ঋণ কতটুকু বিতরণ হবে সে বিষয়ে মুদ্রানীতিতে নির্দেশনা থাকে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে যে ঋণ বিতরণের যে প্রাক্কলন করা হয়েছিল তা ছাড়িয়ে গেছে।
দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়তে থাকে। জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছিল ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে ডিসেম্বর শেষে এ হার দাঁড়িয়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে সোমবার। এখন নতুন মুদ্রানীতি তৈরির প্রাথমিক কাজও শেষে করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পর্যায়ের বিশিষ্টজনের সঙ্গে এরইমধ্যে বৈঠক করেছেন। এসব বৈঠকে আসা পরামর্শের আলোকে জানুয়ারি-জুন সময়ের নতুন মুদ্রানীতি তৈরি করা হবে।
নতুন মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লাগাম টানতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি ব্যাংকিং খাতে বিশেষকরে পুঁজিবাজারে চাউর হয়েছে, প্রথাগত ব্যাংকগুলোর ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮০ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হতে পারে। আর ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৮ শতাংশ করা হতে পারে।
অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণ কমাতে ব্যাংকগুলোকে চাপে রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংক এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এডি রেশিও কিছুটা কমানো হতে পারে।
তবে কতটুকু কমবে সে বিষয়ে এখনো সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত নয়। আর এডিআর যতোটা কমানো হতে পারে বলে বাজারে কথা উঠেছে ততোটা কমানো সম্ভব নয়।
এ ছাড়া বেসরকারি খাতে ঋণের লাগাম টানতে এডিআর কমিয়ে আনার পরিকল্পনার কথা এ মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত ব্যাংকার্স সভায় জানানো হয়। ব্যাংকগুলোর এমডিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে এডিআর সীমা কিছুটা কমানো হতে পারে বলে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা এখনো দেওয়া হয়নি।
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা। আগের বছরের ডিসেম্বরে ঋণের পরিমাণ ছিল ৭ লাখ ১৭ হাজার কোটি টাকা। এই হিসেবে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।
এদিকে ঋণ বিতরণের সীমা না কমানো জন্য দাবি জানিয়েছে ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি)। গভর্নরের কাছে পাঠানো চিঠিতে সংগঠনটি বলেছে, নির্বাচনী বছরে বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে সরকারি খাতে ঋণ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা বাড়তে পারে। তাই সীমা কমানো যুক্তিযুক্ত হবে না।
মুদ্রানীতি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, আগের মুদ্রানীতি সংযত ভঙ্গির হলেও ব্যাংকগুলো ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছে ব্যাপকহারে। কোনো কোনো ব্যাংক আইনি সীমালঙ্ঘন করেও ঋণ বিতরণ করেছে।
অর্থবছরের প্রথমার্ধের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় ১৬ দশমিক ২ শতাংশ। তবে সর্বশেষ হিসেবে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ বেড়েছে ১৮ দশমিক ১৩ শতাংশ। ঋণ বিতরণের আইনি সীমা থাকলেও কোনো কোনো ব্যাংক সে সীমা লঙ্ঘন করে ঋণ বিতরণ বাড়িয়েছে।
আমানতের সাধারণ ব্যাংক ৮৫ শতাংশ এবং ইসলামী ব্যাংক ৯০ শতাংশ পর্যন্ত ঋণ বিতরণ করতে পারে। এর চেয়ে বেশি হারে ঋণ বিতরণ করায় কয়েকটি ব্যাংককে জরিমানা করা হয়। আরও কয়েকটি ব্যাংককে সতর্ক করে বাংলাদেশ ব্যাংক। নতুন মুদ্রানীতিতে অর্জিত প্রবৃদ্ধির চেয়ে লক্ষ্যমাত্রা কমাতে চায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এ ক্ষেত্রে জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ বৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা যে ১৬ দশমিক ৩ শতাংশ রয়েছে সেটিই অপরিবর্তিত রাখা হতে পারে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
এ বছর কেমন মুদ্রানীতি হওয়া প্রয়োজন সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি হিসাবে বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধি যাতে আরো একটু উজ্জিবিত হয় সে বিষয়টার দেখা দরকার।
এ খাতে এরইমধ্যে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ঋণ চলে যাওয়ায় এ বিষয়ে সংকোচন করার কথা আসছে। তবে আমার মনে হয় সংকোচনের পরিবর্তে এসব ঋণ যাতে উৎপাদনমুখী খাতে যায় এবং অন্যদিকে না যায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে ঋণ কমানো মোটেও ঠিক হবে না।
আর যেসব ঋণ গেছে সেগুলোর ঋণমান দেখা, সেগুলো যথাযোগ্য জায়গায় ব্যবহার হচ্ছে কিনা এবং আদায় হচ্ছে কিনা। অনেকের ধারণা বেশি ঋণ গেলে মূল্যস্ফীতি দেখা দেবে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি শুধু একটি কারনে বাড়ে না।
বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহের পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নির্ভর করে বাজারমূল্য, যোগাযোগ ব্যবস্থা, চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট প্রভৃতির উপর। সেক্ষেত্রে মুদ্রানীতি সংকোচন বা বাড়লে এটাতে কোন প্রভাব পড়বে না।
এগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরের বিষয়। উৎপাদন, মানুষের কর্মসংস্থান, আয় বাড়লে মুল্যস্ফীতির বোঝা কমবে। তাই বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষিতে সংকোচিত না করে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা উচিত। অন্যদিকে সরকার যাতে ব্যাংক থেকে ধার না নেয় সেটিও দেখা দরকার।
সাধারণত, নির্বাচনী বছরে অর্থ পাচার বেড়ে যায়। আর পাচার ঠেকাতে মুদ্রনীতি কতটুকু সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে সে বিষয়ে সাবেক এ গভর্নর বলেন, অর্থপাচার ঠেকাতে হলে মুদ্রানীতি সংকোচশীল না সম্প্রসারণমূলক হলো সেটা কোন ব্যাপার নয়।
এজন্য অর্থ কোথায় যাচ্ছে সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। আর নিয়মনীতিগুলো যাতে কঠোরভাবে পালন করা হয় সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। অর্থ পাচার রোধে বাংলাদেশ ব্যাংককে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন তিনি।
উল্লেখ্য, চলতি ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ এবং মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার প্রাক্কলন করা হয়েছে।
এদিকে বাজেটের ঘাটতি পূরণে ব্যাংকিং খাত থেকে ২৮ হাজার ২০৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে সরকার। কিন্তু ডিসেম্বর পর্যন্ত ঋণ না নিয়ে উল্টো ১২ হাজার ৪৩৯ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকিং খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে মূল্যস্ফীতিও বেড়েছে। গড় মূল্যস্ফীতি লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে ৫ শতাংশ হলেও ডিসেম্বরে তা দাঁড়িয়েছে ৫ দশমিক ৭০ শতাংশে। আগের মাসে যা ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। এ ছাড়া অক্টোবরে গড় বার্ষিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৫৯ শতাংশ। এখন ঋণের লাগাম টানা না হলেও মূল্যস্ফীতি সহনীয় মাত্রার বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
প্রসঙ্গত, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা বা এগিয়ে নেয়ার লক্ষ্যেই মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতি ৬ মাস অন্তর আগাম মুদ্রানীতি ঘোষণা করে থাকে। দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় মুদ্রানীতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে পরবর্তী ছয় মাসে অভ্যন্তরীণ ঋণ, মুদ্রা সরবরাহ, অভ্যন্তরীণ সম্পদ, বৈদেশিক সম্পদ কতটুকু বাড়বে বা কমবে তার একটি পরিকল্পণা তুলে ধরা হয়। (ইত্তেফাক)
নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ১১:০৩ পিএম, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮, শনিবার
ডিএইচ