প্রতিদিনই বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম, ভোগান্তিতে মধ্য ও নিম্নবিত্তরা

গত কয়েক বছর ধরেই নিত্যপণ্যের বাজারে থেমে থেমে একরকম অস্থিরতা থাকছেই। একটু একটু করে প্রতি বছরেই বাড়ানো হয়েছে দাম।

বিশেষ করে গত পাঁচ বছরে প্রায় সব পণ্যের দাম বেড়ে অস্বাভাবিক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা এই মুহূর্তে মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষের জন্য যেন লাগামহীন- এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

তাদের মতে, কখনো আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি, আবার কখনো সরবরাহ সংকটের অজুহাত দেখিয়ে প্রতিবছরই এসব পণ্যের দাম বাড়িয়েছে মিল ও মোকাম মালিক এবং আমদানিকারকরা।

এর নেপথ্যে সক্রিয় থাকছে অসাধু ব্যবসায়ীদের সেই প্রভাবশালী সিন্ডিকেট সদস্যরা। যারা সবসময়েই থাকেন অধরা। ফলে প্রতিবছরই তারা ভোক্তার পকেট কেটে নিয়ে যাচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা।

বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বাজারে নিত্যপণ্য কিনতে এসে বাড়তি দামে রীতিমতো হাঁসফাঁস করতে হয় ক্রেতাদের।

গত পাঁচ বছরের (২০১৬ অক্টোবর-২০২১ অক্টোবর) পণ্যমূল্যের দাম পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রাজধানীর খুচরা বাজারে পঁাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিনের দাম বেড়েছে ২৩৫ টাকা।

কেজিতে গরুর মাংস ও রুই মাছ যথাক্রমে ১৫০ ও ১৩০ টাকা বেড়েছে। কেজিপ্রতি চালে ১৭-২০ টাকা, ডাল ৩০ টাকা, চিনি ২০ টাকা ও দেশি পেঁয়াজের দাম কেজিতে ৪০ টাকা বেড়েছে।

পাশাপাশি এই পাঁচ বছরে ব্রয়লার মুরগি কেজিতে ৬৫ টাকা বেশি দরে বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ডিমের (১২ পিস) দাম বেড়েছে ২৫ টাকা। তাছাড়া সবজির দাম গত পাঁচ বছরে অনেক বেড়েছে।

সব মিলে ক্রেতা সাধারণের এসব পণ্য কিনতে সুনির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে। এতে সবচাইতে বেশি ভোগান্তিতে পড়ছে নিম্ন আয় ও খেটে খাওয়া মানুষ।

গত ১৬ জুন জীবনযাত্রার ব্যয় ও ভোক্তাস্বার্থ সংশ্লিষ্ট অন্যান্য প্রাসঙ্গিক বিষয়ের ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

সেখানে বলা হয়, ২০২০ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় ৬ দশমিক ৮৮ শতাংশ এবং পণ্য ও সেবা-সার্ভিসের মূল্য ৬ দশমিক ৩১ শতাংশ বেড়েছে, যা গত তিন বছরে সর্বোচ্চ।

কারণ ২০১৯ সালে এই হার ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক ৫০ শতাংশ এবং ৬ দশমিক ০৮ শতাংশ। এছাড়া ২০১৮ সালে জীবনযাত্রার ব্যয় এবং মূল্যবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬ দশমিক শূন্য শতাংশ এবং ৫ দশমিক ১৯ শতাংশ।

প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকায় ১৫টি খুচরা বাজার ও বিভিন্ন সেবা সার্ভিসের মধ্যে থেকে ১১৪টি খাদ্যপণ্য, ২২টি নিত্যব্যবহার্য সামগ্রী এবং ১৪টি সেবা-সার্ভিসের সংগৃহীত তথ্য-উপাত্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়।

জানতে চাইলে ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সর্বশেষ বিগত তিন বছর হিসাব করলে রাজধানীসহ দেশের প্রত্যেকটি অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে।

একদিকে করোনা মহামারির প্রভাবে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের আয়-রোজগার ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে। অন্যদিকে বাজারে পণ্য ও সেবার দাম বাড়ছে। ফলে নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ভোক্তাদের জীবনমান বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের নজর বাড়াতে হচ্ছে। ভোক্তার স্বার্থে পণ্যের দাম কমাতে যা করা দরকার সেভাবে একটি রোডম্যাপ ঠিক করে সিদ্ধান্ত নিয়ে পণ্যের দাম কমাতে হবে।

রাজধানীর কাওরান বাজারের আল্লারদান রাইস এজেন্সির মালিক মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, গত পাঁচ বছর আগে প্রতিকেজি মিনিকেট চালের খুচরা মূল্য ছিল ৪৮-৫০ টাকা, যা এখন ৬৫-৬৭ টাকা বিক্রি করছি।

পাশাপাশি মোটা চালের মধ্যে স্বর্ণা জাতের চাল প্রতিকেজি বিক্রি করছি ৪৮ টাকা, যা একদিন আগেও ৫০ টাকায় বিক্রি করেছি। তবে পাঁচ বছর আগে এই মোটা চাল ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছি।

তিনি জানান, পাঁচ বছরে চালের দাম অনেক বেড়েছে, যা বাড়ার কথা না। তিনি জানান, প্রতি বছর প্রত্যেকটি মৌসুমে চালের বাম্পার ফলন হচ্ছে। কিন্তু ঠিক সেই সময় চালের বাজারে দাম বাড়ছে।

আর এই দাম বাড়াচ্ছে মিল মালিকরা। তারা অতি মুনাফা করতে সিন্ডিকেট করে প্রতি বছর দাম বাড়াচ্ছে। তদারকি সেখানে করা উচিত।

রাজধানীর নয়াবাজারের মুদি বিক্রেতা মো. তুহিন বলেন, এখন পাঁচ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ৭২৫ টাকা। পাঁচ বছর আগে ঠিক একই সময় ৪৮০-৪৯০ টাকায় বিক্রি করেছি।

প্রতিকেজি চিনি বিক্রি করেছি ৬০ টাকা, তা এখন ৮০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ভালোমানের মসুর ডাল (ছোট দানা) সর্বোচ্চ ১২০ টাকায় বিক্রি করছি, যা পাঁচ বছর আগে ৯০ টাকায় বিক্রি করেছি।

পাশাপাশি এক ডজন ফার্মের ডিম ১২০-১১৫ টাকা, যা পাঁচ বছর আগে ৮৫-৯০ টাকায় বিক্রি হতো। আর প্রতি কেজি দেশি পেঁযাজ ৩৫ টাকায় বিক্রি করেছি, যা এখন ৭৫ টাকা কেজি বিক্রি করতে হচ্ছে।

তিনি জানান, পণ্যের দাম গত পাঁচ বছরে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এই গত কয়েকদিন আগে ভোজ্যতলের দাম বেঁধে দিল সরকার। কিন্তু মিলমালিকরা সেই দরে বিক্রি করছে না।

ফলে খুচরা বাজারেও নির্ধারিত দামে বিক্রি হচ্ছে না। কিন্তু তদারকি সংস্থা খুচরা বাজারেই অভিযান করছে। তারা এসে ক্রয়ের রশিদ দেখতে চাইছে, কিন্তু মিলাররা বেশি দরে বিক্রি করলেও রশিদ দিচ্ছে না।

তাই দেখাতেও পারছি না। জরিমানা গুনতে হচ্ছে। কিন্তু মিলমালিকদের তারা কিছুই বলছে না। তারাও জানেন খুচরা বাজারে বেশি দরে এনে বেশি দরেই বিক্রি করতে হবে। দাম যা বাড়ানোর মিল মালিকরা বাড়ায়।

কিন্তু তারা সেখানে অভিযান পরিচালনা করে না। অভিযান পরিচালনা করতেও দেখা যায় না। সেখানে অভিযান করলে পণ্যের দাম কমবে।

অন্যদিকে এই পাঁচ বছরে মাছ মাংসের দামও বেড়েছে। যেখানে বর্তমানে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি ১৭৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে, পাঁচ বছর আগে ১১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে।

আবার সরবরাহ বেশি থাকলে ১০০ টাকায় পাওয়া গেছে। পাশাপাশি গরুর মাংস বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৬০০ টাকা।

যা পাঁচ বছর আগে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। পাশাপাশি পাঁচ বছর আগে প্রতি কেজি রুই মাছ ২২০ টাকায় বিক্রি হলেও এখানে বিক্রি হচ্ছে ৩৫০ টাকা কেজি।

রাজধানীর নয়াবাজারে নিত্যপণ্য কিনতে আসা সাজেদা বেগম বলেন, এখন প্রতিদিনই পণ্যের দাম বাড়ছে। তাছাড়া পাঁচ বছর আগে পণ্যের দাম যা ছিল তা দুইগুণ বেড়েছে।

করোনা পরিস্থিতিতে যেখানে আয় কমেছে সেখানে পণ্যের দাম বাড়ায় কিনতে খুব হাঁসফাঁস লাগছে। কারণ পেটে ক্ষুধা রেখে হিসাব করে পণ্য কিনতে হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যেনও কোনো লোক নেই-ক্ষুব্ধ মন্তব্য তার।

Share