রাজনীতি

বিএনপি ‘সাজানো’ নির্বাচনে যাবে না

একাদশ সংসদ নির্বাচন যদি পুরোপুরি সরকারের ‘ছক’ অনুযায়ী হয়; তাহলে তাতে বিএনপি শেষ পর্যন্ত অংশ নাও নিতে পারে। দলটির নীতিনির্ধারক একাধিক নেতার সঙ্গে আলাপ করে এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে।

যদিও নির্বাচনে যাওয়ার পূর্ণ প্রস্তুতি বিএনপির আছে এবং দলটির নেতারাও ভোটে অংশ নেওয়ার পক্ষে। কিন্তু অনেক দিন ধরে ঢাকায় বিএনপিকে বড় ধরনের সভা-সমাবেশ করতে না দেওয়ার ঘটনায় দলটির মধ্যে সংশয় তৈরি হয়েছে যে সরকার তাদের চাপে রাখতে চায়।

নির্বাচনকে সামনে রেখে সরকার প্রশাসনকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজাচ্ছে বলেও বিএনপির কাছে বিভিন্ন মহল থেকে খবর আসছে। এ পরিস্থিতিতে ‘সহায়ক সরকার’র প্রস্তাব দিলে সরকার তাতে সাড়া দেবে এমন আশা কম বিএনপিতে।

সাম্প্রতিককালে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কিছু বক্তব্যের কারণে নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া প্রশ্নে বিএনপির মধ্যে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। দলটির নেতারা মনে করছেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুরোপুরি সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করবে। আর নির্বাচনকালীন সরকারের নিয়ন্ত্রণ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাতে থাকলে ভোটে যাওয়া না-যাওয়া সমান কথা বলে দলটি মনে করছে। বিএনপি নেতাদের মতে, ওই অবস্থায় পুলিশ ও বেসামরিক প্রশাসন পুরোপুরি সরকারের পক্ষে কাজ করবে।

জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনে যাবে এ কথা আমরা সব সময় বলি।

কিন্তু পূর্ব শর্ত হলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি হতে হবে। এখন তারা যদি প্রশাসনে প্রভাবসহ সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে, আর আমাদের চাপের মুখে রেখে প্রহসনের নির্বাচন করতে চায় তাহলে সে নির্বাচনে বিএনপি বা ২০ দল কেন যাবে? শুধু সরকারকে বৈধতা দিতে তো বিএনপি নির্বাচনে যেতে পারে না; যোগ করেন তিনি। বলেন, সহায়ক সরকারের প্রস্তাব দিয়ে আমরা দেখতে চাই সরকার তাতে সাড়া দেয় কি না। ’

দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘বিএনপি সব সময় নির্বাচনে যাওয়ার পক্ষে। আমরা এর আগে নির্বাচনে যাওয়ার কথা বলেছিও। কিন্তু ইসি ও প্রশাসনকে নিজের মতো সাজিয়ে সরকার যদি প্রহসনের নির্বাচনের ফাঁদ পাতে; তাহলে সেই নির্বাচনে বিএনপি যেতে পারে না। ’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘প্রশাসনসহ সব কিছু এখন সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তার পরও সহায়ক সরকার বিষয়ে তারা কী করে সেটি দেখে আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে চাই। ’

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ জানান, নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় সেটি পর্যালোচনা করেই বিএনপি নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের মতে, সরকারপ্রধান, প্রশাসন এবং নির্বাচন কমিশনসহ সব কিছু যদি আওয়ামী লীগের থাকে তাহলে সেই নির্বাচনে শুধু বিএনপি নয়; অন্য কোনো দল যাবে বলে মনে হয় না।

তিনি বলেন, নির্বাচন অর্থবহ হতে হবে। কিন্তু দূঃখজনক হলো; নিজের কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সিইসি নিজেই নিজেকে অনাস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছেন। মানুষ তো অন্ধ নয়। জনগণ কমিশনের ভূমিকা দেখে নির্বাচনের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে।

পরপর দুটি নির্বাচনে অংশ না নিলে দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিধান সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিয়েছে। ফলে ওই বিধান এখানে প্রযোজ্য হবে না। তা ছাড়া নিবন্ধন বাতিল ঠেকানোই রাজনৈতিক দলের একমাত্র কাজ নয়। আর রাজনীতিও নিবন্ধন দিয়ে নির্ধারিত হয় না। রাজনৈতিক দলের কর্মপরিধি নির্ধারণ হয় রাজনীতি দিয়ে। নিবন্ধন সেখানে একটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, বিএনপি আন্তরিকভাবে নির্বাচনে যেতে চায়। কিন্তু পরিবেশ তো সৃষ্টি করতে হবে। এখন সরকার যদি ২০১৪ সালের মতো একটি খেলা খেলতে চায়, তাতে অংশ নেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির আগ্রহ নেই। সরকারের একতরফা সাজানো নাটকে অভিনয় করার আগ্রহ বিএনপির নেই বলে জানান তিনি।

নিবন্ধন বাতিল হওয়া সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিএনপির এই নেতা বলেন, এটি এক ধরনের হালকা কথা। তিনি বলেন, নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার যুক্তিসংগত কারণ থাকলে নিবন্ধন বাতিল হবে কেন? প্রশ্ন উত্থাপন করে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রহসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য বিএনপি নিবন্ধন নিয়েছে নাকি? নিবন্ধন নেওয়া হয়েছে রাজনীতি করার জন্য। রাজনৈতিক দল তার আদর্শ ও নীতি বাস্তবায়নের জন্য কর্মসূচি পালন করে। সেই রাজনীতিই যদি না করা যায়, তাহলে নিবন্ধন দিয়ে কী হবে!

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-‘জ’ এর ‘ঙ’ ধারা অনুযায়ী পরপর দুটি নির্বাচনে অংশ না নিলে নিবন্ধন বাতিল হওয়ার বিধান রয়েছে। সে হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪১টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিসহ ২৮টি দলকে অংশ নিতে হবে।

সম্প্রতি নির্বাচনী রোড ম্যাপ প্রকাশ অনুষ্ঠান ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে সিইসির দেওয়া কিছু বক্তব্যে রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। গত ১৭ আগস্ট গণমাধ্যমের সঙ্গে সংলাপে সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা তৈরিতে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব ইসি নেবে না। নির্বাচনের সময় কোন ধরনের সরকার থাকবে তাও ইসির দেখার বিষয় নয়।

তিনি বলেন, সরকার যে পদ্ধতি ঠিক করে দেয়, সেভাবেই নির্বাচন করতে হয়। বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হলে ইসি সেভাবেই করবে বলে জানান নুরুল হুদা। এর আগে গত ১৭ জুলাই রোড ম্যাপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ক্ষমতার বাইরে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ করার ক্ষেত্রে বাধা দূর করার দায়িত্ব ইসি নেবে না।

সিইসির এসব বক্তব্য ‘দায়িত্বশীল’ নয় বলে নির্বাচন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মত প্রকাশ করেছেন। পাশাপাশি বিএনপিও ওই বক্তব্যে ক্ষোভ প্রকাশ করে তাঁকে সরকারের ‘আজ্ঞাবহ’ বলে অভিযোগ করেছে। এদিকে সর্বশেষ তাঁর ওই বক্তব্যের কারণেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রশ্নে বিএনপিতে নতুন করে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়েছে।

ঘরোয়া বৈঠকে সিনিয়র একাধিক নেতা মত প্রকাশ করেন যে অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে সিইসি পদে নুরুল হুদাকে বসানো হয়েছে এবং তিনি সরকারের নীল-নকশাই বাস্তবায়ন করবেন। কেউ কেউ এমনও বলেছেন, আগের রকিবউদ্দিন কমিশনের তুলনায় হুদা কমিশন আরো দুর্বল ও আজ্ঞাবহ।

গত ফেব্রুয়ারিতে ইসি পুনর্গঠনের সময় অবশ্য সরাসরি নুরুল হুদার বিপক্ষে না গিয়ে কিছুটা কৌশলী অবস্থান নিয়েছিল বিএনপি। উদ্দেশ্য ছিল; তাঁকে চাপে রাখার পাশাপাশি বিএনপির সহায়ক সরকারের প্রস্তাব উত্থাপন পর্যন্ত অপেক্ষা করা। কিন্তু সাম্প্রতিক ভূমিকায় সরকারের পক্ষে সিইসির অবস্থান স্পষ্ট হয়েছে বলে বিএনপি মনে করে।

তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিইসি নুরুল হুদা কোনো মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান। (সত্র:কালের কণ্ঠ)

নিউজ ডেস্ক
:আপডেট,বাংলাদেশ সময় ১০ : ০০ এএম, ২৬ আগস্ট ২০১৭, শনিবার
এইউ

Share