবারের জন্য ৪০ কেজি হারে ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম শুরুর আগেই এ বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে।

সম্প্রতি ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে অধিক মাত্রায় ডিমওয়ালা ইলিশ ও জাটকা আহরণ বন্ধ করে মাছের অবাধ প্রজনন এবং বিচরণের সুযোগ সৃষ্টি করে ও সহনশীল উৎপাদন বজায় রাখলে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি হচ্ছ্। এবার নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি,জাটকা সংরক্ষণ,মা ইলিশ আহরোণ বন্ধ রাখায় এ ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে। বরিশাল অঞ্চলের নদ-নদীসমুহ আরো ইলিশ সমৃদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে অভয়াশ্রমটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এমনকি ভৌগলিক অবস্থানগত কারণেও অঞ্চলটি ৮২ কি.মি.অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণার যোগ্য ।

এ প্রেক্ষাপটে এ অঞ্চলকে ৬ষ্ঠ অভয়াশ্রম হিসেবে ঘোষণা ও স্থাপনের নির্মিত্তে জোর সুপারিশ করে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে । এক একটি অভয়াশ্রম হচেছ এক একটি রূপালী ইলিশ উৎপাদনের কারখানা। প্রয়োজন শুধু ধারাবাহিকভাবে বাস্তবায়ন। তাহলেই বাংলাদেশের জলসীমায় ইলিশ সম্পদ উন্নয়নের ও সহনশীল উৎপাদনের গতিধারা বজায় থাকবে এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ হবে। ইলিশ ডিম ছাড়ার সময় হলেই তারা প্রাকৃতিকভাবে সমুদ্রের লোনা পানি ছেড়ে মিঠাপানির নদ-নদীতে প্রবেশ করে। একটি স্ত্রী জাতীয় ইলিশ মাছ একবার ১৫ লাখ থেকে ৩০ লাখ পর্যন্ত ডিম ছাড়ার জন্য সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে মিঠাপানিতে আসে। প্রকৃতিগতভাবে ভবিষ্যৎ বংশধর টিকিয়ে রাখতে এমনটি করে থাকে বোধ হয় ইলিশ। মুক্তভাবে বিচরণ করে ডিম ছাড়ার পর পর এগুলো আবার লোনা পানিতে পেট খালি লম্বা লিক লিকে দেহ নিয়ে চলে যায়। ডিম ছাড়ার পর ইলিশের রেণু মিঠাপানিতে ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। হয় জাটকা ,হয় তথাকথিত টেম্পুইলিশ। নির্বোধ জেলারা তা বড় হতে না হতে এক প্রকার রাষ্ঠ্রীয়ভাবে নিষেধ এমন কারেন্ট জাল দিয়ে সেগুলো আবার ধরতে থাকে।

কারেন্ট জালের বৈশিষ্ট হলো সাদা, মসৃন ও চিকন । ইলিশ যখন দ্রুত পানিতে খাবারের তাগিদে ছুটতে থাকে তখন তাদের চোখে জালের রং এর মত পানির রং হওয়ায় বুঝতে পারে না বলেই আটকে যায় কারেন্ট জালে। আটকানোর সাথে সাথেই মারা যায়। ওয়ার্ল্ড ফিস সংস্থার এক তথ্যে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৮৬% ইলিশ বাংলাদেশে। এর একটির গড় ওজন বর্তমানে ৯৫০ গ্রাম-১হাজার গ্রাম। ২০১৪ সালে এর গড় ওজন ছিল ৫১০ গ্রাম। বর্তমান গবেষকদের মতে, ২০২০-২১ অর্থবছর ৯৫০ গ্রাম হয়েছে। অথচ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে ওজনের গড় ৫শ গ্রাম ।

পর্যলোচনা করে দেখা যায়- ইলিশের অর্থনৈতিকভাবে মূল্যায়ন করলে পৃথিবীর বিভিন্ন বিদেশ থেকে আমদানি করা এক লিটার অকটেন, পেট্রোল এবং ১ লিটার ডিজেলের মূল্য হিসেবে আমাদের দেশের পেট্রোল পাম্পগুলো। সে হিসেবে আমাদের দেশের নদ-নদী থেকে আহরিত একই ওজনের ইলিশের মূল্য এবার ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা কেজি। ইলিশের অর্থনৈতিক মূল্য কতটা বেশি তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। তাহলে বুঝতে বাকি নেই যে-এটা কতটুকু মূল্যমানের মাছ এবং কতটুকু এর চাহিদা পৃথিবীর সর্বত্র। পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ও সু-স্বাধূ বলেই পৃথিবীর সকল দেশে এর চাহিদা রয়েছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, চাহিদা বাড়লে দামও বাড়ে।

আবদুল গনি
চাঁদপুর টাইমস,চাঁদপুর
১২ অক্টোবর ২০২৪

Share