বাসা থেকে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হতে একটু দেরি হয়ে গেলো আজ। কিন্তু এই দেরির কারণেই হয়তো দেখা পেলাম একজন সাহসী নারীর। গলির মুখে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিলাম। ভাড়া বেশি বলায় পর পর দুটো রিকশা বিদায় দিলাম। এর পর সামনে এলো তৃতীয়খানা। দেখলাম রিকশা চালক একজন নারী। উনাকে এর আগেও দেখেছি আমাদের শহরে। হাস্যজ্জ্বোল মুখে যাত্রী নিয়ে ছুটে যান নানা গন্তব্যে।
যেদিন প্রথম দেখেছিলাম, সেদিন খুব অবাক হয়েছিলাম। আমার দেখা প্রথম একজন নারী রিকশা চালক। কতটুকু সাহসী হলে একজন নারী রিকশা চালকের পেশা গ্রহণ করতে পারে, সেদিনই ভেবেছিলাম। আর আজ তার সাহস ও দৃঢ়তার প্রমাণ পেলাম নিজের চোখে।
নারীরা খুব চ্যালেঞ্জিং কাজ করতে অক্ষম এমন একটা প্রচার আছে সমাজে। সেই প্রচারটা যে কতটা অপপ্রচার মাঝে মাঝেই তা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে যান কিছু সাহসী নারী।
ফাতেমাও সেরকমই একজন। চটুল কথার টিপ্পনীকে পাশ কাটিয়ে যিনি আত্মবিশ্বাসের সাথে ছুটে যান নগরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কোন পুরুষের দ্বারস্থ না হয়েই যিনি দুই সন্তান নিয়ে স্বাধীন ভাবে বেঁচে থাকেন এই সমাজে, এই দেশে।
রিকশায় উঠেই তাঁর সাথে কথা শুরু হল:
” খালা, নাম কি আপনার?”
মাথা ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বললেন… “ফাতেমা”।
” কতদিন ধরে রিকশা চালাচ্ছেন আপনি?”
“অনেকদিন”
“সমস্যা হয় না?”
না। কি সমস্যা হবে!”
না মানে, মানুষ জন কিছু বলে না? আসলে মহিলাদেরতো রিকশা চালাতে কেউ দেখে নাই। ”
খুব দৃঢ়তা সাথে বললেন… “না সমস্যা কোথায়! আর মানুষ কি আমারে খাওয়ায় নাকি মা? নিজে কষ্ট করে রোজগার করি। কে কি বলে তা কানে নিয়ে লাভ কি!”
“আপনার পরিবারের মানুষজন এই কাজকে কিভাবে নিয়েছে!”
ভালোভাবেই নিয়েছে মা। কোনো সমস্যা হয় না।”
আপনার স্বামী কি করে?”
স্বামী নাই। আরেকটা বিয়ে করে চলে গেছে।”
ছেলে-মেয়ে কজন?”
এক ছেলে, এক মেয়ে।”
ওরা পড়ালেখা করে?
হ স্কুলে যায়।”
আরো জানলাম উনার বাসা ওয়ারলেস এলাকায়।
কথার ফাঁকে ফাঁকে পেছন ফিরে কয়েকবার দেখলেন আমাকে। চোখ ছল ছল, মুখে হাসি। আমার ভেতরটাও কেমনে একটা করে উঠলো।
আমাদের কথাবার্তার মাঝখানে কানে ভেসে আসছিলো কিছু মানুষের ইয়ার্কি ফাজলামো। কিন্তু ঐ সব কথাকে পাত্তা দেয়ার সময় উনার নেই। ট্রাফিক জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকার সময় পাশে দাঁড়িয়ে ট্রাক থেকে এক ছেলে …” মাইপুয়ার রিকশাত মাইপুয়া” বলে হেসে উঠলো। ফাতেমা তাকে বললেন… “তাতে তোমার কোনো সমস্যা হইছে? তোমার কাজ তুমি করো।”
এক মধ্যবয়স্ক ভিখারিনীকে আমাকে দেখিয়ে বললো, “আমার মেয়ে এটা। আমি রিকশা চালাইলেও মেয়ে আমার অনেক বড় চাকরি করে।” কথা শুনে চোখে পানি চলে এলো আমার।
রিকশা থেকে নামার পর ভাড়া নিতে চাইলেন না। বললেন, মেয়ের কাছ থেকে কি ভাড়া নেয়া যায়!” ভাড়া ছিল ৩০ টাকা। জোর করে হাতে গুজে দেয়ার পর ১০ টাকা আমার আমার হাতে গুজে দিতে চাইলেন। বললেন… আচ্ছা ১০ টাকা কম দাও। এটা দিয়ে তুমি কিছু খেও। আমার চোখ ভিজে উঠতে চাইছিলো আবার।
আজকাল আবেগ ব্যাপারটাকে পাত্তা দিতে চাইনা। কিন্তু এই মহিলা বার বার আমার আবেগকে উতলে দিচ্ছেন! কি জ্বালারে বাবা! ফোন নম্বরটা নিয়ে নিলাম। বললাম, একদিন আপনার বাসায় যাবো কেমন। সেদিন খাবো।
তারপর আমার অনুরোধে হাসিমুখে একটা ছবির পোজ দিলেন। এক অন্য রকম ভালোবাসার অনুভূতি নিয়ে আমি রওনা দিলাম অফিসের পথে। মনে পড়ল আমাদের দেশের অনেক নারীর কথা যারা হাজারো নির্যাতন, নিপড়ন সহ্য করে পরাধীন অবস্থায় কুয়োর ব্যাঙের মত পড়ে থাকেন স্বামীর সংসারে। আর ফাতেমা কি সুন্দর স্বাধীন, সাহসী, আত্মবিশ্বাসী!
নিউজ ডেস্ক ।। আপডটে, বাংলাদশে সময় ৮: ৪৮ পিএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৬,বৃহস্পতিবার
এইউ