সারাদেশ

নির্বাক স্বামী-সন্তানদের নিয়ে যেভাবে চলছে মরিয়মের ভালোবাসার সংসার

স্বর্গ শুধা লুটায় ঘরে স্বামী-স্ত্রীর প্রেমে। দুঃখ-কষ্ট সব ভুলে যায় ভালোবাসার আলিঙ্গনে। স্বামীকে জড়িয়ে ধরে বলি একবার বলো আমি তোমায় ভালবাসি। স্বামীও জড়িয়ে ধরে বাকহীন কণ্ঠে সোহাগ করে। ভেবেছিলাম স্বামী কথা না বলতে পারার কষ্টটা হয়তো সন্তানের মা ডাকের মধ্যে দিয়ে কিছুটা ঘুচবে। অনেক প্রতীক্ষার পর কষ্টের বোঝাটা দিগুন হয়ে গেলো। চোখের সামনে স্বামীর মতো সন্তানরাও তাদের মানবিক চাহিদাগুলোর আবেগ যখন ইশারায় প্রকাশ করে তখন আমি নিজেও নির্বাক হয়ে যাই। এই বাস্তব জীবনের গল্পটা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের নিভৃত এক পল্লীর বাসিন্দা মরিয়মের। স্বামী আর দু’টি বাকপ্রতিবন্ধী সন্তান নিয়ে সংসারযুদ্ধে লড়াই করে যাওয়া এক নারীর নাম মরিয়ম বেগম।

উপজেলার সরিষা ইউনিয়নের নির্ভৃত এক গ্রামের নাম গুইলাকান্দা। এ গ্রামটির পুরোটাই ফলদ, বনজ গাছ আর বাঁশঝাড়ে যেন ঢেকে রেখেছে। ইউনিয়ন পরিষদের সামনের রাস্তায় অল্প একটু এগুলোই ধুলোবালি ভরপুর কাঁচা রাস্তার পাশে পাটখড়ি আর টিনসেডের নির্জন বাড়ি। বাড়িতে শুনশান নিরবতা। এ বাড়িতেই বসবাস ‘বাকহীন’ একটি পরিবারের।

বাড়ির আঙ্গিনায় অনেক ডাকাডাকির পর বাড়ি থেকে বেড়িয়ে এলেন মধ্যবয়সী মরিয়ম। বাকপ্রতিবন্ধী স্বামী আবুল মিয়া ও দুই ছেলেকে নিয়ে এ বাড়িটিতেই তার বাস। দুই ছেলে ইজাজুল ও ইমামুলও বাকপ্রতিবন্ধী। চারজনের সংসারে বাক আছে শুধু মরিয়মের। স্বামী-সন্তানদের সাথে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না মরিয়ম। ইশারায় চলে তাদের নিত্যদিনের কাজ। ইশারায় বুঝেন ইশারায় বুঝান। প্রয়োজনীয় নিত্যদিনের কাজগুলো সমাধানে এভাবেই চলে নিরন্তর চেষ্টা।

গুইলাকান্দা গ্রামের মৃত মনসুর আলীর একমাত্র ছেলে আবুল মিয়া। প্রায় ১২ বছর আগে আবুল মিয়ার সাথে বিয়ে হয় কেন্দুয়া উপজেলার গন্ডা ইউনিয়নের গারাটিয়া গ্রামের আবদুল হেলিমের মেয়ে মরিয়ম বেগমের। এ দম্পতির ঘরে জন্ম হয় ইজাজুল মিয়া (৮) ও ইমামুল মিয়া (৫) নামে দুটি ছেলেসন্তানের।

মরিয়মের সাথে কথা হলে তিনি জানান, বিয়ের আগেই বরের বাকপ্রতিবন্ধীর বিষয়টি জানতেন। বিয়ের আলোচনার সময় পিত্রালয়ের অনেকেই বিয়েতে অমত পোষণ করে। তখন নিজেই মুখ খুলেন। বাকপ্রতিবন্ধী নয় আবুলকে একজন মানুষ হিসেবেই নিজের বর করতে চান বলে ইচ্ছা পোষণ করেন তিনি। সংসার জীবনটা যে কঠিন হবে, তা জেনেও বিয়ের বিষয়টা পাকা করেন। নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিতে হবে এই মানসিকতা নিয়েই স্বামীর ঘরে নতুন বধু মরিয়মের আগমন।

শুরু হলো বাকপ্রতিবন্ধী স্বামীর সাথে নতুন জীবন। অন্য আরো ১০টি দম্পতির মতো স্বাভাবিক জীবন ছিলো না তার। নিজের আবেগগুলো স্বামীর সাথে শেয়ার করেন ঠিকই কিন্তু স্বামীর আবেগগুলো বুঝতে অপেক্ষা করতে হয় ইশারার জন্যে।

ভেবেছিলেন স্বামী যেমনই হোক সন্তান হলে ওরা যদি মা বলে ডাকে তবুও তো অনেকটা হালকা হওয়া যাবে। তিন বছরের ব্যাবধানে দু’টি সন্তানের জন্ম হয় তাদের। শিশু অবস্থায় কিছু বুঝা না গেলেও একটু বড় হতেই বুঝতে পারলেন তারাও বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে জন্ম নিয়েছে। মা ডাক শোনার ভাগ্য দেননি সৃষ্টিকর্তা।

তবু তিনি হাল ছড়েননি। পরের বাড়িতে কাজ করে তিনজনের প্রতিবন্ধী সংসারটি চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে অনেক সময় নিজেই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন।

প্রতিবেশী মনোয়ারা বেগম বলেন, মরিয়ম স্বামী ও সন্তানদের যে ভালোবাসা দেখিয়ে চলছেন তা অন্য দশটা নারীর দ্বারা সম্ভব নয়। বাকপ্রতিবন্ধী আবুলের সংসারটি অনেক কষ্টে চলে। প্রতিবন্ধীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কোনো কাজে লাগাতে পারলে হয়তো তারা খেটে খেতে পারতো।

সরিষা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো: শাহজাহান ভুঁইয়া বলেন, স্বামী বাকপ্রতিবন্ধী জেনেও যে মহিলা তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়েছে তা সত্যিই প্রশংসার। তাকে সালাম জানাই। তবে হতদরিদ্র একই পরিবারে তিনটি লোক বাকপ্রতিবন্ধী এটি দুশ্চিন্তার। সরকারি দান-অনুদান দিয়ে সাময়িক সহায়তা করা যায়। এদের জন্যে কারিগরি কোনো শিক্ষার ব্যবস্থা করা গেলে হয়তো ভালো হতো।

নিউজ ডেস্ক
: আপডেট, বাংলাদেশ সময় ৩:২৫ পিএম, ৪ জানুয়ারি ২০১৮, বৃহস্পতিবার
এএস

Share