নিতুর স্পন্দিত পরকীয়া

ফরিদা ইয়াসমিন জেসী । আপডেট: ০৬:৩৩ অপরাহ্ণ, ২৮ জুলাই ২০১৫, মঙ্গলবার

বাস থেকে নেমে কিছুটা ঢালু রাস্তা দিয়ে হাটতে গিয়ে শক্ত করে বাবার হাত ধরে নিতু।

পথটা সর্ম্পুণ অপরিচিত। রাস্তাটা চলে গেছে ঠিক যেনো কোন বাউল শিল্পীর একমাথা এলোপাতাড়ী চুলের ফাঁক দিয়ে চলে যাওয়া মাথার সিথির মত। দু‘পাশে সবুজ লতা পাতা জুতায় মাড়িয়ে হাটতে হচেছ।

: এপথে আমরা কোথায় যাচিছ বাবা ? এর আগেতো কখনও আসিনি এপথে, তুমি কি এসেছিলে ?

: কাছেই তোমার এক ফুফু থাকেন, আমার মামাতো বোন। তোমাকে দেখাবো বলে আজ নিয়ে এলাম।
নিতুর কাছে এখানকার পথঘাট যেমন অপরিচিত ঠিক তেমনি মানুষগুলোও। ফুফু এসে জড়িয়ে ধরে মায়া দিলেন নিতুকে,

: এতোদিন পর তাহলে আমার মায়ের মনে পড়লো আমাকে?

মায়াবি আদর আর কুসুম কুসুম ভালবাসায় নিতুর মনে হলো এরা যেনো কতদিনের চেনা ।

কয়েক ঘন্টা পর সুবাহান সাহেব উঠে দাড়ালেন।

: আজ তাহলে যাই সুরাইয়া।

: ভাইজান, আপনার একার কথা হলে কিছু বলতাম না, মেয়েটাকে নিয়ে এই প্রথম এলেন। আজকের রাতটা নাহয় কষ্টে চিষ্টে থেকে যান।

: ঢাকা তো আর বেশী দুরে নয়, আসবো আবার সময় করে।

কথার মধ্যে নিতু এসে দাড়ায় একটি মেয়েকে নিয়ে। সে তার সাথে বিশাল বাড়ীটির এদিক ওদিক ঘুরে দেখছিল। হঠাৎ নিতুর দৃষ্টি গিয়ে আটকে পড়ে দেয়ালে টাংগানো একটি ছবির ফ্রেমে। সাদা কালো বড় একটি ছবির ফ্রেমে ফুটšত পদ্মফুলের মত একটি মুখ। ঠোঁটের উপর কচি লতার মত বিন্দু বিন্দু হালকা গোফের সাজ। বড় বড় চোখে নেশাধরা দৃষ্টি।

: ফুফু এই ছবিটি কার ?

নিস্তব্ধ ঘরটি হঠাৎ একটি শব্দে যেনো কেপেঁ ওঠে! নিতু নিজেও কিছুটা অপ্রস্তুত, কেননা প্রশ্নটা অবচেতন মনে করা বলে শব্দ বেশী হয়ে গেছে।

: এটি তোমার এক ভাইয়ের ছবি, অর্থাৎ আমার ছোট ছেলে আবিদ। সকুলে রয়েছে, এসে পড়বে কিছুক্ষণ পরেই।

: উনি খুব সুন্দুর তাইনা ?

নিতুর কথায় সবাই হাসে কেউ কোন কথা বলেনা।

স্কুল শেষে আবিদ বাড়ী ফিরে এসে মাকে জিজ্ঞেস করে-

: আমাদের বাড়ী যে মেহমান এসেছিলেন উনারা কি চলে গেছেন মা?

: জানলি কি করে ?

: স্কুলের মাঠ দিয়ে উনারা পাড় হবার সময় আমি ক্লাস থেকে দেখেছি। মেয়েটি কে মা? মামাকে তো আগে একবার দেখেছি।

: ওর নাম নিতু, তোর মামাতো বোন।

চৈত্রের দুপুরে বাড়ীর পাশের শিমুল গাছ থেকে টপটপ লাল শিমুল ফুল পড়ে মাটিতে জমাট বেধে আছে। আবিদ পা দিয়ে তা এপাশ ওপাশ কওে। এক দলা শক্তমাটি তুলে নিয়ে ঢিল ছুড়ে গাছের মগ ডালে এবং মনে মনে বিড় বিড় কওে। ওর নাম নিতু, ভারী সুন্দর মেয়ে । আমি ক্লাস নাইনে পড়ি, নিতু কোন ক্লাসে ?

‘‘আমাদের ছোট গ্রাম ছোট ছোট ঘর,
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর।
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,
এক সাথে খেলি আর পাঠশালায় যাই।”

পাঠ্যবইয়ের ছড়াটা পড়তে পড়তে নিতুর মনের ভেতর ভেসে উঠে সেই গ্রামটির ছবি। কি নাম গ্রামটির? যে গ্রামে ফুফু থাকেন। আবিদ ভাই থাকেন। নিতুর ক্লাসে একটি ছেলেও আবিদ ভাইয়ের মত সুন্দর নয়। ওরা কেমন অন্য রকম আর আবিদ ভাই আলাদা। কি ভাল হতো যদি আমরা দুজন একই স্স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। রোজ আমাদের দেখা হতো।

এভাবে একদিন একদিন করে একটি সপ্ন ধীর পায়ে এগিয়ে চলে দুজনের বুকের ভেতর দিয়ে। একেকটি দিন। একেকটি মাস, তারপর একেকটি বছর পার হয়।

ঢাকার লোকালয় এলাকায় নিতু পথ হাটে অর্ন্তচোখে খুঁজে বেড়ায় সেরকম একটি মুখ।

একদিন শীতের সন্ধায় নিতু মা আর বাবার সাথে সাথে ফুটপাতের পাশ দিয়ে হেঁটে বাইরে থেকে বাসায় ফিরছিল, তার চোখে পড়ে ল্যামপোষ্টের সোডিয়াম আলোগুলো সমস্ত রাস্তায় এক মায়াবি রংয়ের আবেশ ছড়িয়েছে। এই পায়ে হাঁটার পথটি আর কিছুক্ষণ পরই হয়ে উঠবে এক বিশাল ঘুমের চল্টর। ছেলে বুড়ো, আতুর, অন্ধ সবাই যে গাদাগাদি

করে ঘুমাবে তারই আয়োজন চলছে। এসব দেখে নিতুর ভাবনা হয়, উদভ্রান্ত কেবলই ঘোরপাক খায়। কত রকম জীবন যাপন মানুষের।

ছেলেবেলা থেকে নিতুর চিন্তা চেতনা অনেকের চেয়ে আলাদা। বাবার কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তরের সাথে তার নিজের উত্তরটি আলাদা মনে হয়। অনেক দিন মধ্যরাতের শীতল প্রহরে সময়ের আর ভাগ্যের হিসাব করে নিতু আংগুলের কড় গুনে গুনে। ক্লাসে এইটের পাঠ্য সব বই তার পড়া শেষ। রোমেনা আফাজের মাসুদ রানা আর শরৎচন্দ্রের দেবদাস পড়ে পড়ে বয়সের তুলনায় মানসিকতায় নিতু এখন একধাপ এগিয়ে।

বাসায় ফিরতেই কাজের মেয়ে দৌড়ে এসে খবর দেয় দুজন মেহমান এসেছেন অনেকক্ষণ আগে।

কোথা থেকে এসেছেন বলতে বলতে ড্রয়িংরুমে ঢুকেন সুবাহান সাহেব ।

: আরে সুরাইয়া আর জামিল ভাই যে।

নিতুর কানে কথাটা দ্রুত পৌছাতেই বাবার পিছনে এসে দাড়ায়। অমনি সুরাইয়া বেগম উঠে এসে নিতুকে জড়িয়ে ধরে বলেন কি? ফুফুকে মনে আছে ?

: তোমরা আসবে একটা খবরতো দিতে পারতে ?

: ভাইজান এসেছি একটা জরুরী প্রয়োজনে। সাকীর বিয়ে ঠিক করেছি বরিশালে, তোমরা যদি কার্ডের দাওয়াতে না যাও তাই নিজেরাই এলাম। অনুষ্ঠান ভেবেছি বরিশালে আববার ওখানেই করবো, মেয়ের বাড়ীও যখন ওখানে।

তোমাদেরকে কিন্তু আসতেই হবে, আগামি মাসের তিন তারিখ বিয়ে।

ড্রয়িংরুমের আলাপের মধ্যথেকে নিতু আলগোছে এসে বেডরুমের আয়নার সামনে বসে। রোমাঞ্চিত হয় মনে মনে, বাল্যকালটি ধীরে ধীরে সরে গেছে মুখের আদল থেকে। সত্তায়, মেধায় এখন কৈশর নিতুর। আয়নায় নিজের মুখ দেখে যে কচিপাতাকে সনাক্ত হতো, এখন মুগ্ধ চোখে গভীর ভাবে সে দেখে একটি কৈশরের সাদা হাস তার অবয়বে। অনুভুতিতে এক অজানা জগৎ আর শরীরের পাপড়ীতে পাপড়ীতে অবাক বিস্ময় এখন।

ঝট করে উঠে মার গলা জড়িয়ে ধরে নিতু বলে,
: মা তুমি কি বলো আমরা যাবো বিয়েতে ?

মা বুঝতে পারেনা কখন, কিসে যে তার উচছাস আর কিসে তার এলোপাথাড়ি ভাবাবেগ।

: কেনো, তোর বুঝি খুব যেতে ইচেছ ?

: হ্যা খুব।

: বেশতো যাবো ।

ধনাঢ্য বাবার একমাত্র মেয়ে নিতু। বছরের প্রতিটি দিনই তার রঙ্গিন থাকবার কথা, প্রজাপতির স্বপ্নিল পাখায় ভর করে উড়ে বেড়াবার কথা ঝলমল করতে করতে। কিন্তু মাঝে মাঝে নিতু অন্য রকম। মাঝে মাঝে এমন সব প্রশ্ন করে মা বাবাকে ম্রিয়মান থাকতে হয়, তারা বুঝেনা কি উত্তর দেবে প্রজাপতি শিশুর কাছে। আজ উচছল ঝর্নার মত অপরুপ এক দৃশ্য দেখে নিতুর আদলে তার মা। মনে মনে ঠিক করে বিয়েতে তারা যাবে।

রাতে পদ্মের মত পাপড়ী মেলে নিশ্চিনে ঘুমানো নিতুর মুখের দিকে চেয়ে বাবা মা গপ্প তুলে। ধীরে ধীরে নিতুটা কেমন বড় হয়ে উঠছে তাইনাগো, তুমি কয়দিন পর শশুড় হবে আর আমি হবো শাশুড়ী ভাবতেই অবাক লাগে তাইনা ? তোমার মনে পড়ে ——?
বাবা মা হাড়ানো দিনে ফিরে যায়। পৃথিবীর সমস সবুজ গন্ধ, স্নেহমায়া, আর মধুরতা যেনো ফেলে আসা দিনগুলিতে,এখন কেবল ব্যসতা আর সময়ের সাথে বুঝাপড়া।

অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে নিতু, সকাল হয়, দুপুর গড়ায়, রাত নেমে আসে এবং আবার ভোর হয়।

নিতুর মনের আকাশে তারা হয়ে জলে একটি কিশোর যুবকের ছবি, মাঝে মাঝে মনটা উদাস হয়, দেখা হবার পর কি প্রতিক্রিয়া হবে ? ছবিতে দেখা মানুষটিকে বাসবে দেখলে চিনতে পারবেকি নিতু। চিনতে পারলেও কিভাবে কথা শুরু করবে। এরকম হাজার হাজার খন্ড প্রশ্ন একের পর এক দোলা দেয় মাথার ভেতর নিতুর।

অবশেষে ছুটি নিয়ে তৈরী হয় নিতু। মেয়ের আগ্রহ দেখে সুবাহান সাহেব মনে মনে ঠিক করেন দীর্ঘদিন মামা বাড়ী যাওয়া হয়না, যাক এক উদ্দেশ্যে কাজ থেকে কিছুটা রেষ্ট নেয়া যাবে।

লঞ্চে করে ঢাকা থেকে বরিশাল। সারা রাত্রি বসে থাকতে হবে লঞ্চে, গভীর রাতে ঘুম থেকে জেগে অন্তত অসীম জলরাসির দিকে তাকিয়ে নিতুর মনে হয় কি চমৎকার জলের উপর আলোর রশ্মি। কিন্তূ ঢেউয়ের দোলায় লঞ্চের লাফালাফি দেখে হঠাৎ মৃত্যু ভয়ে আনমনা হয়ে উঠে সে। যদি এখান থেকে পড়ে যায় আর যদি না উঠে আসতে পারে তাহলেতো নির্ঘাৎ মৃত্যু।

কেবিনের বারাšদায় রেলিং এ দাড়িয়ে নিতুকে নিচের জলরাশির দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সুবাহান সাহেব পাশে এসে দাড়ান। একটি চাদর সযত্নে পেছন থেকে মেয়ের গায়ে জড়িয়ে দিতে দিতে বলেন,

: ঠান্ডা বাতাসে বাইরে এলে কেনো মা ?

নিতু কোন কথা বলেনা,

ফস করে একটা দেশলাই জ্বালিয়ে সুবাহান সাহেব নিতুর মুখের সামনে ধরে রসিকতার ভঙ্গিতে বলেন,
: এতো মগ্ন হয়ে কি ভাবছিস মা ? সপ্নে কোন রাজপুত্রের সন্ধান পেয়েছিস কি ? ঘুমের মাঝে হাসছিলি দেখলাম।

সুর্যের মত চকচকে গায়ের রং নিতুর। দেশলাইয়ের আগুন পেয়ে তা যেনো দিগুন বিকিরন হলো। অথচ মুখটা ম্লান করে বলে বাবা যদি মরে যাই আমি। এই থই থই পানিতে পড়া মানেইতো মৃত্যু তাইনা ?

সুবাহান সাহেব এর মুখটা ঝট করে ম্লান আর বিবর্ণ হয়ে য়ায়। ব্যাকুল ভাবে মেয়েকে বুকে টেনে নেন এবং কেবিনে মায়ের পাশে বসিয়ে বলেন

: কিসব বলছিস! পাগলী কোথাকার । তুই মরে গেলে বাবা কি বাচবো ?

ফিক করে হেসে দেয় নিতু
: ধুস আমি ঠাট্টা করছিলাম আর তুমি অমনি ভয় পেয়ে গেলে?

: কি কথা হচেছ বাবা ও মেয়ের মধ্যে আমিতো কিছুই বুঝতে পারছিনা,

: অনেকদিন পর আমরা ঢাকার বাইরে এলাম নাগো ?

প্রসংগ বদলায় সুবাহান সাহেব,
: এতো শীতে গ্রামে তোমাদের কেমন লাগবে সে কথাই ভাবছি,

নিতু ঝট করে বলে উঠে,
: বারে ঢাকায় বুঝি শীত নেই ?

যখন বরিশাল ঘাটে এসে লঞ্চ থামে তখন সবে সুবহে সাদেক হয়েছে। লঞ্চঘাটের চারপাশের মাকড়শার জালের মত লোকজন বিছিয়ে আছে। নিতুর অসাধারণ শ্পর্শ কাতর স্নায়ুতন্ত্র্রীতে ধরা পড়ে সেইসব মানুষের অবস্থান, চালচলন আর জীবনযাপন। ছোট ছোট ছেলেরা তাদের মালগুলি মাথায় করে বাসে তুলে।

বাড়ী থেকে বাস ষ্টেশনে এসে দাড়িয়ে আছে অনেকেই । নিতুরা আসছে এখবর সকলের জানা হয়ে গেছে। নিতু রেশমী কাপড়ের বুটিদার একটি সেলোয়ার কামিজ পড়েছে, ঘাড় অবধি সিলকি চুল, সাজ বলতে কেবল ঠোঁটে হালকা রংয়ের একটু লিপষ্ঠিক, আর কিছু নয়।

ইতস্তত ভাব নিয়ে নি:শব্দে বাড়ির আঙ্গিনায় পা রাখে নিতু। অন্যান্যদের সাথে একটি ছেলের দিকে চোখ পড়তেই বুকের ভেতরের এতোদিনের জমানো মোহন বাশিটি সুর করে বেজে উঠে নিতুর। ছেলেটি কি আবিদ ভাই, ছবিটিতে এরকমই একটি মুখ ছিল।

নিতুকে দেখা মাত্র তার মুখেও কেমন আলোকচছটা..। চোখে মুখে বিস্ময় আর অপ্রতিভ ভাব। ওরা ঘরে ঢোকা মাত্র ঘরটি লোকে ভরে ওঠে, কে কি নিয়ে এসে আপ্যায়ন করবে শুরু হয়ে যায় তার ব্যসতা, কেউ সরবত, কেঊ পানি, কেঊ টাওয়াল, আবার কেউ এসেছে হাতপাখা নিয়ে।

নিতু মনে মনে হাসে এই শীতে পাখা কেনো ?

সুবাহান সাহেব মেয়ের অনর্নিহিত সব ভাবনা বুঝতে পারে তাই নিতুকে হাসতে দেখে নিজেই বিশেষন করেন, আমরা ঢাকা থেকে এতোদিন পর এসেছি ওরা অভিভুত হয়ে যে যেটা পারছে সামনে আনছে কি ঊপযোগী নয় সেটা এখন আর ওদের বোধে নেই, তুমি তালপাখাটা দেখে হাসছো তাইতো ? নিতু মুখ লোকায় ওফ বাবা ! তুমি যে কি।

সারাদিন ধরে এ ঘর ও ঘর ঘুরে নিতু, পরিচিত অপরিচিত মানুষের ভীড়। কোথাও আবিদ ভাই নেই, নিতুর মনের কোনে বিষন্নতার মেঘ জমতে থাকে। হঠাৎ খোলা জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই চোখে পড়ে একটি ছেলের সাথে দাড়িয়ে কথা বলছে আবিদ। দেখা মাত্র নিতুর পৃথিবী বিহবল হয়ে উঠে। চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যে নিতুর অসম্ভব ভাল লাগে।

সারিসারি সুপারির চারা রাস্তার দুপাশে লাইটপোষ্টের মত দাড়িয়ে আছে। মিহি ঠাšডা বাতাসে পাতাগুলি তরতর করে নড়ছে,খানিকটা দুর থেকেও নিতু লক্ষ্য করে আবিদের চুলগুলি বারবার এপাশ ওপাশ করছে আর সেটাকে সামাল দিতে সে ব্যাস।
ইতসত পায়ে নিতু দুজন ছেলের সামনে এসে দাড়ায়। বৈরি বাতাস নিতুকেও আক্রমন করে উড়নাটা এদিক ওদিক সরে যেতে চায়। নিতু সামনে এসে দুপায়ে দাড়িয়ে থাকে নির্বাক হয়ে মনে মনে ভাবে কি এক নেশার মত জানালা থেকে একেবারে সামনে এসে দাড়ালো সে তারপর কি করবে কোন পরিকল্পনায়তো নেই। মনের গহবরে যে তৃষ্ণা ছিল সব কেমন এলো মেলো হয়ে যাচেছ।

নিতুকে সামনে পেয়ে ওরা দুজন ভাবে একোন আকাশপরী, পাশের বন্ধুটি অবচেতন মনে বলে,
: আপনি নিতু, আপনি আবিদের মামাতো বোন, আপনি–।

: হ্যা ঠিকই ধরেছেন, কিন্তু আপনি কে ?

: আমি আবিদের বন্ধু, একই ক্লাসের আগামী মাসে আমাদের মেট্টিক পরীক্ষা। নিতু হাসে।

কথাবার্তা চলতে চলতে নিতুর মনে হয় আবিদ কেনো কথা বলছে না ?

হঠাৎ কৈশর উর্ত্তীর্ন সদ্য যুবকটি নিতুকে বলে আপনি কোন ক্লাসে পড়েন ?

এতক্ষণে সামনে দাড়িয়ে থাকলেও আবিদের মুখের দিকে একবারও তাকানো হয়নি নিতুর চোখ পড়তেই মনে হয় হালকা গোফে কি স্নিগ্ধতা সারাটি মুখে, ছবিতে দেখা মুখটির চেয়ে যেনো আরো বেশী সুন্দর।

নিতু বলে ক্লাস নাইনে।

দুজনের চোখে চোখ পড়তেই আবিদ এর খেয়াল হয় এতক্ষনের ঠাšডা বাতাসটা বোধহয় অকস্মাৎ থেমে গেলো দিনের সুর্য থাকলেও তার কাছে মনে হয় যেনো কোন আলো নেই।

এতো সুন্দর মুখও কারো হতে পারে, সিলকের নীল রংয়ের সালোয়ার কামিজ যেনো দুত্যি বিকিরন করছে, ভাবনার চেয়ে ও অপরুপা আর গরবিনী নিতু।

ওরা বাড়ী ফিরে এসে বিয়ের অনুষ্ঠানের কোলাহলে যোগ দেয়।

সুবাহান সাহেব ও তার স্ত্র্রী মেয়েকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলেন এখানে এই পরিবেশে নিতু মানিয়ে নিতে পারবে কিনা কিন্তু সে দিব্যি হৈ চৈ করছে দেখে আস্বস্ত আসস্থ হন উনারা।

আবিদ নিতুর সামনে আসেনি দু দিন এর হৈ চৈ এ। সুতিক্ষ্ন দৃষ্ষ্টি নিয়ে নিতু আবিদকে খুঁজে বেড়ায়। বিয়ের শেষ দিন সবাই যখন রং মাখামাখি করছে নিতু পরিকল্পনা করে মনে মনে আবিদের মুখে সে রং মাখিয়ে দিবে, আবিদকে বৈঠকখানার বাড়ান্দায় একা বসে থাকতে দেখে মন্তর পায়ে নিতু তার পেছন গিয়ে দাড়ায় এবং আলগোছে রংমাখা তার দুটিহাত আবিদের গালে লাগাতেই আবিদ ঝট করে হাত দুটি ধরে ফেলে । ছি ছি এখন কি হবে? নিতু ভাবে। এমনিতেই নিতুর বুকের ভিতরটা ঢিপ ঢিপ করছিল। তার উপর আবিদ যখন শক্ত হাতে নিতুকে আটকে রাখে, লজ্বায় তার তখন মরে যাবার মত অবস্থা। জোরে চিৎকার দিয়ে উঠে, ছাড়ুন! কেউ কারো মুখের দিকে তাকায়না, নিতু দৌড়ে পালিয়ে যায়।

এরপর একদিন কেটে যায় ঘোরের ভেতর নিতু কারো সাথে তেমন কথাবার্তা বলেনা। সুবাহান সাহেব নিতুকে ডেকে বলেন পরশু থেকে তোমার স‹ুল সুতরাং কাল সকালেই আমরা রওনা দেবো তোমার কাপড় চোপড় গুছিয়ে নাও। নিতুর বুকটা কেপে উঠে, মনের আকাশে যেনো কালো মেঘ নেমে আসে।

রাত শেষ হতেই প্রচন্ড বৃষ্টি। ঘর থেকে বের হবার উপায় নেই। নিতুর মনে আবিদের অপেক্ষা । হয়তো যাবার আগে সে একবার এঘরে আসবে। রওনা হবার মাত্র আর কিছুসময় বাকী, আবিদের কোন পাত্তা নেই। তাহলে যাবার আগে কি আর দেখা হচেছনা ? অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। নিতুর ভীষন কষ্ট হতে থাকে। সে জানে আবিদ বৈঠক খানায় আছে। কিন্তু এই বৃষ্টি অপেক্ষা করে নিতু কিভাবে যাবে সেখানে। কিছুক্ষন পর কিভেবে ঝট করে ঘর থেকে বাইরে যাবার জন্য পা বাড়ায় সে। ঝমঝম বৃষ্টিতে নিমিষে ভিজে চপচপ হয়ে যায় নিতু। পরিচিত অপরিচিত মানুষের ভীড় বৈঠক খানায়। নিতু ভেজা শরীর নিয়ে দাড়ায়। কাপড় থেকে টপটপ পানি ঝরছে। আবিদ সব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে, সে জানে নিতু এঘরে এসেছে শুধু তার কারনেই। মাথায় যেনো আকাশ ভেংগে পড়ে। মনে মনে আওড়ায় একি! এতো শূভ্রতা, এতো এতো সুšদর্য আর কোমনীয়তা। এতোদিনতো সে কোথাও দেখেনি, মাথার ভেতরটা এলোমেলো হয়ে যায়। নিতু যেনো সামনে কাউকে দেখছেনা। সে আবিদের কাছে হাটু গেড়ে বসে বলে আমরা চলে যাচিছ তুমি আসবেতো আমাদের বাসায়? আবিদ কেঁপে উঠে। ছি, ছি মানুষগুলো শকুনের মত নিতুর শরীর দেখছে। যততারাতারি সম¢ব নিতুকে বলে অবশ্যই আসবো, তুমি যাও। বৃষ্টির ঠান্ডা বাতাসের মধ্যেও আবিদ ঘামতে থাকে। সকলের ঠোঁটের কোনায় কৌতুকের হাসি। আবিদ নিশ্চুপ বসে থাকে আর নিতুরা ঢাকার পথে রওনা হয়।

শীতের ঘনঘটা চলে যায়। বসন্ত আসে, সময় বদলায়। আবিদের শরীর মনে কেবলই উথাল পাথাল, পড়াশুনায় মন বসেনা, সারারাত দিন সেই অপরুপ মেয়েটির মুখ চোখে ভাসে। পাড়াগায়ের মেয়েদের সাথে তার কোন মিল নেই, এরা সব ধুলোমাটির মেয়ে, দুঃখ পেলে চিৎকার করে কাঁদে। রাগলে অশিল ভাষায় গালিগালাজ করে। কিন্তু নিতু কি অন্যরকম। আবিদের কিছুই ভাললাগেনা, কি এক অদ্ভুত সময়। একদিন খাঁ খাঁ দুপুরে, গ্রামের পাখীরা সব শীতল জায়গা খুঁজে লুকিয়ে আছে। বাতাস নেই রোদের তাপে সব যেনো সব্ধ। আবিদের বুকের হাঙ্গর কুমিরেরা নখের আচর লাগায়। কি এক অনুভুতি সারা দেহ মনকে অস্থির করে তুলে। কি করবে সিদ্ধান্তে যেতে পারেনা। কয়দিন পর আই এ পরীক্ষা এই সময় ঢাকা যাওয়া কি ঠিক হবে ? অথচ নিতুর প্রতিটি অংগভঙ্গি চাহনি আবিদকে বারবার নাড়া দেয়। পূর্ণদৈর্ঘ একটি ছবির মত চোখের সামনে সেই দিনগুলির স্মৃতির রিলটি

বারবার চলতে থাকে, আবিদ যেনো আলোথালু চুলে বাউল পথিক, কিসের সন্ধানে পাগল প্রায়।

অবশেষে ঢাকার পথে রওনা হয় আবিদ। ঢাকায় এসে আশাতিত অভ্যর্থতীত হয়না সুবাহান সাহেবের কাছে। নিতুর বাবাকে কেমন অপরিচিত মনে হয় আবিদের কাছে। এর কোন কারন খুঁজে পায়না সে।

নিতু বাসায় ফিরে বিকেল চারটায় ¤কুল ছুটির পর। ¤কুলে তার মন বসেনা আবার বাসায় ফিরলেও কেমন উদাস থাকে। অকল্পনীয় সব ভাবনা মাথায় নিয়ে ঘোরে সে এখন। কাউকে শেয়ার করার কথা ভাবতেও পারেনা যা সে রোজ রাতে রোজ ভোরে ভাবে, অর্ধরাত্রিতে ঘুম ভেংগে গেলে ক্যাসেট পেয়ারে অনবরত গান বদলায়। মেয়ের এমন নিঃশব্ধ দেখে বাবা মা নিঃসব্দে ভাবে কি এমন ব্যাপার যা আমাদের বলা যায়না ? নিতুতো আগে এরকম ছিলোনা ?

মায়ের চোখ এড়ায় এমন কোন বিষয় সনানের থাকেনা,নিতুর মা বুঝতে পারে বিয়েতে যাবার জন্য কেন সেদিন এতো উচছাস দেখেছিল নিতুর মুখে, এছাড়া বরিশালে একদিন জ্যোস্না ও কুয়াশার ভেতর আবিদকে দেখেছেন তিনি নিতুর ঘরের জানলায় দাড়িয়ে নিশ্চুপ নিতুর ঘুমন মুখের দিকে চেয়ে আছে। সে কথা ঊনি গোপন করেছিলেন মনে মনে ভেবেছেন ঢাকায় ফিরে গেলে এসমস্যা মিটে যাবে কিনু দিনদিন নিতুর অন্যমনঙ্কতা দেখে নিতুর মা ঠিক করেন তার বাবাকে বিষয়টি জানানো উচিৎ কেননা এটি নিতুর সময়ের ও বয়সের বৈরী বাতাস, মেয়েকে নিয়ে সকল সপ্ন সাধ বিফল হতে পারে।

খাবার টেবিলে আসছে না দেখে একদিন সুবাহান সাহেব নিতুর ঘরের দরজায় দাড়িয়ে বলেন
: বাবা টেবিলে বসে খেতে ডাকছি আসছিস না যে ?

: তুমি যাও বাবা আমি আসছি।

: এতো মনোযোগ দিয়ে কি বই পড়ছে ? ¤ত্রীকে গিয়ে বলেন সুবাহান সাহেব।

: বই পড়ছে না ছাই।

: তার মানে ?

: ওটা তোমার ইঞ্জিনিয়ারিং থার্ড ইয়ারের বই, ওটাতে ওর পড়ার কি আছে । বই এর ভেতর আবিদের একটি ছবি রাখা সেটা সে বসে বসে দেখছে ।

সুবাহান সাহেবেব পৃথিবী যেনো ঘুরতে থাকে। উত্তেজিত হবে, নাকি শাš হয়ে বসবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছেনা। আকসি¡ক ভাবে সব্ধ হয়ে যান তিনি। মোটা ফ্রেমের চশমাটি টেবিলের উপর রেখে উঠে দাড়াতে চাইলে নিতুর মা অনুরুধ করেন এখন কিছুই বলোনা। দুদিন পর মেট্টিক পরীক্ষা। সমস্যা আরো বেড়ে যেতে পাওে। যাক আরো দু একদিন।

এরই মধ্যে আবিদ এসে যখন ঢাকায় উপসি’ত তখন সে নিশ্চয় পাক্তিয়ো হতে পারেনা। নিতুর ঘরের পাশেই গেষ্টরুম, আবিদ সেখানে একটি ম্যাগাজিন হাতে নিয়ে শুয়ে আছে। নিচের কলাপসিবল গেটে শব্দ হলেই আবিদের বুকটা ঢক ঢক করে কেঁপে উঠে এই বুঝি নিতু এসেছে। বাড়ীতে চাকর বাকর গিজ গিজ করছে দুপুরের খাবার পর চা খাবে কিনা। কোন অসুবিধা হচেছ কিনা এ প্রশ্নটা গোটা কয়েকজনে করে গেলো, শুধু মামী আসেননি মামাও নন।

নিতু বাসায় ফিরলে তার কাজের মেয়ে সফিনা গিয়ে বলে,
: আফা একজন মেহমান এসেছেন উনার নাম আবিদ।

নামটা শোনা মাত্র নিতুর অšতরাত্মা শুকিয়ে যায়। বুকের ভেতর থেকে বাতাস বব্ধ হয়ে গলাটা কাঠ হয়ে উঠে।
: কোথায় উনি?
: গেষ্টরুমে।
পা বাড়াতে পারেনা নিতু। কোন সমপর্কের সুত্রতো নয় আবিদের সাথে তার। কোন কথাতো বলার নেই তবে কি ভেবে সে অসি’র হয়েছে তার জন্যে?
নিতু সামনে দাড়াতেই আবিদ ঝট করে উঠে বসে এবং সোজা হয়ে ঠাই দাড়ায়। অনেকক্ষন কেউ কোন কথা বলেনা, কি বলবে এই প্রসতি চলতে চলতেই নিতুর মা ডাক দেন ঘরে আসবার জন্যে নিতুকে। ফিরে এসে নিতু ভাবে কেনো কিছুই বলতে পারলাম না যা কিছু ভেবে রেখেছিলাম। আবিদ ভাই কি ভাববে ? ভাববে কি সে অপ্রত্যাসিত নিতুর কাছে । কতটা অপেক্ষার শেষে আজকের এই দিনটি সে কেবল নিতু জানে ।

রাতে খাবার টেবিলে বসে সুবাহান সাহেব নানা প্রশ্নে আবিদকে ব্যাস রাখে – তোমার মায়ের শরীর কেমন ? এবারের ধান কেমন হলো তোমাদের জমিতে ? সাকীর বৌ কেমন সংসার চালাচেছ ? ইত্যাদি ইত্যাদি । এতো কথার মাঝে নিতুর দিকে চোখ তুলে তাকাবার সময় পায়না আবিদ। নিতু কেবল মাথা নিচু করে ভাত নাড়া চাড়া করে হঠাৎ তার পা দিয়ে আবিদের পায়ের মধ্যে আলতু করে একটা চাপ দেয় টেবিলের নিচে। আবিদ ইলেট্রিক শক্ট পাবার মত কেঁপে উঠে! ভাত মুখে দেবার সাহস দমে যায় তার। টিভি দেখার ভান করে সুবাহান সাহেব টিভি রুমে সবার সাথে প্রায় অর্ধরাত পর্যন বসে থাকেন । কি এক প্রসংগে কথা বললে বলতে বলেন কাল সকাল কয়টায় আবিদ রওনা হতে চায়। তাহলে সকালে অফিসে যাবার সময় বাস ষেটশনে নামিয়ে দেয়া যেতো।

নিতুর দু ভ্রু কুঞ্চিত হয় এতো তাড়া কিসের ? আজই তো এলো আবিদ ভাই । গেষ্ঠ রুমে না দিয়ে নিচ তলায় ড্রাইভারের পাশের খালি রুমটাতে আবিদের শুবার ব্যাব¤হা করে দেয়া হলো, ড্রাইভারের সাথে গল্প করে করে ঘুমাতে পারবে বলে ।

বাবার প্রতি নিতুর প্রচন্ড রাগ হয় এতোটা বাড়াবাড়ি না করলেও পারতেন। নিতু ভাবে মানুষে মানুষে এতটা ভেদাভেদ কেনো হয়? আবিদ গ্রামের বলে গেষ্ঠরুমে শোবার অধিকার কি তার নেই? নিজের রুমে ফিরে এসে ছটফট করতে থাকে নিতু, রাত গভীর থেকে গভীর হয়, নিতুর চোখে ঘুম আসেনা, ভীষন কাšনা পায় কাল সকালেই আবিদ ভাই চলে যাবেন। স্কুলে যাবার আগে অনেক ভোর আর ফিরে আসার পর বিকেল সুতরাং তার সাথে দেখা হবার কোন উপায় নেই। বুকটা হা হা করে উঠে নিতুর। বাতি নিভিয়ে অনেকক্ষন হাটা হাটি করে,মাথার ভিতর কি সব এলোমেলো চিন্তুা হয়। বাবা মা কি টের পেলেন আবিদ ভাইকে নিয়ে তার ভেতরের ভাংগচুরের কথা ? তাহলেতো আর কোনদিনও দেখা হবেনা তার সাথে । বালিশে মুখ গুজে নিতু ভাবে কেনো এতো কষট হচেছ তার? আবিদ ভাই কি জানেন নিতুর মনের কথা, নিতু জানে আবিদ ভাই আজ রাতে ঘুমাবেন না জোনাকী নক্ষত্রের মত জলবে একা ঘরে বসে বসে। ভীষন কান্না পায় নিতুর।

অবশেষে একটি কালো চাদর গায়ে জড়িয়ে একটুকরা ধুসর মেঘের ছায়া সাজে সে তারপর ধীরে ধীরে একেকটি বিপদজ্জনক স’ানকে অতিক্রম করে সামনে এগোয় যেনো পাহাড়ের পর মেঠো পথ। তারপর ছোট্ট নদী এবং তারপর একটি নক্ষত্রের আলো জলা কুড়ে ঘরের সামনে এসে যখনই ধূসর মেঘটি ছায়া ফেলে আবিদ ভুত দেখার চমকে উঠে, ফিসফিস করে বলে,
: নিতু তুমি? এখানে কি করে এলে? হায় কি সর্বনাশ যদি কেউ দেখে ফেলে?
: তুমি ঘুমাওনি ? নিতু জিগেগস করে,
: না ঘুম আসছিল না, ভাবছি নেশার মত কি ভেবে চলে এসেছি। এখন মনে হচেছ কেনো এলাম মামা মামী ভীষন অন্যরকম। নিতু তোমার পায়ে পড়ি ঘরে যাও।
: চলে যাবো তোমাকে একটা জিনিস দিতে এসেছি। একটি কাগজের টুকরা হাতে গুজে দিতেই দুজনের শরীর কেপে উঠে, এতোটা কাছাকাছি কখনও হয়নি ওরা দুজন। নিতুর ঘন চুলের গন্ধে আবিদের বুকের ভেতর স্পন্দিত হয়। শরীরের মধ্যে কেমন উতাল পাতাল ঝড় শুরু হয়ে যায় কিন্তু আবিদ হনুমানের মত বুক দিয়ে সেই ঝড়কে আটকাবার চেষ্ঠা করে । নিতু আবিদের হাত ঝট করে নিজের হাতের মধ্যে নিলে আবিদ কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বলে এখানে কি জন্যে এসেছো? কি চাও তুমি? অন্ধকারেও আবিদের চোখ দুটি আগুনের মত জ্বল জ্বল করে, ভয়ে বুকটা শুকিয়ে আসে তার।

নিতুরও কি হয়েছে পা টা যেনো আটকে আছে মাটির সাথে সে সরাতে পারেনা, ধীরে ধীরে নিবিড় হয় সে আবিদের, কাধে হাত রাখে এবং একপর্যায় পাগলের মত চুমু খায় তার সারা মুখে। এরপর আবিদকে জড়িয়ে ধরলে আবিদ পায়রার মত ঝাপটা ঝাপটি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় নিতুর কাছ থেকে। হঠাৎ দরজার কাছ থেকে কাকে ছায়ার মত সরে যেতে দেখলে নিতু দৌড়ে পালিয়ে গিয়ে দরজা বন্ধ করে।

আবিদের শরীরে তখন আগুন জলে উঠে। যেনো কুমিরের মুখ থেকে সুস¡াদু মাছটা সরে গেছে গভীর জলে। আবিদ ভোর হবার আগে পালিয়ে যায় কেননা সে জানে বাসার সকল মানুষের কাছে খবরটা পৌছে গেছে ।

এরপর থেকে আবিদ খুব অন্যমনঙ্ক। সারাক্ষণ সে নিতুকে ভাবে, এতো দুধালো শুভ্রতাতো কেবল বেলি ফুলের দেখা যায় মিানুষেরও কি হয় ? সে যেনো রূপকথার রানীদের হাত, চোখ, আর মুখ, আবিদ ভাবতে ভাবতে নীল বিষাদের রেখা ফুটিয়ে তুলে তার চোখে মুখে, এভাবে ভিতরের অস্তিত্বটাকে তোলপাড় করতে করতে ধীরে ধীরে স্বপ্নাচছন্ন আবিদের ঘোর কাটে বাসবের শীতলতায়।

বন্ধুরা খবর বয়ে আনে নিতুর বিয়ে গেছে তার বাবার অফিসের এক নতুন ইšিজনিয়ারের সাথে। আবিদ ভেতরে ভেতরে ভাংচুর হয় কেননা এতোটা দিন পার হয়েছে নিতুর একটা খবরও সে নেয়নি। সে জানে নিতু তার জন্য কতটা অপেক্ষায় ছিল, উপায় না পেয়ে হয়তো বিয়ে করতে সম্মোহিত হয়েছে।

এরপর নটে গাছটি মুরোলো আবিদ নিতুর গল্প ফুরোলো..

এরকম একটি পরিসমাপ্তি হতে পারতো কিন্তু দশ বছর পর এক বিকেলে সুবাহান সাহেবের সাথে দেখা হয় আবিদের । আবিদ এখন ব্যাংকের ম্যানেজার। কাউšটার থেকে টাকা ভাংগিয়ে ফিরে যাবার সময় পেছন থেকে আবিদ ডাক দেয়, মামা!

আবিদ এখন অন্য রকম। এক পলকে চিনে ফেলবার কথা নয়। সুবাহান সাহেব খানিকটা ইতসত করে তাকায়। আমি আবিদ। ও হ্যা, তা তুমি এখানে?

আমি এ ব্যাংকের ম্যানেজার এর পদে আছি। ও আচছা , আচছা, কত বছর পার হলো কোনই যোগাযোগ নেই। আবিদ প্রসংগ বদলায় মামাী কেমন আছেন?

ভাল ভাল, নিতুও ভাল আছে, তা ঢাকায়ই যখন আছো ফোন টোন করো।

বুড়ু সুবাহান সাহেব অনায়াসে মেয়ের নাম্বারটা দিয়ে দিলেন। হয়তো ভেবেছেন এতো বছর পর মনের কি আর কিছু অবশিষ্ট থাকে?

নিতুর নামটা শুনা মাত্র বুকের ভেতর টা চিন চিন করে উঠে আবিদের। মনের খাতায় গোটা গোট অক্ষরে নামবারটা লিখে ফেলে সে।

অফিস শেষে ঘরে ফেরার কথা ভুলে যায় আবিদ। সে উপলব্ধি করে মাথার ভেতর ঘুনপোকারা অনবরত ঝি ঝি শব্দ করছে। এলোপাথারি হাটতে থাকে রমনার পথ ধওে। কি এক অশরিরি দেবতা তাকে চালিত করে অন্য পথে।

ফোনে ক্রিং ক্রিং শব্দ হতেই চাকর গোছের একজন ওপাশ থেকে বলে

: আসসালামুআলাইকুম কারে চান?

নিতু বাসায় আছে কিনা নিশ্চিত হয়ে বাসায় ঢুকে আবিদ। চাকর ছেলেটির সাথে কার কথা হলো, কি কথা হলো নিতু তা খেয়াল করেনি, সে ড্রয়িং রুমে বসে পত্রিকার পাতা দেখছিল আনমনে। আবিদ সিড়ি দিয়ে ঊপরে এসে ড্রয়িংরুমের মাঝ খানে দাড়িয়ে মšত্রমুগ্ধের মত নিতুর দিকে একপলকে চেয়ে থাকে । নিতু ছায়ার মত কাকে সামনে দাড়ানো দেখে চোখ তুলে।

হঠাৎ মাথাটা তার ঘুরে যায়। থরথর করে কাপতে শুরু করে, অ¤ফুট স¡রে বিড়বিড় করে বলে, আবিদভাই!

মুহুর্তে অজানা আশংকায় নিতুর মুখটা কালো হয়ে উঠে যদি এতো বছর পর সে রাতের ঘটনাটা তার স্বামীর কাছে বলে দেয় ? যদি প্রতিশোধ নেবার জন্যে আজ তার সংসার ভেংগে দেয়?

বি¤িমত হয়ে চেয়ে থাকে আবিদ নিতুর দিকে। কতটা বদলে গেছে সে।সে ভাবে হয়তো আবিদ নিজেও বদলেছে অনেক, নিতুর সংসার হয়েছে, আবিদের কোন ঘর নেই, সজন নেই, আজো সে একা।

: তোমার স্বামী বাসায় নেই? : না, সে কšসট্টাকশনের কাজে সাইডে গেছে। তাহলে বাসায় তুমি একা তাইতো?

নিতুর ভেতরটা কেপে উঠে আবিদ এভাবে বলছে কেনো ? একটু জোরেই হেসে উঠে আবিদ,
: ভয় পেলে মনে হচেছ? ভয়কি। শোন নিতু একটা যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচিছ দীর্ঘদিন ধরে আমার শরীরে ও মনে, প্রচন্ড রকমের যন্ত্রণা। এরকম একটি সময়কেই আমি খুঁজছি। সেকারণেই আমি এতোটা পথ পাড় করে দিলাম একা। সে কারণেই আজও আমার কিছুই হলোনা।

নিতু অসম্ভব ভয় পেয়ে কাঁপতে থাকে ।

আজ আমি একটা জিনিস চাইবো যা তুমি একদিন দিতে চেয়েছিলে আমি নিতে চাইনি। তার কারণে আজো বড় তৃষ্ণা নিয়ে পথ চলি।

নিতুর ঠোঁট শুকিয়ে আসে ভয়ে। শ্মশানের আগুন তার চোখে মুখে । যে কোন মুহুর্তে তার স¡ামী চলে আসতে পাওে। যদি দেখে ——।
কি বলছো আবিদ ভাই ?
নিতু আমি নিরুপায়, এই স¡জনহীন পৃথিবীটা বড় বিভিষিকাময়, একটু দয়া করো, কোনদিন আর আসবোনা।

নিতু কেঁদে দেয়, তোমার পায়ে পড়ছি আবিদ ভাই, তুমি যাও। আর কোনদিন এসোনা। এক্ষনি হয়তো ও চলে আসবে।

নিতু তোমার ডাগর চোখ, ভরা পুর্নিমার মত মুখের রং, মোমবাতির মত আংগুল, ঘন চুল আর সর্বোপরি তোমার ভালবাসা দিয়ে যে রাতে আমার গায়ে আগুন ধরিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলে সেই থেকে আজও আমি দিশেহারা পাখি। তুমি আমাকে এ যšত্রনা থেকে রেহাই দাও।

নিতু এবার হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করে । আবিদ ভাই তুমি কি পাগল হলে ? আমি এখন অন্যের স্ত্রী। তোমার কাছে আমি আমার সংসারটিকে ভিক্ষা চাচিছ, তুমি দয়া করো তুমি যাও।

নিতু আমিতো বলেছি আমি নিরুপায়।

কথাটা বলতে বলতে এক ঝটকায় নিতুর মুখটা টেনে কাছে আনে আবিদ এবং খনিক দেরি না করে নিতুর ঠোঁটদুটি আবিদ তার ভেতরে নিয়ে নেয়, একই ভাবে দীর্ঘসময় পার হয়ে যায়, নিতু কিছুই বলেনা, ভাললাগায় দুচোখ বুজে থাকে।

আবিদ উঠে দাড়ায়। নেশা ধরা পায়ে জীবনের সবচেয়ে কাংখিত সময়টি পাবার পর ধীরে এবং চিরদিনের জন্যে নিতুর বাসাটি পেছনে ফেলে সামনে হাঁটতে থাকে ।

নিতু দীর্ঘসময় একই ভাবে সপ্নাচছন্ন হয়ে বসে থাকে। তার মনে হয় শরীরে তার প্রচন্ড জ্বর এসেছে। বিড়বিড় করে কি যেনো বলে নিজেও জানেনা। শুধু আবিদের কলাপসিবল গেটটি থেকে পাড় হবার শব্দটি কানে যেতেই বলে, আবার কবে আসবে আবিদ ভাই? আবার কবে ? ঠিক এইভাবে।

চাঁদপুর টাইমস : প্রতিনিধি/এমআরআর/২০১৫

Share